আপনার শিশু ভয় পেলে করনীয়, ঘরোয়া ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা

শিশুদের ভয় পাওয়ার সমস্যা বিশেষ করে অল্প বয়সে স্বাভাবিক একটি ঘটনা। বয়স অনুযায়ী তাদের ভয় পাওয়ার কারণ ও ধরন পরিবর্তিত হয়। শিশুরা সাধারণত অন্ধকার, একা থাকা, অজানা জিনিস, জোরালো শব্দ, প্রাণী, বা হঠাৎ ঘটনার ফলে ভয় পেতে পারে। শিশু ভয় পেলে তাকে শান্ত করা এবং নিরাপত্তার অনুভূতি দেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ।
 
তবে দীর্ঘমেয়াদী এবং অতিরিক্ত ভয় শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এই বিষয়ে যত্নশীল হওয়া জরুরি। শিশুদের ভয় পাওয়ার সমস্যা ইসলামিক দৃষ্টিতে বোঝা এবং এর মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন উপায় রয়েছে। ইসলামে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য এবং তাদের ভয়ের মোকাবিলার জন্য শিক্ষা ও দোয়ার গুরুত্ব রয়েছে। এখানে ইসলামিক দৃষ্টিতে কিছু ঘরোয়া করণীয় এবং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সঙ্গে ইসলামী চিকিৎসার পরামর্শ দেওয়া হলো।



ইসলামিক দৃষ্টিতে করণীয়:

1. দোয়া এবং আযকার:
শিশুকে ভয়ের সময় শান্ত করতে দোয়া ও আযকার পাঠ করানো উচিত। সুরা ফাতিহা, সুরা আল-ইখলাস, আল-ফালাক এবং আন-নাস পড়া উচিত।

বিশেষ করে, "أعوذ بكلمات الله التامات من شر ما خلق" (আউঝু বিকালিমাতিল্লাহিত তাম্মাত মিন শার মা খালাক) পড়া যেতে পারে। এটি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে।

2. আল্লাহর উপর ভরসা:
শিশুকে শেখান যে আল্লাহ সর্বদা তাদের সঙ্গে আছেন এবং তিনি তাদের রক্ষা করেন। এটি তাদের মানসিক দৃঢ়তা বাড়াতে সাহায্য করবে। তাদের বোঝান যে ভয় একটি স্বাভাবিক অনুভূতি, কিন্তু আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে হবে।

শিশু ভয় পেলে ঘরোয়া করণীয়:

1. শিশুকে বোঝা:
প্রথমত, বুঝতে হবে শিশুর ভয়ের প্রকৃত কারণ কী। তাকে প্রশ্ন করতে পারেন: "কী তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে?", "তুমি এখন কেমন বোধ করছ?"।

শিশুর ভয়ের কথা অবহেলা না করে গুরুত্ব সহকারে শুনতে হবে এবং বোঝাতে হবে যে তার ভয়ের অনুভূতিগুলো স্বাভাবিক।

২. নিরাপত্তা দেওয়া: 
শিশুকে কাছে নিয়ে আদর করুন, তার সাথে কথা বলুন, এবং তাকে আশ্বস্ত করুন যে সে নিরাপদ।

৩. বিশ্রাম
পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন, কারণ ক্লান্তি শিশুদের মধ্যে ভয়ের অনুভূতি বাড়িয়ে দিতে পারে।

৪. শারীরিক স্পর্শ:
শিশুকে আলিঙ্গন করা, তার হাত ধরা, পিঠে হাত বুলানো—এসব স্পর্শ শিশুকে সান্ত্বনা দেয় এবং নিরাপত্তার অনুভূতি জাগায়।

৫. শান্ত পরিবেশ তৈরি:
জোরে কথা বলবেন না এবং শিশুর সামনে আতঙ্কিতভাবে প্রতিক্রিয়া করবেন না। শান্তভাবে পরিস্থিতি সামলানো উচিত। ঘরে মৃদু আলো রাখুন। অন্ধকারে ভয় পেলে শিশুর ঘরে ছোট নৈশ আলো জ্বালিয়ে রাখতে পারেন।

৬. খেলার মাধ্যমে ভয়ের মোকাবিলা:
শিশুদের ভয় কাটানোর জন্য খেলার মাধ্যমে কাজ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি শিশু কোনো নির্দিষ্ট প্রাণীকে ভয় পায়, তবে সেই প্রাণীর খেলনা বা কার্টুন দেখিয়ে ভয় কাটানোর চেষ্টা করতে পারেন।

৭. স্বাভাবিক করা:
শিশুকে বোঝাতে হবে যে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। অন্যরাও মাঝে মাঝে ভয় পায়। এতে শিশুর ভয় কমবে এবং তার মধ্যে সাহসের বিকাশ ঘটবে।  

৮.রাতে আলোর ব্যবহার: 
যদি শিশু রাতে ভয় পায়, তবে একটি ছোট নৈশ আলো (night light) ব্যবহার করতে পারেন, যা শিশুকে অন্ধকারে নিরাপত্তার অনুভূতি দেবে।

৯.গল্প শোনানো: 
মৃদু স্বরে গল্প শোনানো বা প্রিয় বই পড়া শিশুর মন শান্ত করতে পারে



হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা:
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিশুদের ভয়ের সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য প্রাকৃতিক এবং নিরাপদ একটি পদ্ধতি। এখানে কিছু নির্দিষ্ট হোমিওপ্যাথিক ওষুধ সম্পর্কে বিস্তারিত দেওয়া হলো:

1. Aconite:
হঠাৎ কোনো ঘটনায়, যেমন ভূমিকম্প, বাজ পড়া, বা কোনো দুর্ঘটনার কারণে শিশু আতঙ্কিত হলে এই ওষুধ কার্যকর। এটি মূলত অস্থিরতা, দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস, এবং হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলে ব্যবহার করা হয়।

2. Stramonium:
অন্ধকার বা একা থাকার ভয়ে শিশু যদি আতঙ্কিত হয়ে যায়, তখন এই ওষুধ প্রয়োগ করা হয়।
শিশু যদি ঘুমের মধ্যে ভয় পায় এবং চিৎকার করে জেগে ওঠে, তাহলে এই ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে।

3. Borax:
শিশু যদি হঠাৎ জোরালো শব্দে (যেমন বোমার আওয়াজ, বজ্রপাত, বা অন্যান্য উচ্চশব্দ) ভয় পায়, তাহলে Borax ব্যবহার করা হয়। 
বিশেষত, ভ্রমণ বা ভৌগোলিক পরিবর্তনের সময় এই ওষুধ কার্যকর হতে পারে।

4. Gelsemium:
কোনো বিশেষ পরিস্থিতি বা ঘটনার আগে যেমন পরীক্ষার সময় বা নতুন স্থানে যাওয়ার সময় ভয় বা উদ্বেগ থেকে দুর্বলতা অনুভব করলে এই ওষুধ উপকারী।
এতে শিশু ক্লান্ত এবং দুর্বল বোধ করতে পারে।

5. Pulsatilla:
সংবেদনশীল ও আবেগপ্রবণ শিশুর জন্য এটি কার্যকর। শিশুরা যদি বিশেষ করে মা বা কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে থাকতে চায় এবং তাদের সঙ্গ ছাড়া একা থাকতে ভয় পায়, তবে এটি দেওয়া যায়।

6. Kali Phos:
যখন শিশু মানসিক চাপে থাকে এবং ধীরে ধীরে ভয় থেকে অবসাদ বা উদ্বেগ দেখা দেয়, তখন Kali Phos ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করে এবং মানসিক উদ্বেগ হ্রাস করে।

পরামর্শ ও সতর্কতা:

1. শিশুর আচরণের পর্যবেক্ষণ:
শিশু কোন ধরনের পরিস্থিতিতে ভয় পাচ্ছে এবং তার মানসিক ও শারীরিক প্রতিক্রিয়া কী, তা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি।

2. পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও পুষ্টি:
শিশুর শরীর ও মনের সুস্থতার জন্য পর্যাপ্ত ঘুম এবং সুষম খাদ্য গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। ঘুমের অভাব বা অপুষ্টি শিশুর মানসিক চাপ এবং ভয়ের অনুভূতি বাড়িয়ে দিতে পারে।

3. মানসিক চিকিৎসা:
যদি শিশুর ভয় দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং হোমিওপ্যাথিক বা ঘরোয়া চিকিৎসায় উন্নতি না হয়, তবে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ বা মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

ভয়ের সমস্যাকে গুরুত্ব সহকারে মোকাবিলা করা উচিত, কারণ এটি শিশুর মানসিক এবং আবেগিক বিকাশে প্রভাব ফেলতে পারে।



-- কাজী সাইফ উদদীন আহমেদ,
Lecturer, Federal Homoeopathic Medical College, Dhaka.


আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। 
>Share by:

1 মন্তব্যসমূহ


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন