"প্রথমে রোগীর জীবন ইতিহাসের গভীরে যান, তারপর লক্ষণ দেখুন" – ডা. রাজন শঙ্করণ, বিস্তারিত আলোচনা করুন।

"প্রথমে রোগীর জীবন ইতিহাসের গভীরে যান, তারপর লক্ষণ দেখুন"
— এই গুরুত্বপূর্ণ বাণীটি দিয়েছেন আধুনিক হোমিওপ্যাথির অন্যতম পথিকৃৎ ডা. রাজন শঙ্করণ (Dr. Rajan Sankaran)। এই বাক্যটি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার দার্শনিক ও ব্যবহারিক ভিত্তিকে ব্যাখ্যা করে। নিচে আমরা বাংলায় এর বিস্তারিত আলোচনা করছি:

---

🧠 ১। লক্ষণ নয়, আগে জীবন কাহিনি (Life Story First, Symptoms Later):

ডা. শঙ্করণ মনে করেন:

> রোগ শুধু শারীরিক লক্ষণ নয়; রোগ এক ধরনের অভ্যন্তরীণ অসামঞ্জস্য (disharmony) — মানসিক, আবেগগত ও জীবনযাত্রার মধ্যকার বিভ্রান্তি।

🔸 তাই একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের দায়িত্ব হলো:

রোগী কবে, কীভাবে এমন অবস্থায় পৌঁছালেন?

তাঁর জীবনের আবেগ, ভয়, স্বপ্ন, মানসিক চাপ — এগুলো কোন দিক থেকে তাঁকে আঘাত করেছে?

জীবনের গভীর ট্রমা, নিরাপত্তাহীনতা, বা সম্পর্কগত সংকট কিভাবে তার শরীরকে প্রভাবিত করছে?


🎯 অর্থাৎ রোগের শিকড় খুঁজে বের করতে হবে রোগীর জীবনকাহিনির গভীরতায় গিয়ে।
---

💡 ২। লক্ষণ নয়, রোগীর অভ্যন্তরীণ “বিষয়বস্তু (Core Delusion / Sensation)” খুঁজে বের করুন:

ডা. শঙ্করণ তাঁর “Sensation Method”-এ দেখিয়েছেন:

শারীরিক লক্ষণ শুধু উপরের পর্দা — এর নিচে রয়েছে এক “ভিতরকার অনুভূতি” বা Core Sensation।

প্রতিটি রোগীর কিছু নির্দিষ্ট অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা থাকে যা তার লক্ষণগুলিকে চালিত করে।

📌 যেমন:
একজন Vitiligo রোগী কেবল “সাদা দাগ” নয় — তার অন্তরে হয়তো রয়েছে “নিজেকে গ্রহণযোগ্য মনে না হওয়া”, “বিচ্ছিন্নতা” বা “অসম্পূর্ণতা”র গভীর ভয়।
---

🩺 ৩। সঠিক রেমেডি কেবল লক্ষণের উপর নির্ভর করলে পাওয়া যায় না:

একজন রোগী বলতেই পারে—

“আমার মাথা ব্যথা করে” – কিন্তু কেন? কী সময় করে? কী অনুভব করেন মাথায়?

তার সাথে কি গভীর কোনো মানসিক চাপ আছে? নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি কিছু ভয় বা চাপ কাজ করে?


🔎 যদি আমরা শুধুমাত্র ‘মাথা ব্যথা’ দেখে Belladonna বা Nux vomica দেই, তবে হয়তো সাময়িক উপশম হবে — কিন্তু মূল রোগ কখনোই যাবে না।

তাই, জীবনের প্রেক্ষাপট বুঝে লক্ষণগুলোকে বিশ্লেষণ করতে হবে।
---




🌿 ৪। ডা. শঙ্করণ বলেন: “রোগী তার জীবনের গান গায়, ওষুধ সেই সুরের সঙ্গী হতে হবে।”

অর্থাৎ:

রোগী তার কষ্ট, বেদনা, আশা, ভয়, খুশি — সবকিছুর এক অব্যক্ত ছন্দ বয়ে নিয়ে চলে।

আপনি যদি সেই ছন্দ বুঝতে পারেন, তবে আপনি সঠিক ঔষধ খুঁজে পাবেন।

এই ‘ছন্দ’ খুঁজে পাওয়ার জন্য:

শিশুকাল, পারিবারিক জীবন, সম্পর্ক, সামাজিক অবস্থান, মানসিক প্রতিক্রিয়া — সবকিছু জানতে হয়।

রোগী যেভাবে কথা বলেন, দেহভঙ্গি করেন, প্রতিক্রিয়া জানান — সব গুরুত্বপূর্ণ।

---

📌 সারাংশ:

বিষয় বিস্তারিত

মূল দর্শন   লক্ষণের আগে রোগীর জীবন ইতিহাস বোঝা জরুরি। 

উদ্দেশ্য রোগের মূল অনুভব বা ভুল ধারণা (Delusion) অনুধাবন করা। 

প্রক্রিয়া রোগীর জীবনকাহিনি, মানসিক প্রতিক্রিয়া, অনুভূতি ও সংবেদন অনুসন্ধান করা
লক্ষ্য কেবল উপসর্গ নয়, গভীরতর অসামঞ্জস্য নিরাময় করা। 

---

উদাহরণ (Practical Example):

একজন রোগী Vitiligo নিয়ে এসেছেন — কিন্তু আপনি শুধু “সাদা দাগ” দেখবেন না।

বরং জানতে হবে:

তিনি এই রোগ নিয়ে লজ্জিত কি না?

এর জন্য কি আত্মবিশ্বাস কমে গেছে?

তিনি কীভাবে সম্পর্ক তৈরি করেন?

ছোটবেলায় কী ধরনের মানসিক আঘাত পেয়েছেন?


এইসব বিষয় মিলিয়ে যে ওষুধটি তার “ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি”, সেটিই হবে তার সিমিলিমাম (Simillimum)।
---

🖋️ শেষ কথা:

"প্রথমে জীবন, পরে লক্ষণ" — এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের হোমিওপ্যাথিকে শুধু চিকিৎসার মাধ্যম নয়, বরং এক গভীর মানবিক বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।




-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি, 
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা    
প্রভাষক, 
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ। 

আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ।


>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন