মোলার প্রেগন্যান্সি: সার্জারি ছাড়াই টিস্যু নির্গমন—একটি হোমিওপ্যাথিক কেস স্টাডি ও ক্যান্থারিসের বিস্ময়কর প্রয়োগ

সংগ্রহ :  
ডা. ওয়াই এ আরিফ এর কাছ থেকে।

এটাও কি #হোমিওপ্যাথিতে সম্ভব? #মোলার প্রেগন্যান্সির মোল বের করে সার্জারী ছাড়াই? আমি বিস্মিত!

গত আড়াই মাস যাবৎ রোগী প্রচন্ড পেট ব্যথা ও বমিতে কস্ট পাচ্ছে। ঘরে প্রস্রাব পরীক্ষা করে জানতে পেরেছে তার গর্ভধারণ হয়েছে। নতুন বিবাহিতা। আঠারো বছর বয়স। পেট ব্যথার ও বমির জন্য ফার্মেসী থেকে ওষুধ এনে খেয়েছে কিন্তু পেটব্যথা কমছে না। তাই চিকিৎসকের নিকট গেলে আল্ট্রাসনো করে জানতে পারা যায় রোগীর মোলার প্রেগন্যান্সির বা হইডিটিটিফরম মোল। যা কনসেপ্টে বাচ্চা গঠন না করে টিস্যুর অতিরিক্ত বৃদ্ধি বা টিউমারে পরিনত হয়েছে।

এখন আসি এই মোলার প্রেগন্যান্সি কি?

মোলার প্রেগন্যান্সি (Hydatidiform Mole) হলো একটি অস্বাভাবিক গর্ভধারণ, যেখানে স্বাভাবিক ভ্রূণ না গঠন হয়ে জরায়ুর ভেতর অস্বাভাবিক প্লাসেন্টাল টিস্যু বৃদ্ধি পায়। এটি Gestational Trophoblastic Disease (GTD)-এর অন্তর্গত এবং সঠিক চিকিৎসা না করলে invasive mole বা choriocarcinoma তে রূপ নিতে পারে। অর্থাৎ এটি এখন টিউমারে পরিনত হয়েছে যা পরবর্তীতে খুব দ্রুতই ক্যান্সারে রূপ নেবে যদি এটিকে অপসারণ করা না যায়। কারন এটি ইনভেসিভ বা ট্যিসু গভীরে প্রবেশ করছে।




গত ১৩ সেপ্টেম্বরের ২০২৫ আল্ট্রাসনো রিপোর্ট অনুযায়ী :

Patient’s Name: Mrs. Jannat
Age: 18 বছর
Date: ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

Uterus (জরায়ু)

জরায়ু কিছুটা বড় (11.1 × 7.38 সেমি)।
কোনো gestational sac (স্বাভাবিক গর্ভ থলি) দেখা যায়নি।
জরায়ুর ভেতরে অস্বাভাবিক প্লাসেন্টাল টিস্যু দেখা যাচ্ছে।
Color Doppler পরীক্ষায় অতিরিক্ত রক্ত চলাচল পাওয়া গেছে।
জরায়ুর দেয়ালের সামনের ও পেছনের অংশে টিস্যু ঢুকে গেছে (myometrial invasion)।

এগুলো molar pregnancy-র বৈশিষ্ট্য।

Impression (চূড়ান্ত মন্তব্য)

“Suggestive of molar pregnancy with myometrial invasion.”
মানে:

এটি স্বাভাবিক গর্ভ নয়, বরং molar pregnancy (অস্বাভাবিক টিস্যু বৃদ্ধি)।

টিস্যু শুধু জরায়ুর ভেতরে নয়, বরং জরায়ুর দেয়ালের ভেতরে ঢুকে পড়েছে → যাকে invasive mole বলা হয়।

এর মানে কী?

এটি একটি জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা।
সাধারণ মোলার প্রেগন্যান্সির তুলনায় invasive mole বেশি বিপজ্জনক, কারণ এটি রক্তপাত, সংক্রমণ এমনকি ক্যান্সারে (choriocarcinoma) রূপ নিতে পারে।

এই রিপোর্টে বলা হয়েছে যে রোগীর মোলার প্রেগন্যান্সি আছে এবং সেটি জরায়ুর দেয়ালে ঢুকে পড়েছে (invasive mole)। এটি স্বাভাবিক গর্ভধারণ নয়, বরং অস্বাভাবিক টিস্যু বৃদ্ধি। সঠিক চিকিৎসা ছাড়া এটি প্রাণঘাতী জটিলতা তৈরি করতে পারে।

রিপোর্ট দেখে আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম অপারেশনের জন্য এলোপ্যাথ চিকিৎসকের কাছে পাঠিয়ে দেবো। কেননা এটিকে বেড় করতে হবে। কনভেনশন চিকিৎসা অনুযায়ী  Uterine Evacuation করা হবে। যেক্ষেত্র Suction Evacuation (preferred) → suction & curettage দিয়ে পুরো টিস্যু বের করা হয়।

Sharp curettage যদি suction সম্ভব না হয়।

Oxytocics (oxytocin, ergometrine) → procedure শেষে bleeding control করতে।

Hysterectomy (জরায়ু কেটে ফেলা) বিবেচনা করা হয় যদি: বয়স বেশি হয় ও আর সন্তান চাই না, repeated mole হয়, heavy bleeding হয়।

Supportive Treatment

IV fluids (shock management যদি বেশি রক্তপাত হয়)।

Blood transfusion যদি severe anemia হয়।

আমি যখন তাকে রেফার্ড করতে যাবো তখন হঠাৎ আমার মন মস্তিষ্কে বরিকের ক্যান্থারিস আলোচনার ফিমেল সম্পর্কিত প্যাথলজী বর্ননায় একটি লাইনের কথা মনে পড়লো। যেখানে রয়েছে-

Boericke’s Materia Medica – Cantharis (Female):
“Expels moles, dead foetuses and membranes.”

অর্থাৎ  Cantharis এমন একটি ওষুধ, যা গর্ভাশয় থেকে mole (অস্বাভাবিক গর্ভজাত টিস্যু), মৃত ভ্রূণ অথবা retained placenta বের করতে সাহায্য করে।

আমি তখন সিদ্ধান্ত নিলাম বরিকের এই লাইন আমি পরীক্ষা করে দেখবো। তাই রোগী ও তার অভিভাবককে বল্লাম আমি দুটো ফাইল দিচ্ছি ওষুধ দিয়ে ওটাকে বের করার জন্য। আপনারা এসেছেন অপারেশন না করার জন্য কিন্তু এটা অপারেশনের কেস। (উল্লেখ্য রোগীর বাড়ি তুসখালী। ওখানে মৃতপ্রায়  একটি কিডনী রোগী সেরে যাওয়ায় ওখানকার রোগীদের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হওয়ায় এই রোগীটি এসেছে।) তো যদি ওষুধে বেড় না হয় তাহলে সার্জারিতে যেতে হবে। তিনদিন পর জানাবেন।

আমি 13 Sep 25  Cantharis 0/2 ১০০ মিলি ওয়াটারে মিশিয়ে ২ ঘন্টা পর পর ১ চামচ করে খেতে বল্লাম। রোগী আমাকে 19 Sep 2025 তারিখে কল দিয়ে জানালো ব্লিডিং একটু বেড়েছে। 
আমি বল্লাম প্রচন্ড ব্যথা না হওয়া পর্যন্ত ওষুধ চালিয়ে যাও। দুদিন পরই আমাকে জানালো রাতে প্রচন্ড ব্যথা সহ বড় পিন্ড বেড়িয়ে গেছে। আমি বল্লাম আলহামদুলিল্লাহ। ওষুধ চালিয়ে যাও সম্পূর্ণ ব্লিডিং বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত। কেননা জরায়ুর মধ্যে সরিষার দানার মত সামান্য থাকলেও ব্লিডিং বন্ধ হবে না। তাকে পুনরায় আলট্রাসনো করতে বল্লাম। ২৫ সেপ্টেম্বরের রিপোর্ট অনুযায়ী -

USG Lower Abdomen Report (25 Sept 2025)

Uterus (জরায়ু)

Bulky size: 8.2 × 4.9 সেমি (অর্থাৎ কিছুটা বড়)।

Myometrium: homogeneous (মানে muscle wall স্বাভাবিক, কোনো অস্বাভাবিক টিস্যু নেই)।

Endometrium thickness: 8.8 মিমি (এখনও কিছুটা মোটা)।

Mixed echogenic area: প্রায় 13.5 cc ভলিউম, endometrial cavity-তে।

এর মানে জরায়ুর ভেতরে এখনও কিছু retained tissue আছে (placenta বা conception product-এর অংশবিশেষ)।

Cul-de-sac (জরায়ুর পেছনের ফাঁকা জায়গা)

কোনো fluid জমে নেই।
অর্থাৎ কোনো বড় জটিলতা নেই।

Impression (Final Comment):

 “Retained products of conception.”

মানে: গর্ভপাত/অস্বাভাবিক গর্ভস্রাবের পর কিছু টিস্যু এখনও জরায়ুর ভেতরে রয়ে গেছে। 

মূল mole (প্রথম রিপোর্টে ছিল) বের হয়ে গেছে।

তবে এখনও কিছু placenta/ membrane থেকে গেছে → incomplete expulsion।

২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ এর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে রোগীর molar pregnancy নেই, কিন্তু জরায়ুতে এখনও কিছু retained placenta / conception product রয়ে গেছে। এ অবস্থায় রোগী অনেকটাই নিরাপদ, তবে টিস্যু সম্পূর্ণ বের না হওয়া পর্যন্ত রোগী পুরোপুরি নিরাপদ নয়।

তাই রোগীকে আমি পুনরায় সেই ঔষধ cantharis 0/2 পূর্বোক্ত নিয়মে দিয়ে বল্লাম এখন অনেকটাই দুশ্চিন্তামুক্ত। ইনশাআল্লাহ বাকি যতটুকু আছে তা বেড়িয়ে যাবে। রোগী এখনো চিকিৎসায় রয়েছে। 

হোমিওপ্যাথির এমন আশ্চর্য ক্রিয়া দেখে বিষ্মিত হলাম যে এটা কি করে সম্ভব তা গবেষণার দাবীদার রাখে। ধন্যবাদ। সমস্ত রিপোর্টগুলো যোগ করলাম।

এই লেখাটি থেকে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা লাভ করতে পারিলাম -

 শিক্ষা সমূহ

1. রোগ নির্ণয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
– আল্ট্রাসনো ও রিপোর্ট ছাড়া সঠিকভাবে বোঝা সম্ভব নয় রোগ আসলে কী।
– Molar pregnancy ও Invasive mole জীবনহানিকর হতে পারে, তাই সময়মতো ডায়াগনোসিস জরুরি।

2. কনভেনশনাল চিকিৎসা ও হোমিওপ্যাথি – উভয়ের গুরুত্ব আছে। 
– প্রচলিত চিকিৎসায় সার্জারি বা suction evacuation হলো স্বীকৃত চিকিৎসা।
– তবে হোমিওপ্যাথিতে Cantharis-এর মতো ওষুধ আশ্চর্যজনক ফল দেখাতে পারে।
– রোগীকে সবসময় জানাতে হবে ঝুঁকি ও বিকল্প চিকিৎসার দিকগুলো।


3. হোমিওপ্যাথি গবেষণার ক্ষেত্র।
– Boericke’s Materia Medica-র “Expels moles…” লাইনটি এখানে বাস্তবে কার্যকর হয়েছে।
– এধরনের কেস চিকিৎসাবিজ্ঞানে গবেষণা দাবি করে, যাতে বোঝা যায় কীভাবে হোমিওপ্যাথি কাজ করছে।


4. চিকিৎসকের দায়িত্বশীলতা
– চিকিৎসক অপারেশনে রেফার করার সিদ্ধান্তও ভেবেছিলেন—যা তার দায়িত্বশীলতার প্রমাণ।
– রোগীর জীবন বাঁচানোই চিকিৎসকের প্রথম কর্তব্য।

5. রোগীর ফলো-আপ অপরিহার্য
– প্রথম টিস্যু বের হলেও পরের রিপোর্টে retained tissue দেখা গেছে।
– এর মানে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া, মনিটরিং করা, এবং নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত রোগীকে পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি।

সারসংক্ষেপ শিক্ষা:

“হোমিওপ্যাথি মাঝে মাঝে আশ্চর্যজনক ফল দেখাতে পারে, তবে রোগ নির্ণয়, ঝুঁকি মূল্যায়ন, রোগীকে সচেতন করা, এবং ফলো-আপ করাই চিকিৎসার মূলনীতি। 
গবেষণা ও দায়িত্বশীলতা ছাড়া কোনো চিকিৎসাই নিরাপদ নয়।”


-- সংগ্রহকারী : 
কাজী সাইফ উদদীন আহমেদ 
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক 
>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন