একজন বোবা-কালা (কানে শুনে না, বলতেও পারে না। ) শিশুর রোগীলিপি এনালাইসিস।


একজন বোবা কানা শিশু। 

নাম : মিনা বেগম। মেয়ে শিশু। 
শিশুটির বয়স ৪ বছর। 
রক্তের গ্রুপ : বি পজেটিভ। 

দেখতে কেমন :
ফর্সা সুশ্রী চেহারা। 
বয়সের তুলনায় দেহের গড়ন একটু বাড়বাড়ন্ত।

বর্তমান শারীরিক সমস্যা ;
কানে শুনতে পায় না, কথাও বলতে পারে না। মুখে একরকম বোঁ বোঁ আওয়াজ করে। বুদ্ধিমতী। নিজের মনের ভাব বোঁ বোঁ আওয়াজ করে এবং আকারে ইঙ্গিতে প্রকাশ করে। 
কানে শুনতে পায় না কিন্তু টেলিফোনের আওয়াজ বুঝতে পারে। টেলিফোন এলে উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং মা বাবাকে টেনে টেলিফোনের কাছে নিয়ে যায়। 

কানের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখানো হয়। সামান্য ক্রিয়াগত বিশৃঙ্খলা ছাড়া বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি। যান্ত্রিক ক্ষতি কিছু পাওয়া যায়নি। কানের একটি যন্ত্রও ব্যবস্থা করা হয়, কিন্তু তাতে কোন কাজ হয় না।

মানসিক : 
অত্যন্ত এক গুঁয়ে, প্রচন্ড রাগ। যা চাইবে তা দিতে হবে। না দিলে সাতদিনেও তা ভোলে না। 

সর্ব দৈহিক অবস্থা :

ভয় : ভয়ডর বলে কিছু নেই। কুকুর বেড়াল দেখলে লাঠি নিয়ে তাড়া করে এবং বেদম পেটাতে থাকে। 
কিন্তু রাত্রে একা শুতে ভয় পায়, 
অন্ধকারে ভয় পায়, 
টিকটিকিকে ভয় পায়। 

ঘুম : কুকুর কুন্ডলী হয়ে শোয় বা ঘুমায়। 

পছন্দ ও অপছন্দ : 
প্রচন্ড পছন্দ ও অপছন্দ। কিছু কিছু লোককে দেখলেই রেগে যায় এবং মাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ওকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে। আবার যাকে পছন্দ তার কাছে ঘুর ঘুর করে। কখনও তাকে ঘিরে ঘুরতে থাকে। 
'পোশাক পরিচ্ছদ সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন। ভাল জামাকাপড় পরতে পছন্দ করে। 
লজ্জাবোধ অত্যন্ত বেশী। 

গোসল : গোসল করে বাথরুম থেকে ভাল করে পোশাক না পরে বের হয় না। 
স্নান করতে ভালবাসে। 

নাচগান : কানে শুনতে পায় না, কিন্তু T. V. -তে নাচগান হওয়ায় সময় আগ্রহ সহকারে দেখে ও তালে তালে নাচতে থাকে। 

খাবার: নানারকম মুখরোচক খাবার, নোন্তাজাতীয় খাবার, চিপস্ পছন্দ করে, মিষ্ট দ্রব্য পছন্দ করে। মাংস পছন্দ করে। নোংরা কিছু সহ্য করতে পারে না। 

জন্মদাগ(Birthmark) : পায়ে একটা জড়ুল আছে।





 

মায়ের গর্ভকালীন ইতিহাস : 
অনেক চিকিৎসার পর বিয়ের ১১ বছর পর ৩৩ বছর বয়সে এই মেয়েটি হয়েছে।

জন্মগত ইতিহাস : 
শিশুটি মায়ের সিজারিয়ান অপারেশন এর মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করে। 
শিশুটির "বার্থ ডেলিভারি সার্টিফিকেটটি" পাওয়া যায়নি। তবে পায়ে একটা জন্মদাগ (Birthmark) বা জড়ুল দেখা গেছে। 

টিকার ইতিহাস : 
সকল প্রকার সরকারি টিকা বয়স অনুযায়ী দেওয়া হয়। 

জন্মের পরবর্তী ইতিহাস :
প্রথম থেকেই সর্দিকাশি, টনসিল প্রদাহে ভুগছে। ডিপথেরিয়া হয়েছিল। খাট থেকে পড়ে গিয়ে  এবং খেলাধুলা করতে গিয়ে শারীরিক আঘাত পায়। 
সকল রোগের সময় এলোপ্যাথিক চিকিৎসা নেওয়া হয়। 

বাবা মায়ের ইতিহাস :
মা ও বাবা দুজনেই উচ্চশিক্ষিত। স্কুলে শিক্ষকতা কার্যে নিযুক্ত। 

মা : ফর্সা, একটু মেদ বহুল। পায়ের হাড়ে অস্থিক্ষয় আছে, ২ বার অস্তেপচার করা হয়েছে। অনেক চিকিৎসার পর বিয়ের ১১ বছর পর ৩৩ বছর বয়সে এই মেয়েটি হয়েছে।

বাবা : বাবার ও কোমরে ও পায়ে অস্টিও পোরোসিস আছে। উরুর হাড়ে অস্ত্রোপচার করে স্টিলের পাত লাগানো আছে। ছেলেবেলায় হাঁপানি ছিল, এখন ঠিক হয়ে গেছে।

বংশগত ইতিহাস : 
বংশে বাত, হাঁপানি, মানসিক রোগ ও একাধিক আত্মহত্যার ঘটনা আছে।

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা :
Rx, হাইপারিকাম (Hyparicum) 0/2 ৯ দিন ৯ সকাল ৯ মাএা দেওয়া হয়। 

১৫ দিন পর, 
শারীরিক ও মানসিক কার্যক্রম বেড়ে গেছে। 
ওকে কার্সিনোসিন (Carcinocin) ০/২,  ০/৩,  ০/৪ শক্তি ক্রমান্বয়ে হোমিওপ্যাথিক নিয়ম অনুযায়ী সেবন করতে দেওয়া হয়। 

১ বছরের মধ্যে ও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়। স্কুলে ভর্তি হয়েছে এবং খুব ভাল ফল করছে। 


হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিশ্লেষণ

১. প্রথম ধাপ:

হাইপারিকাম (Hypericum)

এটি স্নায়ুতন্ত্রের আঘাত এবং ক্রিয়াগত বিকলতায় ব্যবহৃত হয়।

শিশুটির খাট থেকে পড়ার ইতিহাস এবং অন্যান্য শারীরিক আঘাতের জন্য এটি একটি সঠিক ওষুধ ছিল।

এটি স্নায়ু পুনরুদ্ধার এবং সংবেদনশীলতার উন্নতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।


২. দ্বিতীয় ধাপ:

কার্সিনোসিন (Carcinosin)

শিশুটির মানসিক বৈশিষ্ট্য (একগুঁয়েমি, রাগ, ভয়) এবং বংশগত রোগপ্রবণতার জন্য এটি নির্বাচন করা হয়েছে।

এই ওষুধটি শিশুটির স্নায়ুবৈকল্যের গভীর স্তরে কাজ করেছে।

কার্সিনোসিন সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ এবং জিনগত দুর্বলতার সমাধানে কার্যকর।

শিশুটি মানসিক চাপ এবং বংশগত দুর্বলতার কারণে স্থবিরতায় ভুগছিল, যা এই ওষুধের মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।


৩. ধৈর্যপূর্ণ চিকিৎসা এবং পর্যবেক্ষণ:

ওষুধের বিভিন্ন পটেন্সি পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করা হয়েছে, যা শিশুটির শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার উন্নতিতে সাহায্য করেছে।

এক বছরব্যাপী ধৈর্যপূর্ণ চিকিৎসার মাধ্যমে শিশুটি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।


৪. চিকিৎসার সাফল্যের কারণ

১. গভীর রোগী পর্যবেক্ষণ: শিশুটির শারীরিক, মানসিক এবং পারিবারিক ইতিহাস বিশদভাবে বিবেচনা করা হয়েছে।

২. সঠিক ওষুধ নির্বাচন:

প্রথমে স্নায়ু পুনরুদ্ধারে হাইপারিকাম এবং পরে মানসিক ও বংশগত দুর্বলতার জন্য কার্সিনোসিন নির্বাচন করা হয়েছে।

এটি একটি ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতির সফল প্রয়োগ।


৩. ধৈর্য ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ:

শিশুটির প্রতিটি পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে ওষুধের পটেন্সি এবং মাত্রা পরিবর্তন করা হয়েছে।

৫. উপসংহার

এই রোগীলিপিটি দেখায় যে হোমিওপ্যাথি কেবল লক্ষণগত নয়, বরং ব্যক্তিগত ও গভীর বিশ্লেষণের মাধ্যমে রোগীর অন্তর্নিহিত সমস্যার সমাধান করে।

রোগীর শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা আলাদাভাবে না দেখে সম্পূর্ণভাবে বিবেচনা করা হয়েছে।

এটি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার একটি আদর্শ উদাহরণ, যেখানে রোগীর ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ, এবং বংশগত অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা নিরাময়ে হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা এই কেসে প্রমাণিত।

শিশুটির উন্নতি শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ও সামাজিক জীবনে সে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছে, যা চিকিৎসার পূর্ণাঙ্গ সফলতা নির্দেশ করে।




-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি, 
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা    
প্রভাষক, 
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ। 



আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। 
>Share by:

2 মন্তব্যসমূহ


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন