১০৩নং শোভাবাজার স্ট্রীট-
নাম : হরিপ্রসন্ন রায় চৌধুরী
বর্তমান সমস্যা :
মূত্রনলীতে ছিদ্র হইয়া কষ্টভোগ করিতেছেন। ইহার মূল কারণ-গনোরিয়া বা প্রমেহ রোগ।প্রমেহ রোগে, মূত্রনালীর (ইউরেথ্রার) ভিতর ঘা হইয়া স্ট্রিকচার হয়, অর্থাৎ ঘা জুড়িয়া যায়।প্রস্রাব বন্ধ হইয়া যায়।রবার ক্যাথিটর দিয়া প্রস্রাব করাইবার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় সিলভর ক্যাথিটার দিয়া প্রস্রাব করান হয়।প্রত্যহ এইভাবেই প্রস্রাব করান হইতে থাকে।মূত্রনলীর ঘা আরোগ্য না হইয়া রহিয়া গেল।ক্রমে ঘা বাড়িয়া নলীর নীচ দিকে ছিদ্র হইয়া যায়।মূত্র বাহির হওয়ার সময় নীচের ছিদ্র দিয়া ফোটা ফোটা মূত্র বাহির হইয়া জমিয়া ছোট বলের মত হয়।অপারেশনের ব্যবস্থা করা হয়।
পরামর্শের জন্য আমাকে ( ডাঃ শ্রীবরদাচরণ চক্রবর্তী ) ও ডাক্তার এ, কে, নাগকে ডাকা হইল।
ডাক্তার নাগ এল, এম, এস (এলোপ্যাথী) পাশ করিয়া হোমিওপ্যাথী শিখিবার জন্য আমেরিকা গিয়া এম, ডি হইয়া আসেন। তিনি হোমিওপ্যাথী চিকিৎসা করিতেছিলেন। একদা এক রোগীর চিকিৎসার জন্য ডাক্তার নাগ গুরুদেব প্রতাপ মজুমদার মহাশয়কে পরামর্শের জন্য ডাকেন।
রক্তামাশয় কঠিন ভাবের (ব্যাসিলারী ডিসেন্টরী) ছিল। ডাক্তার নাগের একান্ত ইচ্ছা ২/১টা এমেটিন ইনজেকশন দেওয়া। তিনি গুরুদেবকে বলিলেন, ২/১টা এমেটিন ইনজেকশন দিতে আপত্তি কি?
হোমিওপ্যাথ ডাক্তারগণ যদি এলোপ্যাথীর ভাল জিনিষ নেয় এবং এলোপ্যাথগণ হোমিওপ্যাথীর ভাল জিনিষ নেয়, তবে চিকিৎসা ভাল হয় না কি?
নোট : গুরুদেব বলিয়াছিলেন-"সুশীল। জানিয়া রাখ, ঠিকমত হোমিওপ্যাথী চিকিৎসা হইলে এলোপ্যাথী চিকিৎসা তাহার কাছে দাঁড়াইতে পারে না।
বিলাতী ভাব মাথা হইতে দূর করিয়া ভালভাবে হোমিওপ্যাথী চিকিৎসায় মন দাও। তোমাদের মত প্রতিভাবান ছেলেই হোমিওপ্যাথীর দরকার। এই রোগীকে তুমি এমেটিন ইনজেকশন দিতে ইচ্ছা করিয়াছ। বরদা! এই রোগীকে একমাত্রা এলোজ ২০০ দিয়া দেখাইয়া দাও যে, এই রোগী ইপিকাকের রোগী নয়।" (এমেটিন-ইপিকাকেরই সার)।
গুরুদেবের (প্রতাপ মজুমদার) আদেশমত তাহার গাড়ীর বাক্স হইতে একমাত্রা এলোজ ২০০ দিলাম। তখন বেলা ৯টা।
বিকাল বেলা ৩টার সময় গিয়া দেখিলাম- রোগী বেলা ২টার সময় ঘুমাইয়া পড়িয়াছে।
রাত্র ৯টার সময় গিয়া দেখিলাম বেলা ৫টার সময় ঘুম ভাঙ্গিয়াছে।পেটের যন্ত্রণা নাই।আমরক্ত বাহ্য অনেক কমিয়া গিয়াছে।জলবার্লি পথ্য দেওয়া হইয়াছে।
একবার বাহ্য হইয়াছে,রক্ত নাই।আমমিশ্রিত মল বাহ্য হইয়াছে।
পরদিন প্রাতে গিয়া দেখি রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ আছে। গুরুদেব ও ডাক্তার নাগকে জানাইলাম। ঔষধ বন্ধ রহিল। একমাত্রা ঔষধেই রোগী সম্পূর্ণ আরোগ্য হইল।
এই রোগীর চিকিৎসার সময়ই গুরুদেব আমাকে নিম্নলিখিত উপদেশ দিয়াছিলেন-
নোট :
এখনও হোমিওপ্যাথী শিক্ষা করিবার জন্য এলোপ্যাথী নিয়মে সমস্ত জানা দরকার হয়--খুব ভাল করিয়া হোমিওপ্যাথী মেটেরিয়া মেডিকাও পড়িবে- তবে ভবিষ্যতে উন্নতি করিবে। আজ পর্যন্ত এলোপ্যাথ ডাক্তারগণই হোমিওপ্যাথ হইয়া উন্নতি করিয়াছে। হোমিওপ্যাথ ডাক্তার এলোপ্যাথ হয় নাই।"
আজ হরিপ্রসন্ন বাবুর চিকিৎসায় রোগীর মতেই ডাক্তার এ, কে, নাগকে ডাকা হইল। ডাক্তার নাগের মতে আজই অপারেশন হওয়া দরকার- অপারেশন করিয়া মূত্রনালীর নীচের ছিদ্র সেলাই করিয়া দিলে সারিয়া যাইবে।
মূত্র জমিয়া সেপ্টিক হইলে বিপদ ঘটিবে।
আমি বলিলাম, এখন রোগীর ৪০ বৎসর বয়স। ডাক্তার নাগ কি বলিতে পারেন রোগীর কখনও উত্তেজনা আসিবে না এবং উত্তেজনা হইলে এই সেলাই টিকিবে। সেলাই করিলেই মূত্রনালীর এই সেলাই এর জায়গা সরু হইবে এবং সেলাই ছিড়িয়া গেলে পুনরায় সেলাই করিলে তখন অবস্থা কিরূপ দাড়াইবে?
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ২৪ ঘণ্টা সময় দিলে অর্থাৎ আগামী কাল অপারেশন হইলে ক্ষতি হইবে কি?
যত শীঘ্র হয় ততই ভাল বলিয়া মত দিয়া যাইবার জন্য উঠিলেন। আমি কি ঔষধ দিব জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি বলিলেন যাহা ভাল বুঝেন দিন, এই বলিয়া ফি-এর টাকা লইয়া চলিয়া গেলেন।
আমার সমস্ত কথা শুনিয়া রোগীর বড় ভাই-জি, পি, রায় ব্যারিষ্টার সাহেব বলিলেন আজ আপনি ঔষধ দিন, উপকার না হইলে আগামী কল্য যাহা হয় করা যাইবে।
আমি গুরুদেবকে (প্রতাপ মজুমদার) স্মরণ করিয়া এপিস ২০০ ৪ ঘণ্টা অন্তর ২মাত্রা দিলাম।
বিকালে ৪টার সময় আমাকে ডাকিলেন, আমি গিয়া দেখি বলটা ফাটিয়া সমস্ত প্রস্রাব বাহির হইয়া গিয়াছে। প্রস্রাব করিবার সময় রবার ক্যাথিটার দিয়া প্রস্রাব করিতে বলিলাম। খাওয়ার ঔষধ বন্ধ রাখিলাম।
সিনোবিন তেল দিয়া তুলা ভিজাইয়া গুটি করিয়া বাঁধিয়া দিতে লাগিলাম। প্রস্রাবের পরই বাঁধন খুলিয়া নূতন করিয়া বাঁধিয়া দিতাম।
তিনদিন পর হইতে প্রত্যহ প্রাতে ও সন্ধ্যায় দিনে ২বার সাইলিসিয়া ৩০ খাইতে দিলাম।
৭দিন দিয়া ৩দিন বন্ধ রাখিয়া সাইলিসিয়া ২০০ একমাত্র দিলাম। তুলার গুটি ক্রমেই কম ভিজিতে লাগিল।
সাতদিন পর আরও একমাত্রা সাইলিসিয়া ২০০ দিলাম।
তুলার গুটি আরও কম ভিজিতেছে দেখিয়া ১ মাত্রা সাইলিসিয়া সি এম (লক্ষশক্তি) দিলাম।
তুলার গুটি আর ভিজে নাই দেখিয়া ব্যাণ্ডেজ বন্ধ করিলাম।
সরলভাবে প্রস্রাব হইতে লাগিল। ঔষধ বন্ধ রাখিলাম। রোগও সারিয়া গেল।
গভীরভাবে হোমিওপ্যাথিক দৃষ্টিকোণ
থেকে আলোচনা :
উপরের দেওয়া ঘটনাটি হোমিওপ্যাথির একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এবং অনুপ্রেরণামূলক দৃষ্টান্ত।
এটি থেকে বিভিন্ন স্তরে বিশ্লেষণ এবং শিক্ষার সুযোগ পাওয়া যায়।
এখানে আমি ঘটনাটি হোমিওপ্যাথিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করছি:
১. রোগের বিশ্লেষণ:
মূল রোগ: রোগীর মূত্রনালীতে গনোরিয়ার কারণে সৃষ্ট আলসার ও স্ট্রিকচার।
জটিলতা: নীচের দিকে ছিদ্র সৃষ্টি এবং অপারেশনের প্রয়োজনীয়তা।
উপসর্গ: প্রস্রাবের বাধা, ফিস্টুলাস ছিদ্র থেকে প্রস্রাব বের হওয়া, যন্ত্রণা এবং সেপসিসের ঝুঁকি।
২. হোমিওপ্যাথিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ:
ডাক্তার এ. কে. নাগ অপারেশনের প্রস্তাব দিলেও হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতিতে রোগের গভীর কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু করা হয়। অপারেশন স্থগিত রেখে সময় চাওয়া এবং রোগীর অভ্যন্তরীণ জীবনশক্তিকে উদ্দীপিত করার পরিকল্পনা করা হয়।
প্রথম ধাপ:
ঔষধ: এপিস ২০০
এপিস মেলিফিকা প্রদাহ, ফোলা, এবং সেরোসাল স্তরে তরল জমার ক্ষেত্রে কার্যকর। প্রথমে এটি ব্যবহার করা হয় স্থানীয় প্রদাহ কমানোর জন্য।
ফলাফল: প্রদাহ প্রশমিত হয়, ফিস্টুলাস ছিদ্র থেকে প্রস্রাব বেরিয়ে যায় এবং তা আরও বড় সমস্যাকে প্রতিরোধ করে।
দ্বিতীয় ধাপ:
ঔষধ: সাইলিসিয়া ৩০, ২০০, এবং সি.এম.
সাইলিসিয়া ক্রনিক ফিস্টুলাস অবস্থা এবং পুঁজের নিঃসরণ বন্ধে কার্যকর। এটি গভীর স্তরে কাজ করে পুঁজ নিষ্কাশন সম্পূর্ণ করে এবং ক্ষত পূরণে সহায়তা করে।
৩. চিকিৎসার সাফল্যের কারণ:
রোগীর ভাইটাল ফোর্স: হোমিওপ্যাথিক ঔষধ রোগীর আত্মশক্তিকে উদ্দীপিত করে প্রকৃত আরোগ্য নিয়ে আসে।
ধৈর্য ও পর্যবেক্ষণ: চিকিৎসক পর্যায়ক্রমে শক্তি ও মাত্রা পরিবর্তন করেছেন, যা সঠিক নির্ণয় ও চিকিৎসার প্রতি তাঁর অঙ্গীকার প্রকাশ করে।
অপারেশনের বিকল্প খোঁজা: গুরুতর অপারেশনের ঝুঁকি বাদ দিয়ে রোগীকে একটি নিরাপদ এবং স্থায়ী সমাধান দেওয়া হয়েছে।
৪. গুরুদেব প্রতাপ মজুমদারের শিক্ষা:
নির্ভরতা: হোমিওপ্যাথির প্রতি অগাধ বিশ্বাস এবং এর গভীর জ্ঞান অর্জনের উপর জোর।
ঔষধের সুনির্বাচন: সঠিকভাবে প্রমাণিত ঔষধের প্রয়োগ এবং এলোপ্যাথির পরিবর্তে হোমিওপ্যাথি অনুসরণ।
শিক্ষার গুরুত্ব: হোমিওপ্যাথি শিক্ষায় গভীর মনোযোগ এবং মেটেরিয়া মেডিকার গভীর অধ্যয়ন করা।
৫. শিক্ষা এবং ভবিষ্যৎ নির্দেশনা:
হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা: সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে এলোপ্যাথির জটিলতা ছাড়াই রোগ নিরাময় সম্ভব।
চিকিৎসকের দৃঢ়তা: রোগী এবং পরিবারকে বোঝানোর ক্ষমতা এবং সঠিক পথে পরিচালনা করা।
অভিজ্ঞতার গুরুত্ব: গুরুদেবের নির্দেশনা এবং নিজস্ব অভিজ্ঞতা চিকিৎসায় সাফল্যের ভিত্তি।
উপসংহার:
এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, হোমিওপ্যাথি গভীরভাবে মানব দেহের ভাইটাল ফোর্স এবং রোগের মূল কারণকে লক্ষ্য করে কাজ করে।অপারেশনের পরিবর্তে প্রাকৃতিক উপায়ে আরোগ্য আনা সম্ভব, তা প্রথমে অবশ্যই চেষ্টা করা দরকার । প্রতিটি অপারেশনেই মানব জীবনের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায় যাহা কখনো সংশোধন করা যায় না।এটি রোগী, চিকিৎসক, এবং সমগ্র চিকিৎসাবিদ্যার জন্য একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।
-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি,
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা
প্রভাষক,
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ।
আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ।
>Share by:
Make a comments as guest/by name or from your facebook:
Make a comment by facebook: