ভূমিষ্ঠ মৃতকল্প শিশু
(Still-born Infants)
অনেক শিশু মৃতবৎ ভূমিষ্ঠ হয়। অবিলম্বে ইহার প্রতিবিধান না করিলে শিশু মৃতকল্প অবস্থা হইতে প্রকৃত মৃতাবস্থাতেই পরিণত হইয়া থাকে।
ফুসফুসে বায়ু প্রবেশ করানই ইহাকে বাঁচাইবার প্রধান কৌশল। যতক্ষণ তাহার হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া চলিতে থাকে, এমন কি সূক্ষ্ণভাবে চলিলেও বুঝিতে হইবে তাহাকে বাঁচান নিতান্ত শক্ত নহে।
কারণ :
১। ধাতুবিকৃতিজনিত ( সোরা, সাইকোসিস, সিফিলিস) দুর্বলতা ইহার প্রধান কারণ।
এই দুর্বলতা হইতে শিশু শ্বাস-প্রশ্বাস লইতে সক্ষম হয় না।
২। প্রসববেদনার সময়ে চাপ, অথবা নাভিরজ্জুর মোচড়ান হেতু শিশুর রক্তসঞ্চালনে বাধাপ্রাপ্ত হইয়াও এই প্রকারের অবস্থা উপস্থিত করিতে পারে।
৩। প্রসূতির জরায়ুদোষহেতুও শিশু মৃতবৎ ভূমিষ্ঠ হইতে পারে।
৪। শিশুর মুখগহ্বর এবং গলমধ্যে আঠাবৎ শ্লেষ্মার অবস্থিতি হেতু ফুসফুসে বায়ুর যাতায়াত রুদ্ধ হইয়াও এই প্রকারের অবস্থা উপস্থিত হইয়া থাকে। ইহাকে সদ্যোজাত শিশুর শ্বাস অবরোধ (asphyxia neonatorum) বলে।
৫। উপর্যুক্ত কারণ ব্যতীতও ভূমিষ্ঠ হইবার সময়ে যদি শিশুর কুটিল গতি (malpresentation) বিশেষত শিশুর মস্তক প্রথমে প্রসূত না হইয়া পদদ্বয় বা নিতম্ব প্রসূত হয় (breech presentation). তাহা হইলে তাহার শ্বাস অবরোধের আশঙ্কা খুব প্রবলই থাকে।
৬। অ্যাফিক্সিয়া প্যালিডা (asphyxia pallida) নামক শ্বাস অবরোধে শিশুর গাত্রত্বক রক্তশূন্য হইয়া যায়, সুতরাং তাহাকে ফ্যাকাশে দেখায়। সমস্ত শরীর ঠাণ্ডা হইয়া যায়, পেশিসকল শিথিলতাপ্রাপ্ত হয়, হৃৎপিণ্ডের শব্দ প্রায়ই পাওয়া যায় না, শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়ারও কোন প্রকার চেষ্টা দেখা যায় না। কর্ড বা নাভিরজ্জুতে স্পন্দনশীলতা (pulsation) অনুভূত হয় না।
৭। আর এক প্রকারের অ্যাফিক্সিয়া আছে, তাহার নাম অ্যাফিক্সিয়া লিভিডা (asphyxia livida)। তাহাতে শিশু নীলবর্ণ ধারণ করে। শিশুর পূর্বোক্ত প্রকারের থেকে অ্যাফিক্সিয়া লিভিডা অধিকতর মারাত্মক। লিভিডা নামক অ্যাফিক্সিয়ায় শিশু নীলবর্ণ ধারণ করে, নাভিরজ্জুতে মৃদু অথচ প্রবল (slow and strong) স্পন্দন অনুভূত হয়, শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়ার সামান্য চেষ্টা দেখা যায়, হৃৎপিণ্ডও জোরে স্পন্দিত হয়।
৮. গর্ভের মধ্যে অক্সিজেনের ঘাটতি:
প্লাসেন্টাল ইনসাফিসিয়েন্সি।
গর্ভস্থ শিশুর নাড়ির জটিলতা।
৯. মাতৃ-রোগ:
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ।
প্রিক্ল্যাম্পসিয়া।
ম্যাল্টিপল প্রেগনেন্সি।
১০. আঘাত বা দুর্ঘটনা:
প্রসবকালীন আঘাত।
মাতৃগর্ভে গর্ভফুল আলাদা হয়ে যাওয়া।
4. সংক্রমণ:
CMV, Toxoplasmosis, Rubella।
5. জেনেটিক ডিফেক্ট:
ক্রোমোসোমাল ডিসঅর্ডার।
জন্মগত অঙ্গবিকৃতি।
প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ ও অবস্থা বিশ্লেষণ:
প্রথমে শিশুর অবস্থা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।শিশুর গলদেশে নাভিনাড়ি বিজড়িত থাকিলে তাহা সত্বর খুলিয়া ফেলিতে হইবে। মুখ এবং গলমধ্য হইতে সযতনে শ্লেষ্মা পরিষ্কার করিয়া দিবে। শিশুকে ঠাণ্ডা উন্মুক্ত বায়ুতে রাখিবে। এক হাতের অঙ্গুলি দ্বারা শিশুর নাসিকা চাপিয়া অন্য হাত দ্বারা তাহার পাকস্থলীতে চাপ দিয়া তাহার ওষ্ঠে ওষ্ঠ লাগাইয়া এমনভাবে ফুঁ দিতে হইবে যেন তাহার ফুসফুসে বায়ু প্রবেশ করে। পাকস্থলীতে পূর্ব হইতে চাপ দেওয়ায় বায়ু পাকস্থলীতে প্রবেশ করিবে না। তৎপরে যাহাতে বায়ু বাহির হইয়া যায় এজন্য পাঁজরা চাপিতে হইবে। মিনিটে অন্তত ১৫ বার এই প্রক্রিয়া করিতে পারিলে ১৫। ২০ মিনিটের মধ্যে শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া আরম্ভ হইতে পারে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া ব্যর্থ হইলে তাহার বুকে ও মুখে পর্যায়ক্রমে গরম ও ঠাণ্ডা জলের ঝাপ্টা মারিবে।শ্বাস-প্রশ্বাস আছে কিনা, নাড়ির স্পন্দন আছে কিনা তা যাচাই করতে হবে।শিশুর রঙ (নীলচে, কালচে, ফ্যাকাসে), তাপমাত্রা (ঠান্ডা, উষ্ণ), চেতনা (অচেতন, নিস্তেজ) বিশ্লেষণ করতে হবে।গর্ভাবস্থার ইতিহাস এবং প্রসবকালীন যেকোনো জটিলতা যাচাই করতে হবে।
যে অ্যাফিক্সিয়ার শিশু ফ্যাকাসে হইয়া ভূমিষ্ট হয় তাহাতে নাভিরজ্জুকে ২।৩ ইঞ্চি রাখিয়া সূতা দিয়া বাঁধিয়া (ligature) বিচ্ছিন্ন করিয়া দিতে হইবে। পরে আন্দাজ ১০০ ডিগ্রী উত্তাপের গরম জলের মধ্যে শিশুকে ধরিয়া (এজন্য একটি টব ব্যবহার সঙ্গত) আঙ্গুল দিয়া শিশুর গলা হইতে শ্লেষ্মা বাহির করিয়া ফেলিতে হইবে। ইহার পরে শিশুকে জল হইতে উঠাইয়া ও মুছাইয়া বক্ষঃস্থল, মেরুদণ্ড ও পদদ্বয় উত্তমরূপে ঘর্ষণ করিলে শিশুর এই অবস্থা দূরীভূত হইবে। ইহা ব্যর্থ হইলে পূর্বোক্ত কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস পদ্ধতি অবলম্বনীয়। নীলবর্ণের অ্যাফিক্সিয়ায় গরমজলের প্রক্রিয়ার (hot bath) পরে ঠাণ্ডা জলের প্রক্রিয়া (cold bath) করা দরকার কিন্তু ফ্যাকাসে অ্যাফিক্সিয়ায় ঠাণ্ডা জল প্রয়োগ উচিত নহে, তাহাতে হৃৎপিণ্ডের অবসাদ (depression of heart) আসিবার খুব সম্ভাবনা থাকে।
২য় করনীয় : ঔষধ নির্বাচনের প্রক্রিয়া:
শিশুর বর্তমান উপসর্গ, জন্মের সময়ের অবস্থা ও প্রসবকালীন পরিস্থিতি বিবেচনা করে ঔষধ নির্বাচন করতে হবে।
শিশুর রঙ, তাপমাত্রা, নাড়ির স্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাস ইত্যাদি লক্ষণ বিশ্লেষণ করে উপযুক্ত রেমেডি নির্বাচন করতে হবে।
এই সমস্ত প্রক্রিয়ার পরেও যদি শিশুর-শ্বাস-প্রশ্বাস অনিয়মিত হয়, অথবা ধীরে ধীরে বহিতে থাকে, তাহা হইলে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগে চিকিৎসার প্রয়োজন হইয়া থাকে। ঔষধের একটি অতি ক্ষুদ্র অণুবটিকা জিহ্বার উপর ফেলিয়া দিবে।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার বিশ্লেষণ:
হোমিওপ্যাথিতে Still-born Infant এর চিকিৎসায় মূলত তিনটি ধাপে কাজ করা হয়:
1. প্রাথমিক শ্বাসযন্ত্রের সাড়া ফিরিয়ে আনা।
2. রক্তসঞ্চালন পুনঃস্থাপন।
3. স্নায়বিক সাড়া পুনরুদ্ধার।
1. শ্বাসযন্ত্র পুনঃস্থাপন: প্রাথমিক শ্বাসযন্ত্রের সাড়া ফিরিয়ে আনা।
প্রাথমিক অবস্থায় শিশুর শ্বাসযন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য নিম্নলিখিত ঔষধসমূহ অত্যন্ত কার্যকরী:
অ্যাকোনাইট :
শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া আরম্ভ হইলে ইহার উপযোগিতা অনেক সময়ে উপলব্ধি করা যায়, বিশেষত যদি ঠাণ্ডা লাগার ইতিহাস থাকে।
Carbo Vegetabilis:
লক্ষণ: শিশুর শরীর সম্পূর্ণ ঠান্ডা, নীলচে।
এটি মৃতপ্রায় অবস্থায় সজীবতা ফিরিয়ে আনতে কার্যকরী।ত্বক এবং নখ নীলচে কালো।শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ বা অত্যন্ত দুর্বল।জীবনপ্রাণ শক্তির চরম ঘাটতি।
Laurocerasus:
শিশুর মুখমণ্ডল নীলচে, শ্বাস বন্ধ।হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া অত্যন্ত দুর্বল।নিস্তেজ, অজ্ঞান অবস্থায়।প্রসবকালে অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে শিশুর শ্বাসযন্ত্রে ক্ষতি।শিশু যদি নীলবর্ণ ধারণ করে (cyanosed), খাবি খাইতে থাকে (gasping), তাহা হইলে এই ঔষধ অনেক সময়ে আসন্ন মৃত্যু হইতে শিশুকে রক্ষা করিতে পারে।
Antimonium Tartaricum:
নবজাতকের ফুসফুসে কফ জমে থাকা।শ্বাস নিতে গিয়ে হাঁপাচ্ছে।ফুসফুসের শ্লেষ্মা সরে না।প্রি-ম্যাচিউর ডেলিভারিতে শ্বাসযন্ত্রের জটিলতা।শিশুর মুখমণ্ডল মলিন অথবা স্ফীত ও বেগুনে রংয়ের থাকে।
বায়ুনলী যদি শ্লেষ্মায় বাধা-প্রাপ্ত মনে হইলে।
2. রক্তসঞ্চালন পুনঃস্থাপন:
রক্তসঞ্চালন বন্ধ হলে শিশুর নাড়ি দুর্বল হয়ে যায় এবং ত্বক নীলচে হয়। এ অবস্থায় নিম্নলিখিত ঔষধ কার্যকরী:
Opium:
উপর্যুক্ত ঔষধ প্রয়োগে উন্নতি দেখা না গেলে ইহা প্রয়োগ করিবে।মুখমণ্ডল নীলাভ এবং বিবর্ণ দেখা গেলে অধিকতর উপযোগিতার সহিত ব্যবহৃত হইয়া থাকে।
প্রসবকালে গর্ভফুলে চাপ লেগে শিশুর শ্বাস বন্ধ।মাতৃগর্ভে শিশুর শ্বাসকষ্ট হয়েছে।নবজাতক নিস্তেজ, চেতনা নেই।
China:
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে শিশুর রক্তচাপ হ্রাস।গর্ভস্থ শিশুর রক্ত প্রবাহে ব্যাঘাত।শরীর অত্যন্ত দুর্বল ও নিস্তেজ।
৩। স্নায়বিক সাড়া পুনরুদ্ধার:
Camphora:
শিশুর শরীর সম্পূর্ণ ঠান্ডা ও অচেতন।শিরা-উপশিরায় রক্তপ্রবাহ বন্ধ।হৃদস্পন্দন নেই বা খুবই দুর্বল।
Hydrocyanic Acid:
৪। সাধারণত আঘাতজনিত ও স্নায়বিক আঘাতের ফলে :নবজাতকের স্নায়বিক ক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ।মুখমণ্ডল কালচে নীল।তীব্র শ্বাসকষ্ট এবং মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতি।
Arnica Montana:
প্রধান লক্ষণ:
শিশুটি প্রসবকালে ফোর্সেপ ব্যবহার করার সময় মাথায় আঘাত পেয়েছে এবং মেরুদণ্ডে চাপ লেগেছে।শিশুর ত্বক নীলচে, শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ।প্রসবকালীন আঘাত, বিশেষত মাথায় বা মেরুদণ্ডে আঘাত।শিশুর মাথায় রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া।গর্ভাবস্থায় মাতৃগর্ভে আঘাত লেগে শিশুর ক্ষতি।শিশুর শরীর নীলচে, মাথায় রক্তক্ষরণ বা ফোলা দেখা যায়।রক্ত সঞ্চালন কমে যাওয়া।প্রসবকালে দীর্ঘস্থায়ী কষ্ট, যার ফলে শিশুর শারীরিক আঘাত হতে পারে।
Hypericum Perforatum:
প্রধান লক্ষণ:
মেরুদণ্ডে বা নার্ভে আঘাত।গর্ভাবস্থায় বা প্রসবকালে মেরুদণ্ডে আঘাত লেগেছে।প্রসবের সময় ফোর্সেপ বা ভ্যাকুয়াম ব্যবহারের কারণে স্নায়বিক ক্ষতি।শিশুটি প্রসবকালে ফোর্সেপ ব্যবহার করার সময় মাথায় আঘাত পেয়েছে এবং মেরুদণ্ডে চাপ লেগেছে।শিশুর ত্বক নীলচে, শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ।প্রসবকালে শিশুর মাথা বা ঘাড়ে আঘাত লেগেছে।শিশুর চেতনা নেই, তবে মেরুদণ্ডে আঘাতের লক্ষণ স্পষ্ট।
প্রয়োগ প্রণালী :
Still-born Infant এ প্রয়োগ করার আগে অবশ্যই সঠিক কারণ নির্ণয় করতে হবে।
Still-born Infant এর ক্ষেত্রে উচ্চ পটেন্সির (200C বা 1M) প্রয়োগ করতে হবে।
ঔষধ প্রয়োগের পর শিশুর অবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
যদি শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস ফিরে আসে, তাহলে প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।
যদি শিশুর অবস্থা উন্নতি না হয়, তবে তাৎক্ষণিকভাবে মেডিকেল সাপোর্ট নিতে হবে।
পটেন্সি: 30C, 200C বা 1M বা ০/২।
মাত্রা: তাহা হইলে ঔষধের ২০০ বা ০/২ শক্তির একটি অণুবটিকা বা অতি ক্ষুদ্র গ্লোবিউল দুই আউন্স পানির বোতলে দিয়া, সজোরে ১০টি ঝাকি দিয়া রোগীর অবস্থানুসারে ১০ / ১৫ মিনিট অন্তর এক মাএা প্রয়োগ করিবেন।
সাপোর্টিভ কেয়ার:
Mouth-to-Mouth রেসকিউ ব্রিদিং।গরম কাপড় বা হিট প্যাড দিয়ে শিশুকে উষ্ণ রাখা।প্রয়োজনে CPR প্রদান।ফুসফুসে সাফাই (সাকশন)।হাসপাতালের বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা।
পুনর্বাসন ও সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট:
Still-born Infant এর ক্ষেত্রে মা-বাবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। তাই তাদের সান্ত্বনা, কাউন্সেলিং এবং মানসিক সমর্থন প্রদান করা জরুরি।
গুরুত্বপূর্ণ নোট:Ignatia: শোক ও মানসিক আঘাত লাঘব।Natrum Muriaticum: দীর্ঘস্থায়ী দুঃখ ও বিষণ্নতা।Arsenicum Album: অতিরিক্ত উদ্বেগ ও আতঙ্ক।
Still-born Infant এর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার ওপর নির্ভর করা ঝুঁকিপূর্ণ না হলেও,দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা এবং উপযুক্ত মেডিকেল ইন্টারভেনশন নিশ্চিত করা আবশ্যক।CPR বা রেসকিউ ব্রিদিং-এর সঠিক পদ্ধতি জানতে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন।
ভূমিষ্ঠ মৃতকল্প শিশু (Still-born Infant)
এর হোমিওপ্যাথিক রোগীলিপি বিশ্লেষণ (Case Analysis):
Still-born Infant এর ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক রোগীলিপি বিশ্লেষণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল কাজ। এটি সঠিক রেমেডি নির্বাচন এবং দ্রুত প্রয়োগের জন্য অপরিহার্য।
এখানে রোগীলিপি বিশ্লেষণ ধাপে ধাপে আলোচনা করা হলো।
ধাপ ১:
রোগীর ইতিহাস সংগ্রহ (Case Taking):
Still-born Infant এর ক্ষেত্রে রোগীর ইতিহাস বলতে প্রসবকালীন এবং গর্ভকালীন উভয় ইতিহাসকেই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
A. গর্ভকালীন ইতিহাস (Antenatal History):
1. গর্ভাবস্থার সময়কাল:
পূর্ণমেয়াদী (Full Term), প্রি-ম্যাচিউর (Preterm), পোস্ট-টার্ম (Post Term)।
2. মাতৃগর্ভে শিশুর অবস্থা:
Placenta previa, cord prolapse, nuchal cord, amniotic fluid embolism ইত্যাদি।
গর্ভফুলের আলাদা হয়ে যাওয়া বা প্লাসেন্টাল ইনসাফিসিয়েন্সি।
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, প্রিক্ল্যাম্পসিয়া, উচ্চ রক্তচাপ।
3. মাতৃগর্ভে আঘাত বা সংক্রমণ:
Rubella, CMV, Toxoplasmosis, Syphilis।
মাতৃগর্ভে বড় ধরনের আঘাত বা ট্রমা।
B. প্রসবকালীন ইতিহাস (Natal History):
1. প্রসবের ধরণ:
নরমাল ডেলিভারি, ফোর্সেপ ডেলিভারি, সিজারিয়ান।
প্রসব দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে কি না।
2. প্রসবকালীন আঘাত:
মাথায় আঘাত, মেরুদণ্ডে আঘাত।
ফোর্সেপ বা ভ্যাকুয়াম ব্যবহারের প্রভাব।
3. শিশুর শারীরিক অবস্থা:
ত্বকের রঙ (নীলচে, কালচে, ফ্যাকাসে)।
শ্বাস-প্রশ্বাস (অনুপস্থিত বা দুর্বল)।
নাড়ি স্পন্দন (দুর্বল বা শূন্য)।
তাপমাত্রা (ঠান্ডা বা উষ্ণ)।
C. জন্ম পরবর্তী ইতিহাস (Postnatal History):
1. প্রথম চিৎকারের সময়কাল:
জন্মের পরপরই চিৎকার করেছে কিনা।
দীর্ঘ সময় শ্বাস বন্ধ ছিল কিনা।
2. শিশুর সাড়া:
নড়াচড়া আছে কিনা।
চোখ খুলছে কিনা।
3. শিশুর শারীরিক লক্ষণ:
শ্বাসকষ্ট, কফ জমাট বাঁধা।
ফুসফুসে পানি বা রক্ত জমাট।
আঙ্গুল, নখ, ঠোঁট নীলচে।
ধাপ ২:
রোগীর প্রধান উপসর্গসমূহ চিহ্নিতকরণ:
Still-born Infant এর ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত প্রধান উপসর্গসমূহ বিশ্লেষণ করতে হবে:
উপসর্গ সংশ্লিষ্ট রেমেডি
শ্বাস বন্ধ (Apnea) : Carbo Vegetabilis, Opium, Laurocerasus
ঠান্ডা দেহ (Cold Body) : Camphora, Carbo Veg, Laurocerasus
নীলচে ত্বক (Cyanosis) : Carbo Veg, Hydrocyanic Acid, Laurocerasus
মাথায় আঘাত : Arnica, Opium, Hypericum
মেরুদণ্ডে আঘাত : Hypericum, Arnica China, Arnica, Secale Cornutum
ফুসফুসে কফ জমাট : Antimonium Tart, Ipecac, Sambucus
স্নায়বিক সাড়া নেই : Opium, Hydrocyanic Acid, Camphora
ধাপ ৩:
বিশ্লেষণ ও রেমেডি নির্বাচন:
কেস স্টাডি উদাহরণ:
অবস্থা: একটি প্রি-ম্যাচিউর শিশু। জন্মের সময় ফোর্সেপ ব্যবহার করা হয়েছে। শিশুর ত্বক নীলচে, শ্বাস-প্রশ্বাস নেই। মাথায় ফোলা এবং ফুসফুসে কফ জমাট।
রোগীলিপি বিশ্লেষণ:
মাথায় আঘাত → Arnica 200C বা ০/২ ।
শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ, ত্বক নীলচে → Carbo Vegetabilis 200C বা ০/২ ।
ফুসফুসে কফ জমাট → Antimonium Tart 30C বা ০/২ ।
প্রয়োগ পদ্ধতি:
তাহা হইলে ঔষধের ২০০ বা ০/২ শক্তির একটি অণুবটিকা বা অতি ক্ষুদ্র গ্লোবিউল দুই আউন্স পানির বোতলে দিয়া, সজোরে ১০টি ঝাকি দিয়া রোগীর অবস্থানুসারে ১০ / ১৫ মিনিট অন্তর এক মাএা প্রয়োগ করিবেন।
ধাপ ৪:
ফলাফল পর্যবেক্ষণ ও পুনঃমূল্যায়ন:
প্রতিটি প্রয়োগের পর ১০-১৫ মিনিট পর পর শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস, নাড়ি ও তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
যদি শ্বাস-প্রশ্বাস ফিরে আসে, তাহলে পরবর্তী ডোজ বন্ধ রাখতে হবে।
যদি সাড়া না মেলে, পুনরায় রোগীলিপি বিশ্লেষণ করে উপযুক্ত রেমেডি নির্বাচন করতে হবে।
ধাপ ৫:
গুরুত্বপূর্ণ রেমেডি:
1. Carbo Vegetabilis:
মৃত্যুপ্রায় অবস্থা, নীলচে ত্বক, শ্বাস বন্ধ।
2. Camphora:
সম্পূর্ণ ঠান্ডা দেহ, নাড়ি শূন্য।
3. Opium:
প্রসবকালীন আঘাত, মস্তিষ্কে রক্ত জমাট।
4. Antimonium Tart:
ফুসফুসে কফ জমাট, শ্বাস বন্ধ।
5. Hypericum:
মেরুদণ্ডে আঘাত, নার্ভে আঘাত।
6. Arnica:
প্রসবকালীন আঘাত, মাথায় রক্ত জমাট।
উদাহরণ-ভিত্তিক রোগীলিপি বিশ্লেষণ:
কেস ১:
শিশু প্রি-ম্যাচিউর, জন্মের পরপরই শ্বাস-প্রশ্বাস নেই।
ত্বক সম্পূর্ণ নীলচে ও ঠান্ডা।
শিরায় রক্ত সঞ্চালন বন্ধ।
রেমেডি:
Carbo Veg 200C,
Camphora 200C,
কেস ২:
ফোর্সেপ ব্যবহার করে প্রসব, শিশুর মাথায় ফোলা ও রক্ত জমাট।
নাড়ি স্পন্দন খুবই দুর্বল।
রেমেডি:
Arnica 200C,
Opium 200C,
কেস ৩:
গর্ভাবস্থার ইতিহাস: গর্ভাবস্থায় মা সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলেন।
প্রসবের ধরণ: সিজারিয়ান।
জন্মের সময়ের লক্ষণ:
শিশুটি জন্মের পর চিৎকার করেনি।
ত্বক ফ্যাকাসে ও ঠান্ডা।
শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ।
নাড়ি শূন্য।
কেস ৩:
গর্ভাবস্থার ইতিহাস: গর্ভাবস্থায় মা সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলেন।
প্রসবের ধরণ: সিজারিয়ান।
জন্মের সময়ের লক্ষণ:
শিশুটি জন্মের পর চিৎকার করেনি।ত্বক ফ্যাকাসে ও ঠান্ডা।শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ।নাড়ি শূন্য।
রেমেডি বিশ্লেষণ:
গর্ভাবস্থায় আঘাতজনিত সমস্যা ও রক্ত সঞ্চালনের অভাব – Arnica 200C।
শিশুর সম্পূর্ণ ঠান্ডা দেহ – Camphora 200C।
কেস ৪:
গর্ভাবস্থার ইতিহাস: প্রিক্ল্যাম্পসিয়া।
প্রসবের ধরণ: নরমাল ডেলিভারি।
জন্মের সময়ের লক্ষণ:
শিশুর ত্বক নীলচে।
শ্বাস-প্রশ্বাস খুব দুর্বল।
ঠান্ডা দেহ।
মুখে ফেনা দেখা যাচ্ছে।
রেমেডি বিশ্লেষণ:
রক্ত সঞ্চালনের ঘাটতি ও শ্বাস-প্রশ্বাস দুর্বল – Carbo Vegetabilis 200C।
ফুসফুসে কফ জমাট ও ফেনা – Antimonium Tartaricum 30C।
কেস ৫:
গর্ভাবস্থার ইতিহাস: মা একাধিকবার গর্ভপাত করেছেন।
প্রসবের ধরণ: ফোর্সেপ ডেলিভারি।
জন্মের সময়ের লক্ষণ:
শিশুর মেরুদণ্ডে আঘাত লেগেছে।
পুরো শরীর অবশ।
চোখ খোলা, কিন্তু কোনো সাড়া নেই।
রেমেডি বিশ্লেষণ:
মেরুদণ্ডে আঘাতজনিত স্নায়বিক সমস্যা – Hypericum 200C।
শরীর অবশ, চেতনা নেই – Opium 200C।
কেস ৬:
গর্ভাবস্থার ইতিহাস: মা সিজারিয়ান সেকশনের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আক্রান্ত।
জন্মের সময়ের লক্ষণ:
শিশুর মাথায় রক্ত জমাট।
ফুসফুসে কফ জমাট।
নাড়ি দুর্বল।
রেমেডি বিশ্লেষণ:
মাথায় রক্ত জমাট – Arnica 200C।
ফুসফুসে কফ জমাট – Antimonium Tartaricum 30C।
রক্ত সঞ্চালনের ঘাটতি – China 30C।
কেস ৭:
গর্ভাবস্থার ইতিহাস: গর্ভাবস্থায় মা প্রচণ্ড মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তায় ভুগেছেন।
প্রসবের ধরণ: প্রি-ম্যাচিউর।
জন্মের সময়ের লক্ষণ:
শিশুটি সম্পূর্ণ অচেতন।
ঠান্ডা দেহ।
শ্বাস-প্রশ্বাস নেই।
রেমেডি বিশ্লেষণ:
মানসিক চাপ ও ভয়জনিত কারণে চেতনা হারানো – Opium 200C।
শরীর সম্পূর্ণ ঠান্ডা – Camphora 200C।
-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি,
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা
প্রভাষক,
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ।
আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ।
>Share by:
Make a comments as guest/by name or from your facebook:
Make a comment by facebook: