ঠিকানা : ৭০ নং শোভাবাজার স্ট্রীট,
রবীন্দ্রমোহন রায়চৌধুরীর স্ত্রী বয়স ২৫ বৎসর।
বর্তমান উপসর্গ : রোগীনি হৃদকম্প রোগে ভুগিতেছিল। একদিন নাড়ীর গতি মিনিটে ১৬০ পর্যন্ত উঠিল।
এলোপ্যাথি চিকিৎসা :
এলোপ্যাথি ডাক্তার ব্রজবল্লভ সাহা চিকিৎসা করিতেছিলেন, পরামর্শের জন্য এলোপ্যাথি ডাক্তার নীলরতন সরকারকে ডাকিলেন। তিনি রোগিণীকে দেখিয়া বলিলেন- রোগিণীর জীবনের আশা নাই।
রোগিণীর শ্বশুর মধুপুর যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। ডাক্তার সরকার তাঁহাকে যাইতে নিষেধ করিলেন। সারাদিন ব্রজবল্লভ বাবু ডাক্তার সরকারের পরামর্শ মত চিকিৎসা করিয়া ফল হইল না দেখিয়া রাত্র ৯টার সময় সকলের মতে হোমিওপ্যাথী চিকিৎসার জন্য আমাকে ( ডাক্তার প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার ) ডাকিলেন।
হোমিওপ্যাথীক চিকিৎসা :
আমি তাহাকে জলের সঙ্গে নলিনল Q ( Crataegus Q ) ১০ ফোটা করিয়া ঘন্টায় ঘন্টায় খাইতে দিলাম।
নলিনল Q ( Crataegus Q ) তিন মাত্রা দেওয়ার পর নাড়ীর গতি মিনিটে ১২০ বার হইল। ২ ঘণ্টা পর আরও একমাত্রা দেওয়ার পর রোগিণী ঘুমাইয়া পড়িল।
শ্বাসকষ্ট কমিল।
নাড়ীর গতি পর দিন প্রাতে ৯০তে নামিল।
অদ্য চতুর্থ দিন।
রোগিণী অত্যন্ত দুর্বল বোধ করিতে লাগিল।
হঠাৎ অত্যন্ত ঘাম দিয়া নাড়ীর গতি ৮২ হইল।
একমাত্রা কার্বোভেজ ২০০ খাইতে দিয়া দুধ বার্লি খাইতে দিলাম।
একটানা ৪ ঘণ্টা ঘুমাইল ঘুম ভাঙ্গিবার পর একমাত্রা নলিনল Q ( Crataegus Q ) খাইতে দিয়া দশ মিনিট পর প্রচুর পরিমাণে বেদানার রস খাইতে দিয়া তাহার এক ঘণ্টা পর দুধ বার্লি খাইতে দিলাম।
শুধু দুধ খাইলে পেটে বায়ু হয়। এই রোগিণীর পেটে বায়ু জন্মিলে বিশেষ অনিষ্ট হইবে। হৃৎপিণ্ডের গতি পুনরায় বাড়িয়া উঠিতে পারে এজন্য শুধু দুধ দিলাম না।
সমস্ত ঔষধ বন্ধ রাখিলাম।
সম্পূর্ণ বিশ্রাম এবং নিয়মমত পথ্য দিতে রোগিণী সুস্থ হইল।
নলিনল Q ( Crataegus Q ) ১০ ফোটা মাত্রায় প্রাতে এবং সন্ধ্যায় এক সপ্তাহ খাইতে দিলাম।
হোমিওপ্যাথীক চিকিৎসায় রোগিণী সম্পূর্ণ সুস্থ হইল।
ডাক্তার প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার পরিচিতি :
ডাক্তার প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার ( ১৮৫১ - ১৯২২) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম দিককার বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাশাস্ত্রের একজন পথিকৃৎ। তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাকে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত এবং গ্রহণযোগ্য করে তোলার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন।
রোগীলিপি এনালাইসিস
উক্ত কেসটি একজন গুরুতর হৃদরোগীর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার সফল উদাহরণ। এখানে ডা. প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার তার অভিজ্ঞতা ও বিশুদ্ধ হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে রোগীকে সঠিকভাবে সুস্থ করেছেন।
নিচে এই কেসের চিকিৎসার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হলো:
রোগের বর্ণনা
রোগিণীর হৃদস্পন্দন (পালস রেট) মিনিটে ১৬০ পর্যন্ত উঠেছিল, যা ট্যাকিকার্ডিয়ার একটি চরম রূপ। এর পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট এবং দুর্বলতা ছিল। রোগী অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল অবস্থায় ছিলেন, এবং আলোপ্যাথি চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছিলেন না।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধসমূহ এবং তাদের ভূমিকা :-
1. নলিনল (Crataegus):
প্রথম ওষুধ হিসেবে প্রয়োগ: ক্রেটেগাস কার্ডিয়াক টনিক হিসেবে কাজ করে। এটি হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং ধমনীগুলোতে রক্তপ্রবাহ উন্নত করে।
প্রাথমিক ফলাফল:
প্রথম তিন মাত্রায় হৃদস্পন্দনের হার ১২০-তে নেমে আসে।
ঘুম এবং শ্বাসকষ্টের উন্নতি হয়।
চতুর্থ দিন, একমাত্রা Crataegus দেওয়ার পর নাড়ীর গতি ৮২ হয়ে স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে।
দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার: এক সপ্তাহ সকাল-বিকালে দেওয়া হয় যাতে হৃৎপিণ্ড পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে।
2. কার্বোভেজ (Carbo veg):
অত্যন্ত দুর্বলতার চিকিৎসায়: চতুর্থ দিনে রোগিণী যখন প্রচুর ঘামছিলেন এবং খুব দুর্বল অনুভব করছিলেন, তখন Carbo veg ২০০ পোটেন্সি ব্যবহার করা হয়। এটি রোগীর সার্বিক শক্তি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে।
গ্যাসট্রিক সমস্যা প্রতিরোধ: রোগীর পেটে বায়ু জমলে তা হৃদযন্ত্রের ওপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারত। Carbo veg এই অবস্থা প্রতিরোধে সহায়ক।
পথ্য এবং চিকিৎসার দিকনির্দেশনা
1. পথ্যের ভূমিকা:
শুধুমাত্র দুধ না দিয়ে দুধের সঙ্গে বার্লি মিশিয়ে দেওয়া হয়। দুধ একা খাওয়ার কারণে বায়ু হওয়ার প্রবণতা থাকায়, হালকা এবং সহজপাচ্য পথ্য দেওয়া হয়েছে।
পরে বেদানার রস দেওয়া হয় যা হৃৎপিণ্ডের জন্য পুষ্টিকর এবং সহজে হজমযোগ্য।
2. সম্পূর্ণ বিশ্রাম:
রোগিণীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখা হয়। হৃৎপিণ্ডের অতিরিক্ত চাপ এড়ানোর জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
3. সকল ঔষধ বন্ধ রাখা:
একবার রোগিণীর অবস্থা স্থিতিশীল হয়ে গেলে, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বন্ধ রাখা হয় যাতে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না হয়।
চিকিৎসার কার্যকারিতা এবং ফলাফল
1. শারীরিক উন্নতি:
হৃদস্পন্দনের হার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসে।
শ্বাসকষ্ট এবং ঘুমের সমস্যা পুরোপুরি সেরে যায়।
2. মানসিক স্বস্তি:
রোগী এবং পরিবারের মধ্যে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার প্রতি বিশ্বাস সৃষ্টি হয়।
3. স্থায়ী সমাধান:
রোগিণী এক সপ্তাহে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং আর কোনো পুনরাবৃত্তি হয়নি।
এই কেস থেকে শিক্ষা
ক্রিটিক্যাল অবস্থায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা: সঠিক ওষুধ এবং পথ্যের সাহায্যে ক্রিটিক্যাল রোগীকেও সুস্থ করা সম্ভব।
ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসা পদ্ধতি: রোগীর শরীর, পুষ্টি এবং জীবনযাত্রার অবস্থা বিবেচনা করে চিকিৎসা দিলে তা আরও কার্যকর হয়।
দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ: চিকিৎসক সময়মতো সঠিক ওষুধ প্রয়োগ করেছেন, যা রোগীর জীবন রক্ষায় মূল ভূমিকা পালন করে।
উপসংহারে, এই কেসটি হোমিওপ্যাথির শক্তি এবং কার্যকারিতা প্রমাণ করে।
Crataegus এবং Carbo veg-এর সঠিক প্রয়োগ এবং পথ্য ব্যবস্থাপনা রোগিণীর জীবন বাঁচানোর একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
রোগীলিপি এনালাইসিস করেছেন :
-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি,
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা
প্রভাষক,
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ।
আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ।
>Share by:
Make a comments as guest/by name or from your facebook:
Thank sir
উত্তরমুছুনপাশে থেকে অনুপ্রানিত করার জন্য ধন্যবাদ
মুছুনMake a comment by facebook: