আইবিএস (ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম) কি, কেন এবং তার চিকিৎসাসহ বিস্তারিত

আইবিএস (ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম) রোগের এ টু জেড গভীর আলোচনা। 

আইবিএস কী?

ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম (আইবিএস) হল একটি দীর্ঘস্থায়ী অন্ত্রের সমস্যা, যা হজম প্রক্রিয়ার বিঘ্ন ঘটায়। এর ফলে পেট ব্যথা, বমি ভাব, ফোলাভাব, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য হয়।

ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম (আইবিএস) এর সুনির্দিষ্ট "আবিষ্কার :

ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম (আইবিএস) এর সুনির্দিষ্ট "আবিষ্কার" এর কোনো নির্দিষ্ট বছর নেই, কারণ এটি কোনো নতুন রোগ নয় বরং প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মধ্যে ছিল। তবে, ১৯৪০-এর দশকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই সমস্যার উপর আধুনিক গবেষণা শুরু হয় এবং ১৯৫০-এর দশকে এটি আরও ভালোভাবে চিহ্নিত ও বর্ণনা করা হয়।

১৯৮০-এর দশকে, আইবিএস নির্ণয়ের জন্য প্রথমবারের মতো রোম ক্রাইটেরিয়া নামে একটি নির্ণায়ক কাঠামো তৈরি করা হয়, যা আইবিএস এর উপসর্গগুলোকে নির্ধারণ করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এই রোগটি আসলে অন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে পরিচিত, যার প্রধান উপসর্গ হলো পেটের ব্যথা, ফোলাভাব, এবং বাওয়েলের অভ্যাসের পরিবর্তন (কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া)।

আইবিএস (ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম) রোগ এর কি কি নামে পরিচিত :

ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম (আইবিএস) রোগটি বিভিন্ন নামে পরিচিত হতে পারে, যেমন:
1. স্পাস্টিক কোলন (Spastic Colon)
2. মিউকাস কোলাইটিস (Mucous Colitis)
3. ইরিটেবল কোলন (Irritable Colon)
4. নিয়ারোগ্য কোলাইটিস (Functional Colitis)
5. ইরিটেবল বাওয়েল ডিজঅর্ডার (Irritable Bowel Disorder)

এই সব নাম আইবিএস-এর বিভিন্ন উপসর্গ বা অন্ত্রের কার্যকারিতার উপর ভিত্তি করে ব্যবহৃত হয়।


আইবিএসের লক্ষণসমূহ:
1. পেট ব্যথা বা অস্বস্তি: সাধারণত খাওয়ার পর বেড়ে যায় এবং মল ত্যাগের পর কমে।
2. কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়রিয়া: কিছু রোগীর কোষ্ঠকাঠিন্য হয়, আবার কিছু রোগীর ডায়রিয়া হয়।
3. ফোলাভাব ও গ্যাস: পেট ফোলাভাব, এবং অতিরিক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হতে পারে।
4. মলত্যাগে অস্বাভাবিকতা: অস্বাভাবিক গন্ধ বা আকারের মল দেখা যায়।
5. বমি ভাব: মাঝে মাঝে বমি হতে পারে।
6. মাথাব্যথা বা ক্লান্তি: দীর্ঘস্থায়ী পেটের সমস্যার কারণে ক্লান্তি অনুভব হতে পারে।

আইবিএসের কারণসমূহ:
আইবিএসের সুনির্দিষ্ট কারণ অজানা, তবে কিছু কারণ এর পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে:
1. হজমতন্ত্রের অস্বাভাবিকতা: অন্ত্রের পেশী সঠিকভাবে সংকোচন ও প্রসারণ না হলে হজম প্রক্রিয়ায় সমস্যা হয়।
2. নিউরাল অস্বাভাবিকতা: মস্তিষ্ক এবং অন্ত্রের সিগন্যালিং প্রক্রিয়ায় ত্রুটি দেখা দিতে পারে।
3. সংক্রমণ: অন্ত্রে সংক্রমণ বা অতিরিক্ত ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি ঘটলে আইবিএসের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
4. মানসিক চাপ: মানসিক চাপ ও উদ্বেগ আইবিএসের তীব্রতা বাড়িয়ে দিতে পারে।
5. খাদ্য অ্যালার্জি বা অক্ষমতা: কিছু খাবারের প্রতি সংবেদনশীলতা থাকতে পারে, যেমন গ্লুটেন, ল্যাকটোজ ইত্যাদি।

আইবিএস নির্ণয়:
মল পরীক্ষার মাধ্যমে অন্ত্রের সংক্রমণ বা অন্যান্য রোগ নির্ণয়।
ব্লাড টেস্ট: গ্লুটেন অ্যালার্জি বা অন্যান্য রোগ চেক করা হয়।
কোলনোস্কপি: অন্ত্রের মধ্যে কোনো প্রদাহ বা অস্বাভাবিকতা আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়।

আইবিএসের চিকিৎসা:

১. হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা:
ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম (IBS) এর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা রোগীর নির্দিষ্ট লক্ষণ এবং শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে ব্যক্তিগতভাবে নির্ধারণ করা হয়। তবে IBS এর ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ হোমিওপ্যাথিক ওষুধ রয়েছে, যা নির্দিষ্ট লক্ষণের উপর ভিত্তি করে দেয়া হয়:

১. Nux Vomica:
অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা ভুল খাদ্যাভ্যাসের কারণে আইবিএস হলে।প্রধানত গ্যাস্ট্রিক, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং মানসিক চাপজনিত IBS এর জন্য। খাওয়ার পর গ্যাস্ট্রিক সমস্যা, বমি বমি ভাব, এবং পেট ব্যথা থাকলে এটি ব্যবহৃত হয়।

২. Argentum Nitricum:
মানসিক উদ্বেগের কারণে যারা IBS তে ভোগেন, তাদের জন্য উপকারী। মানসিক চাপের ফলে ডায়রিয়া হলে। পেট ফাঁপা, গ্যাস জমা এবং ডায়রিয়া হলে এটি ব্যবহার করা হয়।

৩. Colocynthis:
তীব্র পেট ব্যথা, যা চাপ দিলে কমে যায়, এমন রোগীদের ক্ষেত্রে কার্যকর। পেটের মুড়ি মুড়ি ব্যথার জন্য।
বিশেষ করে পেটের বাম দিকে ব্যথা থাকলে এই ওষুধটি ব্যবহার করা হয়।

৪. Carbo Veg:
পেট ফাঁপা, গ্যাস, এবং হজমের সমস্যা হলে এই ওষুধটি ব্যবহার করা হয়। ফোলাভাব এবং গ্যাসের জন্য খুব কার্যকর। খাবার পর পেট ভারী লাগা এবং গ্যাস জমে যাওয়ার প্রবণতা থাকলে এটি কার্যকর।

৫. Lycopodium:
পেটের ডান দিকে ব্যথা, গ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং বদহজমের জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। ফোলাভাব ও গ্যাসের জন্য। মানসিক চাপ ও অনিদ্রাজনিত IBS থাকলে এটি কার্যকর হতে পারে।

৬. Sulphur:
পেট ফাঁপা, গ্যাস, এবং অস্বস্তি নিয়ে যাদের সমস্যা হয়, তাদের জন্য Sulphur ভালো কাজ করে।
এই ওষুধটি সাধারণত IBS রোগীদের জন্য হোমিওপ্যাথিতে বহুল ব্যবহৃত হয়।

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নিয়ম :
চিকিৎসা শুরু করার আগে রোগীর পূর্ণ ইতিহাস নেয়া জরুরি, যেমন খাবারের ধরণ, মানসিক অবস্থা, চাপ, শারীরিক লক্ষণ ইত্যাদি।
প্রয়োজনীয় ডোজ এবং পটেন্সি নির্ধারণ করবেন একজন অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক।
নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে লক্ষণের পরিবর্তন অনুযায়ী চিকিৎসা সামঞ্জস্য করতে হবে।
বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে এবং ধৈর্য ধরে এটি অনুসরণ করতে হবে।

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে, তাই সঠিক ওষুধ নির্ধারণের জন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।


২. আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা:
ত্রিফলা চূর্ণ: হজমশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
অশ্বগন্ধা: মানসিক চাপ কমিয়ে দেয় এবং অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
বিল্ব চূর্ণ: ডায়রিয়া নিরাময়ে কার্যকর।
অজমোদা (কারামা বীজ): গ্যাস এবং ফোলাভাব দূর করতে সহায়ক।
অ্যালো ভেরা রস: অন্ত্রের প্রদাহ কমাতে সহায়ক এবং হজমের উন্নতি করে।

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় রোগীর প্রকৃতি (দোষা) অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করা হয়। 
পিট্টা, কফা এবং বাত দোষার ভারসাম্য বজায় রেখে চিকিৎসা প্রদান করা হয়।

৩. এলোপ্যাথিক চিকিৎসা:
ফাইবার সাপ্লিমেন্ট: Psyllium বা অন্য ফাইবার সাপ্লিমেন্ট কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সহায়ক।
ল্যাক্সেটিভ: কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে ল্যাক্সেটিভ ব্যবহার করা হয়।
অ্যান্টি-ডায়রিয়াল ওষুধ: ডায়রিয়া কমাতে লোপেরামাইড বা অন্য ওষুধ।
অ্যান্টিস্পাজমোডিক ওষুধ: অন্ত্রের সংকোচন কমিয়ে পেটের ব্যথা কমায়।
অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট: মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমাতে নির্ধারিত ওষুধ ব্যবহার করা হয়।

এছাড়া, কিছু ওষুধ আছে যা হজমের প্রক্রিয়াকে উন্নত করে এবং গ্যাস বা ফোলাভাব কমায়। তবে, দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তারদের সাথে নিয়মিত পরামর্শ করা জরুরি।

জীবনযাপনে পরিবর্তন:
1. খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন: অতিরিক্ত ফ্যাট, মসলা, দুগ্ধজাত পণ্য, এবং গ্লুটেন এড়িয়ে চলা উচিত।
উচ্চ ফাইবার যুক্ত খাবার: শাকসবজি, ফল, ওটস, বাদাম, বীজ এবং পূর্ণ শস্য খাদ্য ইত্যাদি।
প্রোবায়োটিক: যেমন, দই, কেফির ইত্যাদি যেগুলো হজমে সহায়তা করে।
মসলা এবং গুল্ম: আদা, পুদিনা এবং হলুদ হজমের প্রক্রিয়া উন্নত করে।
হাইড্রেশন: প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করা।

2. ব্যায়াম: নিয়মিত ব্যায়াম হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে এবং মানসিক চাপ কমায়।  নিয়মিত যোগব্যায়াম এবং মেডিটেশন স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে, যা আই বি এস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ: গভীর শ্বাসের মাধ্যমে মনকে শান্ত করা এবং শরীরের স্ট্রেস কমানো যায়।

3. মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ: যোগব্যায়াম, ধ্যান, এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক।

4. প্রোবায়োটিক গ্রহণ: অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া যেতে পারে।

৫. হার্বাল সাপ্লিমেন্ট:
পুদিনার তেল: এটি অন্ত্রের পেশি শিথিল করতে সহায়ক, যা আই বি এস-এর লক্ষণ কমাতে পারে।
আদা: বমি ভাব এবং পেট ব্যথা কমানোর জন্য আদা খুব কার্যকর।

আই বি এস কি  সংক্রামক রোগ?

না, ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম (IBS) একটি ইনফেকশিয়াস বা সংক্রামক রোগ নয়। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল (হজম-সংক্রান্ত) অবস্থা, যা পেটের ব্যথা, গ্যাস, ডায়রিয়া, কনস্টিপেশন বা এই দুটির মিশ্রণের মতো উপসর্গের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

আইবিএসের সঠিক কারণ এখনও সম্পূর্ণভাবে জানা যায়নি। তবে এটি খাদ্যাভ্যাস, স্ট্রেস, এবং অন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যকলাপে সমস্যা থেকে হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে সংক্রমণের পর এটি শুরু হতে পারে, কিন্তু এটি নিজেই সংক্রামক নয়।

উপসংহার:
আইবিএস একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হলেও এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তন, এবং যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে আইবিএসের উপসর্গগুলি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং আরোগ্য করা যায়। 




-- কাজী সাইফ উদদীন আহমেদ,
Lecturer, Federal Homoeopathic Medical College, Dhaka.


আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। 

>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন