রাতের ফোন: বেলাডোনার বিষে বিভ্রান্তি ও হোমিওপ্যাথির অল্পবিদ্যা সত্যি ভয়ংকরী।

সংগ্রহ :  
ডঃ মোহাম্মদ জাকির হোসেন এর কাছ থেকে।

সচারাচর ডাক্তারদের আমি ( ডঃ মোহাম্মদ জাকির হোসেন) ফোন নাম্বার দেই না, এরা সময়ে অসময়ে ফোন দেয়।

গত রবিবার রাত ৩ টার দিকে জৈনক এক ডাক্তার সাহেব কল দিলেন।

যদিও ভদ্রলোককে আমি চিনি না, কারো মাধ্যমে আমার নাম্বার কালেক্ট করেছেন।

ফরিদপুর বাড়ী।
বিরক্তির সুরে বললাম এত রাতে কেউ কল দেয়,
স্যার নিরুপায় হয়ে কল দিয়েছি ক্ষমা করবেন।

আমার বাচ্চার ১২ বছর বয়স অনেক জ্বর দুই তিন দিন যাবৎ আমি বেলাডোনা মাদার টিংচার এর সাথে ব্রায়োনিয়া ২০০ দিয়েছি , জ্বর কমে গেছে কিন্তু বর্তমানে নতুন কিছু লক্ষন শুরু হয়েছে, অনেক ভয়ংকর , এত রাতে হাসপাতালে নেওয়ার ও সুযোগ নাই আমার বাড়ি চরাঞ্চলে, এখানে হাসপাতাল ও নাই বাধ্য হয়ে কল দিলাম।
কি সমস্যা হচ্ছে জিজ্ঞাস করায়।

স্যার চোখে ঝাপসা দেখছে, চোখ কেমন জানি বড় বড়ে করে রাখে , মাথা এদিক সেদিক বাড়ি দেয়,  এলোমেলো বলতাছে , ওর দাদা মারা গেছে সে নাকি ওর পাশে বসে আছে এইসব বলছে।
খালি পানি খেতে চাচ্ছে,  ঠোট শুকিয়ে আছে।
সারা শরীর লাল হয়ে গেছে।
আমি সন্ধ্যায় আর্সেনিক দিয়েছি কাজ হয় নাই।

জিজ্ঞাস করলাম বেলাডোনা মাদার কতটুকু দিয়েছেন বলল ২০ ফোটা দিনে তিনবার, বাংলাদেশী কম্পানী তাই বেশি করে দিয়েছিলাম , ওটা দেওয়াতেই জ্বর কমছে।

বললাম মিয়া ওটায় জ্বর কমছে কিন্তু ওটার বিষক্রিয়াতে আপনার ছেলে মরতে বসেছে,

আপনার ছেলের এট্রোপিন পয়েসনিং হয়েছে,

বেলাডোনার ভিতর একটি উপাদান আছে যার নাম এট্রোপিন, যদি অতিরিক্ত মাত্রায় এট্রোপিন দেহে প্রবেশ করে তখন এট্রোপিন পয়েসনিং হয়, এবং উপরোক্ত লক্ষন গুলো ফুটে উঠে,

আমাদের হার্টের রিদম কন্ট্রোল করে মূলত ভেগাস নার্ভ , যার মুল কাজ হলো হার্টের প্যারাসিম্পেথেটিক সাপ্লাই করা ( গত কাল স্টুডেন্টদের পড়াচ্ছিলাম প্যারাসিম্পেথেটিক নার্ভ একজন ও পারে নাই ,পড়া দিয়ে রেখেছি আগামী সপ্তাহে নিবো) মূলত হার্টের বিট কমাতে সাহায্য কপ্যারাসিম্পেথেটিক নার্ভ আর এই কাজ করে ভেগাস নার্ভ , এট্রোপিন ভেগাস নার্ভ কে ব্লক করে , ফলে হার্টের প্যারাসিম্পেথেটিক বন্ধ হয়ে যায়, হার্ট বিট অনেক বেড়ে যায়, এজন্য শরীর লাল বর্ন হয়ে উঠে, পিপাসা পায়, ঘাম হয়।

আমাদের ব্রেনে cerebral cortex, hippocampus, basal ganglia প্রচুর muscarinic (M₁, M₂, M₄, M₅) receptor থাকে।

Atropine এই receptor গুলো block করে normal cholinergic transmission নষ্ট হয়ে যায়। ফলে শুরুতে restlessness, irritability, পরে confusion, disorientation, High dose hallucination, delirium, agitation, psychosis ডেভেলপ করে।

কয়েক বছর আগে ডা: মিলসের বইয়ে পড়েছিলাম যদি এট্রোপিন পয়েজনিং হয় , তাহলে সবচেয়ে চমৎকার এন্টিডোট হল কফি, তিনি কফিয়া মাদার ব্যবহার করতেন।

ডাক্তার সাহেব কে বললাম যদি ঘরে কফিয়া মাদার টিংচার থাকে তাহলে ৩০ ফোটা করে ২ ঘন্টা পর পর দেন।

অথবা সকালের আগ পযন্ত মগ ভরে কফি দেন।

অবস্থার পরিবর্তন না হলে হসপিটালে নিয়ে যাবেন ( যদিও লো পয়েজনিং ছিলো আশা বাদি ছিলাম ঠিক হয়ে যাবে)

সকালে রোগি বাবা ফোন দিয়ে হাও মাও করে কান্না, স্যার অল্পবিদ্যা সত্যি ভয়ংকরী আমি আমার ছেলেকে মেরে ফেলছিলাম,

আমরা গ্রামের মানুষ তত ভালো বুঝি না।

ছোট খাটো বই পড়ি জ্বর ঠান্ডার চিকিৎসা করি, কিন্তু মেডিসিন থেকে যে এত কিছু হয় জানি না স্যার মাফ করবেন।

আপনার পরামর্শে ছেলে এখন নরমাল , ( আমি তাও বলেছি কাছা কাছি কোন ডাক্তার থাকলে দেখিয়ে আনেন)

গ্রামের কি খাবার পছন্দ করি জানতে চেয়েছেন উনি স্বাক্ষাত করতে আসবেন। 🥰🥰🥰

এই লেখা থেকে আমরা কয়েকটি গভীর শিক্ষা লাভ করিলাম —

1. অল্পবিদ্যা ভয়ংকর – অল্প জ্ঞান নিয়ে ওষুধ প্রয়োগ করলে সেটা রোগ সারানোর বদলে প্রাণসংহারক হয়ে উঠতে পারে। তাই চিকিৎসা কখনো বই পড়ে বা শোনা কথায় করা উচিত নয়।

2. হোমিওপ্যাথিক ঔষধও বিষ হতে পারে – অনেকের ধারণা, হোমিওপ্যাথি ক্ষতিকর নয়। কিন্তু ভুল মাত্রায় প্রয়োগ করলে (যেমন বেলাডোনা মাদার টিঞ্চার) ভয়াবহ বিষক্রিয়া হতে পারে। তাই মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা আবশ্যক।

3. ডাক্তারের পরামর্শ অপরিহার্য – কোনো রোগে বা জরুরি অবস্থায় কখনোই নিজে নিজে ওষুধ দেওয়া উচিত নয়। প্রশিক্ষিত ও রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জীবন রক্ষাকারী হতে পারে।

4. বিজ্ঞানের সাথে মানবিকতা – ডাক্তার শুধু ওষুধ দেন না, তিনি রোগী ও অভিভাবকের ভয়ের মুহূর্তে ভরসা দেন, সঠিক পথে দিকনির্দেশ দেন। এই গল্পে আমরা সেই মানবিক দিকও দেখি।

5. জ্ঞানই জীবনরক্ষার আলো – চিকিৎসা বিষয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জন করলে জীবন বাঁচানো যায়। আর ভুল বা অপূর্ণ জ্ঞান প্রাণনাশের কারণ হতে পারে।

সর্বপরি, প্রতিটি ওষুধের টক্সিলজি অধিকাংশ ডাক্তার জানেন না এবং জানার চেষ্টা ও করেন না। তাই এই ধরনের ভুল করে থাকেন।  হোমিওপ্যাথিতে ওষুধের টক্সিলজি পড়া অতীব জরুরী একটি বিষয়। 

সর্বশেষে শিক্ষা হলো—চিকিৎসা কখনোই খেলার বিষয় নয়। প্রশিক্ষিত ও রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের কাছে যাওয়া, সঠিক নিয়মে ওষুধ ব্যবহার করা, আর বিজ্ঞানের ওপর আস্থা রাখা—এসবই জীবন রক্ষার প্রধান উপায়।

চলুন বেলাডোনার টক্সিলজি জানার চেষ্টা করি ।

১) বেলা-ডোনা কী ও কেন বিষ হয়।

বেলাডোনা-র সব অংশে tropane alkaloid থাকে — প্রধানত atropine, hyoscyamine ও scopolamine। এরা অ্যাসেটাইলকোলিন নামক স্নায়ুবিষণুর প্রভাবকে ব্লক করে — অর্থাৎ অ্যান্টিচলিনার্জিক (anticholinergic) প্রভাব সৃষ্টি করে; তাই স্নায়ু, চোখ, হার্ট, ত্বক ও জঠরশক্তি-সবই প্রভাবিত হয়। 

২) বিষক্রিয়ার প্রধান লক্ষণ (Anticholinergic toxidrome)।

বেসিক (পারিফেরাল) লক্ষণগুলো:

মুখ, লালা, ঘামের পরিমাণ কমে → শুকনো মুখ ও ত্বক।

বৃহদাকার পুপিল (mydriasis) → ঝাপসা দেখা, আলোতে কষ্ট।

রক্তচাপ ও হার্ট-বিট দ্রুততে/ট্যাচিকার্ডিয়া।

ঘেউ ঘেউ করা বা তাপমাত্রা বাড়া, শরীর লাল হয়ে দেখায় (hyperthermia, flushed skin)।

প্রস্রাব হওয়া কমে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, অন্ত্রে শব্দ কমে যাওয়া। 


কেন্দ্রীয় (নিউরো) লক্ষণগুলো:

অস্থিরতা, বিভ্রান্তি, পরিব্যক্তু আচরণ, হ্যালুসিনেশন (দৃষ্টি/শ্রবণ বিভ্রম), ডিলিরিয়াম, কখনও কখনও ধারাবাহিক খিঁচুনি/কোমা। শিশুদের ক্ষেত্রে দ্রুত গুরুতর অবস্থা (ঝিমুনি → শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যর্থতা) হতে পারে। 


৩) রাতদিন/শুরু কেমন হয় — টাইমলাইন।

কাটা-কপি মাত্রায়: ৩০–৬০ মিনিটের মধ্যে লক্ষণ শুরু হতে পারে (খাওয়ার পর দ্রুত)।

শিশু খুবই সংবেদনশীল — তুলনামূলকভাবে কম আলকেলয়েডেও দ্রুত ও গুরুতর লক্ষণ দেখা যায়; খরচ্ণিক তথ্য মতে শিশুদের ক্ষেত্রে ~0.2 mg/kg atropine-র কাছাকাছি মাত্রা জীবন-হুমকিতে পরিণত হতে পারে। 


৪) কোন অবস্থায় জরুরি (একসাথে দেখা গেলে)— তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া আবশ্যক। 

শ্বাসকষ্ট, কোমা, অবচেতনতা বা মদ্ধ চেতনা।

উচ্চ জ্বর ও তাপমাত্রা (hyperthermia) যেটা নিয়ন্ত্রণহীন।

ক্রমাগত খিঁচুনি বা গুরুতর অস্থিরতা/আতঙ্ক-হ্যালুসিনেশন।

বেদনাদায়ক ট্যাকিকার্ডিয়া বা রক্তচাপ বিপর্যয়।

এমন কোনো লক্ষণ থাকলে দ্রুত ইমার্জেন্সি/পাঁচান্ড শাখায় নেয়া জরুরি। 


৫) প্রাথমিক ঘরোয়া সহায়তা (যদি হাসপাতাল অনেক দূরে) — what to do until professional help পাওয়া যায়।

শিশুকে শান্ত, ঠাণ্ডা, অল্প আলোয় রাখা — উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করে।

যদি শ্বাসযন্ত্র ঠিক না থাকে বা শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, রেস্পোসিভিটি থাকলেও দ্রুত ট্রান্সপোর্ট করুন।

যদি প্রেসক্রিপশন বা প্যাকেট থাকে—এটি সঙ্গে নিয়ে যান (যাতে ডাক্তারের কাছে সঠিক উৎস জানা যায়)।

নোট: কফি বা কফিয়া-টিঞ্চার ইত্যাদি যুদ্ধকালীন লোককথা হিসেবে বলা হয়ে থাকে (প্রাচীনে ব্যবহারও আছে), কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা-নির্দেশনায় এটি নির্ভরযোগ্য বা নিরাপদ অ্যান্টিডোট নয় — হাসপাতালের সাপোর্ট এবং নির্দিষ্ট অ্যান্টিডোট প্রয়োজন হতে পারে। (অর্থাৎ কফি 'বাঁচতে সাহায্য করতে পারে'—কিন্তু এটা প্রাথমিক ও নিয়ন্ত্রিত চিকিৎসার বিকল্প নয়)। 


৬) মেডিক্যাল ট্রীটমেন্ট — হাসপাতালে কী করা হয়।

1. সাপোর্টিভ কেয়ার: শ্বাসকষ্টে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট, তরল প্রয়োগ, মাথা ন্যূনতম উত্তেজনামুক্ত পরিবেশ।

2. অ্যাক্টিভ চারকোল: যদি গ্রহণের পর অল্প সময় হয়েছে (আসল সময়জট আছে), তবে অ্যাসিএটিভেটেড চারকোল দিতে পারে।

3. বেঞ্জোডায়াজেপাইন: ডিলিরিয়াম বা অ্যাজিটেশন/কনভালসনের নিয়ন্ত্রণে।

4. ফাইজোস্টিগমাইন (physostigmine) — নির্দিষ্ট অ্যান্টিডোট (এটি মস্তিষ্কে ঢুকতে পারে এবং কেন্দ্রীয়-প্রভাবিত লক্ষণগুলোকে উল্টে দিতে পারে)। তবে physostigmine প্রয়োগের সিদ্ধান্ত, ডোজ এবং পর্যবেক্ষণ অবশ্যই হাসপাতালে ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে হতে হবে—কারণ এটি নিজেরও ঝুঁকি থাকতে পারে। 

৭) বিশেষ সতর্কতা ও ঔষধ-সংক্রান্ত কথা।

বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কোনো বেলাডোনা-ভিত্তিক টিনচার বা ট্যাবলেট নিজে থেকে প্রয়োগ করা উচিত নয়। জন্মনিয়ন্ত্রক ও অনান্য ওষুধের সঙ্গে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে।

হোমিওপ্যাথিক বা ন্যাচারাল লেবেলে লেখা “অল্প” বা “প্রাকৃতিক” মানে নিরাপদ নয়—প্যাকেজিং ও শক্তি ভিন্ন হলে বিষক্রিয়া হতে পারে; FDA ও অন্যান্য সংস্থার সতর্কবাণী আছে (বিশেষত শিশুর দন্তব্যথার জন্যে ব্যবহৃত টোপিক্যাল/ট্যাবলেট প্রডাক্টগুলোর বিষয়ে)। 

৮) সারসংক্ষেপ — প্রধান মেসেজ (আপনি রোগী-পরিবারকে সহজে বলবেন)।

বেলাডোনা-জাতীয় টিংচারের অতিরিক্ত প্রয়োগ বিখ্যাতভাবে অ্যান্টিচলিনার্জিক বিষক্রিয়া দেয় — Pupil বড়, মুখ শুকনো, দৌড়ানো হৃদস্পন্দন, বিভ্রান্তি ও হ্যালুসিনেশন হতে পারে। 

বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে দ্রুত গুরুতর অবস্থা দেখা দিতে পারে — তাই শঙ্কা হলে ঘরোয়া ট্রিটমেন্ট নয়, দ্রুত হাসপাতাল। 

হাসপাতালে নির্দিষ্ট অ্যান্টিডোট (physostigmine) এবং সমর্থক চিকিৎসা দেওয়া হয় — অভিজ্ঞ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে এই চিকিৎসাই সঠিক। 


সংগ্রহ এবং  সংযোজন কারী
কাজী সাইফ উদদীন আহমেদ 
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক 

>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন