টেস্টিং সল্ট একটি নীরব স্নায়ু বিষ। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার দৃষ্টিকোণ।

হ্যাঁ, টেস্টিং সল্ট (মোনোসোডিয়াম গ্লুটামেট বা MSG) অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণ করলে এটি স্নায়ুতন্ত্রের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। 

যদিও এটি সাধারণত খাদ্যের স্বাদ বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয় এবং FDA কর্তৃক নিরাপদ হিসেবে অনুমোদিত, তবে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এটি 
মাথাব্যথা, 
ঝিমঝিম ভাব,
গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা এবং 
স্নায়ুতন্ত্রে উত্তেজনা 
সৃষ্টি করতে পারে।

MSG-তে উপস্থিত গ্লুটামেট অতিরিক্ত মাত্রায় মস্তিষ্কে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে স্নায়ুর ক্ষতি করতে পারে। বিশেষ করে শিশু ও যাদের স্নায়ু সংবেদনশীলতা বেশি, তাদের জন্য এটি ক্ষতিকর হতে পারে।

এ কারণেই স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিরা MSG বা টেস্টিং সল্টের পরিমাণ সীমিত রাখতে পরামর্শ দেন।

টেস্টিং সল্ট বা মোনোসোডিয়াম গ্লুটামেট (MSG) হল একটি রাসায়নিক যৌগ যা খাবারের স্বাদ বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। 
এটি প্রধানত প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্ট ফুড, চিপস, স্ন্যাকস এবং চাইনিজ খাবারে ব্যবহৃত হয়। 
যদিও MSG অনেক ক্ষেত্রে নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত, তবে এটি মানবদেহের ওপর কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষত দীর্ঘমেয়াদী এবং অতিরিক্ত ব্যবহারে। নিচে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

1. MSG কীভাবে কাজ করে?

MSG মূলত খাবারে উমামি নামক পঞ্চম স্বাদ যুক্ত করে। এটি একটি গ্লুটামেট যৌগ যা প্রাকৃতিকভাবে মাংস, দুধ, পনির এবং কিছু শাকসবজিতে পাওয়া যায়। MSG এর রাসায়নিক গঠন সিন্থেটিক হলেও এটি গ্লুটামেট রিসেপ্টরের মাধ্যমে মস্তিষ্কে খাবারের স্বাদের অনুভূতি বাড়ায়।


2. MSG-এর ক্ষতিকর প্রভাব

(ক) স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব

MSG অতিরিক্ত গ্রহণ করলে এটি গ্লুটামেট রিসেপ্টরকে অতিরিক্ত উত্তেজিত করতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি মস্তিষ্কের কোষগুলিকে চাপ দিতে পারে এবং স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। একে কখনও কখনও এক্সাইটোটক্সিসিটি বলা হয়।

অতিরিক্ত উত্তেজনা স্নায়ুর কোষগুলিকে ধ্বংস করতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদে এটি 
আলঝেইমার, 
পারকিনসন্স, এবং 
স্নায়ুজনিত অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।


(খ) "চাইনিজ রেস্টুরেন্ট সিনড্রোম"

MSG গ্রহণের পর কিছু মানুষের ক্ষেত্রে নিচের উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে, যা সাধারণত "চাইনিজ রেস্টুরেন্ট সিনড্রোম" নামে পরিচিত:

মাথাব্যথা

বমি বমি ভাব

ঘাড় বা শরীরে চাপ অনুভব

দ্রুত হার্টবিট

বুক ধড়ফড়ানি

অতিরিক্ত ঘাম


(গ) হরমোন এবং মেটাবলিজমে প্রভাব

MSG গ্রহণ হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে:

ইনসুলিন প্রতিরোধ বাড়িয়ে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

ওজন বাড়াতে সহায়তা করে কারণ এটি অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি করে।


(ঘ) শিশুদের ওপর প্রভাব

MSG শিশুদের ক্ষেত্রে আরও ক্ষতিকর হতে পারে, কারণ তাদের স্নায়ুতন্ত্র খুবই সংবেদনশীল। 
এটি মনোযোগের ঘাটতি (ADHD), 
উত্তেজনা, এবং 
আচরণগত সমস্যার কারণ হতে পারে।


3. কী পরিমাণে MSG গ্রহণ নিরাপদ?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) MSG-কে সাধারণত নিরাপদ (GRAS) হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে। তবে দৈনন্দিন খাবারে অতিরিক্ত MSG এড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। সাধারণত প্রক্রিয়াজাত খাবারে MSG-এর পরিমাণ বেশি থাকে, তাই এই ধরনের খাবার নিয়মিত খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।


4. MSG-এর বিকল্প

যারা MSG এড়াতে চান, তারা প্রাকৃতিক উপায়ে খাবারের স্বাদ বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারেন। যেমন:

প্রাকৃতিক উমামি উৎস: 
মাশরুম, টমেটো, পনির, সয়া সস।

হারবস ও মশলা: 
রসুন, আদা, ধনে পাতা, জিরা।

লেবুর রস এবং 
ভিনেগারও স্বাদ বাড়াতে সাহায্য করে।


5. এড়ানোর উপায়

লেবেল পড়ুন: 
প্যাকেটজাত খাবারের উপাদান তালিকায় “মোনোসোডিয়াম গ্লুটামেট (MSG)”, “হাইড্রোলাইজড প্রোটিন” বা “গ্লুটামেট” আছে কিনা তা পরীক্ষা করুন।

ফাস্ট ফুড এড়ানো: 
বিশেষ করে চাইনিজ বা প্রক্রিয়াজাত খাবারে MSG বেশি পরিমাণে থাকে।


হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার দৃষ্টিকোণ থেকে টেস্টিং সল্ট (MSG)

হোমিওপ্যাথি একটি সমগ্রতাভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি, যা রোগের লক্ষণ, ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক অবস্থা এবং জীবনের সামগ্রিক ভারসাম্যের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা প্রদান করে। টেস্টিং সল্ট (মোনোসোডিয়াম গ্লুটামেট বা MSG) শরীর ও মনের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তা হোমিওপ্যাথির দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো উঠে আসে:


1. MSG-এর প্রভাব এবং হোমিওপ্যাথিক মূল্যায়ন

MSG মূলত স্নায়ুতন্ত্র এবং মেটাবলিজমে প্রভাব ফেলে। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় এই ধরনের সমস্যা মোকাবিলায় রোগীর সম্পূর্ণ ইতিহাস এবং উপসর্গের বিবরণ সংগ্রহ করা হয়। MSG-এর কারণে যে সমস্যাগুলো দেখা দেয়, সেগুলোর জন্য হোমিওপ্যাথি কীভাবে সহায়ক হতে পারে, তা নিচে ব্যাখ্যা করা হলো:

(ক) স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রভাব

MSG অতিরিক্ত গ্রহণে 
স্নায়ু উত্তেজনা, 
মাথাব্যথা, 
অনিদ্রা, এবং 
উদ্বেগ দেখা দিতে পারে। 

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় এ ধরনের সমস্যার জন্য নিম্নলিখিত ওষুধ কার্যকর হতে পারে:


Nux Vomica: স্নায়ুতন্ত্রে অতিরিক্ত উত্তেজনা, মাথাব্যথা, এবং অস্থিরতার জন্য।

Ignatia Amara: মানসিক চাপ এবং উদ্বেগের কারণে সৃষ্ট সমস্যার জন্য।

Gelsemium: দুর্বলতা, ঝিমঝিম ভাব এবং স্নায়ুতন্ত্রের দুর্বলতার ক্ষেত্রে।


(খ) হজম ও মেটাবলিজমে প্রভাব

MSG অতিরিক্ত গ্রহণে 
হজমের সমস্যা, 
ফ্যাটি লিভার, বা 
অতিরিক্ত ক্ষুধার উদ্রেক ঘটাতে পারে। 

হোমিওপ্যাথিক ওষুধ হজম প্রক্রিয়া উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে:

Lycopodium: গ্যাস্ট্রিক, ফোলাভাব, এবং যকৃতের সমস্যার জন্য।

Chelidonium: ফ্যাটি লিভার এবং যকৃতের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য।

Pulsatilla: হালকা হজম সমস্যা এবং খাবারের প্রতি অরুচির ক্ষেত্রে।




(গ) মানসিক ও আচরণগত সমস্যা

MSG অতিরিক্ত গ্রহণে, 
মস্তিষ্কে গ্লুটামেটের ভারসাম্যহীনতার কারণে, 
অতিরিক্ত উত্তেজনা, 
মেজাজ খিটখিটে হওয়া, এবং 
মনোযোগের অভাব দেখা দিতে পারে। 

এ ক্ষেত্রে:


Chamomilla: শিশু বা প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অতিরিক্ত রাগ এবং বিরক্তির জন্য।

Phosphorus: স্নায়ুজনিত দুর্বলতা এবং মনোযোগের ঘাটতির জন্য।

Calcarea Phos: শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য উপকারী।


2. MSG-এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এবং হোমিওপ্যাথিক দৃষ্টিকোণ

MSG-এর দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি করে, সেগুলোকে হোমিওপ্যাথি সমগ্রতাভিত্তিক পদ্ধতিতে মোকাবিলা করে।

(ক) টক্সিন নিরসনে ভূমিকা

হোমিওপ্যাথিতে শরীর থেকে টক্সিন বের করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ ব্যবহৃত হয়। MSG-এর কারণে শরীরে জমে থাকা ক্ষতিকর পদার্থ দূর করতে:

Berberis Vulgaris: শরীর থেকে টক্সিন বের করার জন্য এবং যকৃতের কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য।

Sulphur: টক্সিন নিরসন এবং প্রদাহ কমাতে।


(খ) ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করা

MSG শরীরের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করতে পারে। ইমিউন সিস্টেম উন্নত করতে:

Thuja Occidentalis: টক্সিন নিরসন এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য।

Echinacea: প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য।


(গ) মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা

MSG-এর মানসিক প্রভাব, যেমন, 
হতাশা, 
ক্লান্তি, এবং 
অস্থিরতা দূর করতে, 
হোমিওপ্যাথি মানসিক ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে কাজ করে:

Aconitum Napellus: হঠাৎ মানসিক উত্তেজনা বা আতঙ্কের জন্য।

Natrum Muriaticum: দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ বা বিষণ্নতার জন্য।


3. MSG থেকে সৃষ্ট সমস্যা প্রতিরোধে হোমিওপ্যাথিক পরামর্শ

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুধু লক্ষণগত নয়, বরং সমস্যার মূল কারণকে দূর করতে সহায়ক। MSG থেকে সৃষ্ট সমস্যা প্রতিরোধ ও সমাধানের জন্য নিম্নলিখিত পরামর্শ দেওয়া হয়:

প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাস: MSG সমৃদ্ধ প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা এবং তাজা, প্রাকৃতিক খাবার গ্রহণ।

স্বাস্থ্যকর জীবনধারা: সঠিক ঘুম, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ, এবং নিয়মিত ব্যায়াম।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো: হোমিওপ্যাথিক ওষুধ এবং সঠিক ডায়েটের মাধ্যমে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি।


4. হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সুবিধা

বিষক্রিয়া মুক্ত: হোমিওপ্যাথিক ওষুধ শরীরে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না।

লক্ষণ-ভিত্তিক চিকিৎসা: এটি ব্যক্তির মানসিক ও শারীরিক লক্ষণগুলোর ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা করে।

সমগ্রতাভিত্তিক পদ্ধতি: হোমিওপ্যাথি শুধু রোগ নয়, বরং রোগীর পুরো জীবনধারা এবং স্বাস্থ্যের সামগ্রিক অবস্থাকে বিবেচনা করে।

5. উপসংহার

MSG-এর কারণে শরীর ও স্নায়ুতন্ত্রে যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, তা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার মাধ্যমে প্রতিরোধ ও নিরাময় করা সম্ভব। 
হোমিওপ্যাথি এই সমস্যা সমাধানে সমগ্রতাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে এবং রোগীর শরীরের প্রাকৃতিক নিরাময় ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে কাজ করে। তবে, সঠিক চিকিৎসার জন্য অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথের পরামর্শ গ্রহণ করা জরুরি।



-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি, 
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা    
প্রভাষক, 
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ। 



আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। 
>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন