রোগীলিপি নং - ১২, ডাঃ শ্রীবরদাচরণ চক্রবর্তী। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা।

নসীপুরের রাজা প্রতাপ সিংহ

ভয়ঙ্কর বদ হজমের রোগ হয়। 

অনেক চিকিৎসা হইয়াছে, কোন উপকার হইল না। 

প্রতাপ মজুমদার মহাশয়কে হোমিওপ্যাথী চিকিৎসার জন্য ডাকা হইল। 
আমি ( ডাঃ শ্রীবরদাচরণ চক্রবর্তী) সঙ্গে ছিলাম।

রোগী দেখিয়া গাড়ীতে উঠিয়া বসিয়াছেন-দেওয়ানজী আসিয়া গুরুদেবের ফি ৩২ এবং আমাকে ৪ টাকা দিল। 

নোট : ১৯০৪ সালের ৩২ টাকা, গড় বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি হার ৫% ধরে নিলে, ২০২৪ সালে তা প্রায় ১১,১৬৫ টাকা হবে।

হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নাক্স ভমিকা ৩,  দিতে বলিলেন। 

আমি ঔষধ দিতেছি, 
দেওয়ানজী, রাজা বাহাদুরের পথ্যের ব্যবস্থা জানিতে চাহিলেন-ব্যবস্থা বলিলেন-
দুপুরবেলা ঝোল ভাত, দুধ ভাত। 
রাত্রে দুধ সাগু। 
দুধ সাগুর কথা শুনিয়াই দেওয়ানজী বলিল, "রাত্রে একটু পোলাও ও মাংস না খাইলে রাজা বাহাদুর মরে যাবে" হিন্দীতে বলিল। 

গুরুদেব আমাকে ঔষধ দিতে বারণ করিলেন। 

দেওয়ানজী বলিলেন, "আপনার ফি দিয়াছি ঔষধ দিবেন না কেন?" প্রতাপবাবু বলিলেন-"আমি রোগী দেখিয়া ব্যবস্থা বলিয়াছি, তাহার ফি নিয়াছি। 

অবাধ্য রোগীর চিকিৎসা আমি করি না। 

ভেটেরিনারী সার্জেনকে (পশু চিকিৎসককে) ডাকাই ভাল মনে করি।" গাড়ী ছাড়িয়া দিল। গাড়ীতে বসিয়া গুরুদেব নিম্নলিখিত উপদেশ দিলেন - 
"অবাধ্য রোগীর চিকিৎসা কখনও করিবে না। 
চিকিৎসকের উপদেশ যাহারা শুনে না তাহারা পশুতুল্য, দশ বৈদ্য সম পথ্য। 

অবাধ্যতা  করিয়া রোগী  মনে করে,
 তাহারা কেবল খাইবার জন্যই জন্মিয়াছে, 
শরীর সুস্থ ও সবল রাখিয়া বাঁচিবার জন্য যে খাওয়া, একথা মনেই করে না। 

কাজ করিতে করিতে ইঞ্জিন বিগড়াইলে, তাহাকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম দিয়া মেরামত করিয়া চালাইলে পুনরায় ঠিকমত চলে। 
জোর করিয়া ঠেলিয়া নিজে খানিকটা চালান যায়, পরে একেবারে অচল হইয়া যায়। 

আমাদের দেহ ইঞ্জিনের মত। পাকস্থলীতে আহার্য বস্তু (ইঞ্জিনে কয়লা জল) কাজ করিতে করিতে অনিয়মে শীঘ্র বিগড়ায়, নিয়মে বহুদিন ঠিকভাবে চলে। 

বদহজমের রোগীর মনে আনন্দ থাকে না, তাহারা প্রাণ ভরিয়া হাসিতে পারে না। 

যে রোগী প্রাণ ভরিয়া নির্মল হাসি হাসিতে পারে তাহার রোগ থাকে না। 

বদহজমের রোগীর মেজাজ সর্বদাই খিটখিটে থাকে। 

ভাবিয়া ছিলাম এই রোগীর ইঞ্জিন ২/৩ বৎসর চলিবে। 

রাজা বাহাদুর মোটেই শারীরিক পরিশ্রম করে না, তাই বদহজম ধরিয়াছে আরোগ্য হইবে না।

হোমিওপ্যাথী চিকিৎসায়, যদিও বা ২/১ বৎসর চলিত - তাহাও হইবে না। 

এলোপ্যাথী ডাক্তার বিশেষতঃ যদি ইংরেজ ডাক্তার হয়, দুই গেলাস মদ্য বাড়াইয়া দিয়া পোলাও মাংস ইত্যাদি ব্যবস্থা দিবে। 

প্রথম প্রথম খুব হজম হইবে, ভাল বোধ করিবে-পরে ৬ মাস না যাইতেই আগুন একেবারে নিভিয়া ইঞ্জিন জন্মের মত বন্ধ হইয়া যাইবে।" 

প্রায় দুই মাস পর, 
রাজা বাহাদুরের দেওয়ানজী বিকালবেলায় প্রতাপবাবুর ডাক্তারখানায় অন্য এক রোগীর জন্য আসিয়া বলিল রাজা বাহাদুর খুব ভাল আছে।

শুনিয়া তিনি একটু হাসিলেন। 
দেওয়ানজী যাওয়ার পর গুরুদেব বলিলেন-"কথাচ্ছলে আমাকে রাজা বাহাদুরের কথা শুনাইবার জন্যই দেওয়ানজী নিজে আসিয়াছিল।

প্রদীপ নিভিবার পূর্বে জ্বলিয়া উঠিয়াছে, শীঘ্রই নিভিবে, ৬ মাসও যাইবে না।" তাহাই হইল। ৪ মাস পূর্ণ না হইতেই রাজা বাহাদুরের ইঞ্জিন একেবারে বন্ধ হইয়া গেল। 

একদিন গুরুদেব বলিয়াছিলেন, -মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর- নদীপুরের রাজা বাহাদুরের চেয়েও বেশী বদহজমে ভুগিতেছিলেন। 

বহু চিকিৎসা এলোপ্যাথী কবিরাজী ইত্যাদির পর হোমিওপ্যাথী চিকিৎসায় উপকার হইয়াছিল এবং প্রতাপবাবুর ব্যবস্থামত পথ্য, দুধ সাগু খাইয়া প্রায় সুস্থভাবে ১৩ বৎসর বাঁচিয়া ছিলেন।





হোমিওপ্যাথিক দৃষ্টিকোণ থেকে 
আলোচনা করা হল । 


এই ঘটনার মধ্য দিয়ে হোমিওপ্যাথির মূল দর্শন এবং চিকিৎসার কার্যকারিতা সম্পর্কে গভীরভাবে আলোচনা করা যেতে পারে। বিশেষ করে, এখানে রোগীর অবাধ্যতা এবং সঠিক জীবনযাপন ও পথ্য পালনের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।

১. রোগীর অবাধ্যতা ও চিকিৎসকের দায়িত্ব

হোমিওপ্যাথি শুধুমাত্র ওষুধ নির্ভর চিকিৎসা নয়; এটি রোগীর সমগ্র জীবনধারার উপর ভিত্তি করে কাজ করে। প্রতাপবাবু স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, অবাধ্য রোগীর চিকিৎসা তিনি করবেন না। কারণ, অবাধ্য রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসার সঠিক ফল পাওয়া সম্ভব নয়। রোগীর শৃঙ্খলা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

হ্যানিম্যান নিজেও তার "Organon of Medicine" বইতে বলেছেন যে, “The physician must be a moral teacher to his patients, guiding them towards a healthy lifestyle alongside medication.”

২. জীবনধারার ভূমিকা: পথ্য পালন ও রোগ নিরাময়। 

খাবার ও জীবনধারা পরিবর্তন হোমিওপ্যাথির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

নাসীপুরের রাজা প্রতাপ সিংহ অত্যধিক বিলাসী জীবনযাপন করতেন এবং শারীরিক পরিশ্রম করতেন না। এর ফলে তার হজমশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

প্রতাপবাবু তাকে হালকা পথ্য যেমন দুধ, সাগু, এবং ঝোল ভাতের পরামর্শ দেন। কিন্তু রোগী তা মানতে রাজি হননি।

গুরুদেবের মন্তব্য, "অবাধ্য রোগীর চিকিৎসা পশু চিকিৎসার সমতুল্য," হজমশক্তি পুনরুদ্ধারের জন্য পথ্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা স্পষ্ট করে।


৩. পাকস্থলীর তুলনা ইঞ্জিনের সঙ্গে

এই তুলনা গভীরভাবে প্রতীকী। ইঞ্জিন ঠিকমতো চালাতে যেমন জ্বালানির সঠিক পরিমাণ প্রয়োজন, তেমনই দেহ সুস্থ রাখতে প্রয়োজন সঠিক পরিমাণে এবং সঠিক সময়ে খাবার গ্রহণ।

বদহজমের রোগীর পাকস্থলী অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না।

শারীরিক বিশ্রাম এবং হালকা পথ্য পাকস্থলীর কার্যকারিতা পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে।

গুরুদেব উল্লেখ করেছেন, "ইঞ্জিন বিগড়ে গেলে বিশ্রাম ও মেরামতের প্রয়োজন," যা রোগী-চিকিৎসার ক্ষেত্রে সঠিক পথ্যের গুরুত্ব বোঝায়।


৪. নাক্স ভমিকা: ওষুধের নির্বাচন

নাক্স ভমিকা হোমিওপ্যাথির একটি গুরুত্বপূর্ণ ঔষধ, বিশেষ করে:

যারা অতিরিক্ত খাওয়াদাওয়া বা মদ্যপানে ভুগছেন।

যারা মানসিক চাপের কারণে হজমের সমস্যায় ভোগেন।

রোগীর জীবনীশক্তি (vital force) দুর্বল হয়ে গেলে এটি অত্যন্ত কার্যকর।


নাক্স ভমিকা সম্পর্কে হ্যানিম্যান বলেছেন, এটি "একটি শক্তিশালী জীবনীশক্তি পুনরুদ্ধারকারী ওষুধ"। তবে রোগীর জীবনধারা পাল্টানো না হলে ওষুধ দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হয় না।

৫. এলোপ্যাথি বনাম হোমিওপ্যাথি

গুরুদেব বলেছেন, এলোপ্যাথি চিকিৎসকরা রোগীকে মদ্যপান এবং ভারী খাবারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

এটি সাময়িক আরাম দিলেও দীর্ঘমেয়াদে রোগীর জন্য ক্ষতিকর।

হোমিওপ্যাথি রোগের শিকড়ে গিয়ে কাজ করে এবং রোগীর সমগ্র জীবনধারা পরিবর্তনের দিকে নজর দেয়।

নাসীপুরের রাজা এলোপ্যাথি চিকিৎসা গ্রহণ করে সাময়িক ভালো বোধ করলেও, কিছু দিনের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়।


৬. উপসংহার: দীর্ঘমেয়াদী রোগ নিরাময়ে হোমিওপ্যাথি

গুরুদেব অন্য একটি উদাহরণে উল্লেখ করেছেন যে, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা গ্রহণ করে এবং পথ্য পালনের মাধ্যমে ১৩ বছর বেঁচে ছিলেন। এটি স্পষ্ট করে যে:

সঠিক ওষুধ ও পথ্য পালনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে রোগ নিরাময় সম্ভব।

হোমিওপ্যাথি রোগের মূল কারণ সমাধানে বিশ্বাসী, যা শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ও আবেগগত দিকেও মনোযোগ দেয়।


শিক্ষা:

হোমিওপ্যাথির মূল শিক্ষা হল, রোগীকে কেবল ওষুধ নয়, বরং সঠিক জীবনধারা গ্রহণের পথ দেখানো। রোগী যদি অবাধ্য হয় বা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসরণ না করে, তাহলে তার আরোগ্য অসম্ভব।



-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি, 
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা    
প্রভাষক, 
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ। 



আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। 
>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন