মস্তকে শোণিতার্বুদ ( টিউমার)
(Cephal-hema-toma)
পূর্বোক্ত স্ফীতির (swelling or caput succedaneum) নিকটস্থ অস্থিবেষ্টের (periosteum) ঝিল্লীর নিম্নে রক্তক্ষরণ হইয়া এই টিউমার বা অর্বুদ জন্মে। ইহার নাম সিফালহিমাটোমা। নিম্নলিখিত কারণে ইহা জন্মিয়া থাকে
(ক) প্রসবকালে শিশুর মস্তকের ত্বকের তত্ত্ব (tissue of the head skin) আঘাত পাইয়া তথায় রস সঞ্চিত হয়।
(খ) ঐ স্থানের ধমনী ছিন্ন (rupture) হইয়া এইরূপ অর্বুদ জন্মিতে পারে।
(গ) প্রসবদ্বারের সঙ্কীর্ণতার জন্য প্রথম পোয়াতিদের সন্তানদের মধ্যে ইহা বেশি দেখা যায়।
প্রথমে ইহার ভিতর জলবৎ তরল পদার্থ অবস্থিতি করায় ইহা তলতল করে। আঙ্গুল দিয়া টোকা দিলে তরলবৎ অনুভূতি (fluctuation) পাওয়া যায়, পরে ইহা কঠিন আকার ধারণ করে।
আর্নিকা : প্রসবকালে আঘাত কারণ বলিয়া নির্ণীত হইলে আর্নিকা সেবনে এবং উহার মূল অরিষ্ট কিঞ্চিৎ জলে মিশাইয়া বাহ্য প্রয়োগে উপকার পাওয়া যাইবে।
ক্যাল্কেরিয়া কার্ব : শিশুর মস্তকটি অত্যধিক মোটা হইলে ইহা উপযোগিতার সহিত ব্যবহৃত হইতে পারে।
ক্যাল্কেরিয়া ফুওরিকা : ইহা রক্তময় অর্বুদের একটি উৎকৃষ্ট ঔষধ, সর্বোৎকৃষ্ট ঔষধ বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। অর্বুদ শক্ত এবং আঘাত লাগার অর্বুদের কারণ হইলে ইহা আরও উপযোগী হইয়া থাকে।
ক্যাল্কেরিয়া ফস : এই ঔষধটি রক্তময় অর্বুদে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। শিশুর শরীর শীর্ণ, কঙ্কালের ন্যায় অথচ তার পেট ও মাথা মোটা। স্ক্রোফুলা এবং রিকেটধাতুর শিশুদের পক্ষেই বিশেষ উপযোগী।
হিপার সালফার : অর্বুদে পুঁজ সঞ্চার হইয়া থাকিলে ব্যবহৃত হয়।
কেলি আয়োড : - অস্থিবেষ্ট বা পেরিয়স্টিয়ামের উপর অর্বুদ হইলে, ইহা বিশেষ ফলপ্রদ হয়।
সিলিসিয়া : অর্বুদ ফাটিয়া গিয়া খানিকটা পুঁজরক্ত বাহির হইয়া গেলে ক্ষত শুকাইবার জন্য ইহা একটি উৎকৃষ্ট ঔষধ।
মস্তকে শোণিতার্বুদ (Cephalhematoma):
গভীর বিশ্লেষণ।
সংজ্ঞা:
Cephal-hema-toma (সেফাল-হেমা-টোমা) হলো মাথার খুলি ও পেরিওস্টিয়ামের (হাড়ের উপর স্তর) মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধার ফলে সৃষ্ট ফোলাভাব। এটি মাথার খুলির উপরিভাগে দেখা যায় এবং এটি মাথার খুলি ও ত্বকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
এটি সাধারণত প্রসবকালীন সময়ে বা মাথায় আঘাতজনিত কারণে ঘটে।
শোণিতার্বুদ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে।
এটি হাড়ের সীমা অতিক্রম করে না এবং খুলির নির্দিষ্ট অংশেই সীমাবদ্ধ থাকে।
Cephalhematoma-এর স্তরসমূহ:
Cephalhematoma-এর রক্ত জমাট বাঁধার স্তরগুলো নিম্নরূপঃ
1. স্কাল্প (Scalp): বহির্বর্তী স্তর।
2. গালেয়া অ্যাপোনিউরোটিকা (Galea Aponeurotica): স্কাল্প ও খুলির মধ্যবর্তী স্তর।
3. পেরিওস্টিয়াম (Periosteum): খুলি ঢেকে রাখা স্তর।
4. হাড় (Bone): মস্তকের খুলি।
Cephalhematoma শুধুমাত্র পেরিওস্টিয়ামের নীচে রক্ত সঞ্চালিত হয়ে গঠিত হয়। এটি স্কাল্প বা গালেয়া অ্যাপোনিউরোটিকাতে পৌঁছায় না।
কারণসমূহ:
1. জন্মের সময় আঘাত:
ফোর্সেপ বা ভ্যাকুয়াম ব্যবহারের ফলে।দীর্ঘ সময় ধরে প্রসব প্রক্রিয়া।
প্রসবকালীন মাথায় অতিরিক্ত চাপ পড়লে।
2. আঘাত বা দুর্ঘটনা:
বড়দের ক্ষেত্রে মাথায় আঘাত বা দুর্ঘটনা।শিশুর মাথায় পড়ে যাওয়া।
3. রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা:
হিমোফিলিয়া বা অন্য কোনো রক্ত জমাট বাঁধার রোগ।
রক্তের প্লেটলেট কমে গেলে।
4. হাড়ের গঠনজনিত ত্রুটি:
অস্টিওজেনেসিস ইমপারফেক্টা।
হাড় ভঙ্গুর বা দুর্বল হলে সহজেই রক্তপাত হতে পারে।
লক্ষণসমূহ:
প্রাথমিক পর্যায় (১-৩ দিন) :
লক্ষণসমূহ : নরম, স্পঞ্জি ফোলাভাব। রক্ত জমাট বাঁধতে থাকে।
মধ্যবর্তী (৩-৭ দিন) পর্যায় :
লক্ষণসমূহ : ফোলাভাব শক্ত হতে থাকে। রক্ত জমাট বাঁধা শুরু করে।
পরবর্তী (৭-১৪ দিন) পর্যায়:
লক্ষণসমূহ: রক্ত শোষিত হয়, ফোলাভাব ধীরে ধীরে কমে আসে।
চূড়ান্ত (১৪-২১ দিন) পর্যায় :
B সম্পূর্ণ শোষিত হয় এবং স্বাভাবিক হয়ে আসে।
জটিলতাসমূহ:
1. জন্ডিস (Jaundice):
রক্ত জমাট বাঁধা অংশ শোষিত হলে বিলিরুবিন উৎপন্ন হয়।
অতিরিক্ত বিলিরুবিন সঞ্চিত হলে ত্বক ও চোখ হলুদাভ হয়।
2. আয়রন স্বল্পতা (Anemia):
রক্তক্ষরণের ফলে আয়রনের ঘাটতি হতে পারে।
3. সংক্রমণ (Infection):
রক্ত জমাট বাঁধা স্থানে জীবাণু প্রবেশ করলে সংক্রমণ হতে পারে।
4. ক্যালসিফিকেশন (Calcification):
জমাট বাঁধা রক্তটি শোষিত না হলে সেখানে ক্যালসিয়াম জমে শক্ত পিণ্ড তৈরি হতে পারে।
এটি দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা বা কুণ্ডলীভূত অংশ সৃষ্টি করতে পারে।
নির্ণয় পদ্ধতি:
1. শারীরিক পরীক্ষা:
ফোলাভাবের আকৃতি, আকার ও ধরন পর্যবেক্ষণ।
স্পর্শ করে দেখতে ব্যথা বা কোমলতা রয়েছে কি না।
2. ইমেজিং টেস্ট:
আলট্রাসনোগ্রাফি: ফোলাভাবের অভ্যন্তরীণ গঠন পর্যবেক্ষণ।
সিটি স্ক্যান: রক্ত জমাট বাঁধার গভীরতা নির্ণয়।
এমআরআই: রক্তপাতের উৎস নির্ধারণ।
3. রক্ত পরীক্ষা:
রক্তের হিমোগ্লোবিন, প্লেটলেট ও বিলিরুবিন মাত্রা পরীক্ষা।
সংক্রমণের আশঙ্কায় সি-রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন (CRP) পরীক্ষা।
1. নিরীক্ষণ:
বেশিরভাগ Cephalhematoma নিজে থেকেই সেরে যায়।
প্রতিদিন পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
2. ঠান্ডা সেঁক:
প্রথম ২৪-৪৮ ঘণ্টা ঠান্ডা সেঁক দেওয়া যেতে পারে।
ব্যথা ও ফোলাভাব কমাতে সহায়ক।
3. ঔষধ:
ব্যথা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল।
সংক্রমণ প্রতিরোধে অ্যান্টিবায়োটিক।
আয়রন ও ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট।
4. শল্যচিকিৎসা (Surgical Intervention):
সংক্রমণ, ক্যালসিফিকেশন বা অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে ড্রেনেজ করতে হতে পারে।
রক্ত জমাট বাঁধা স্থানে সিরিঞ্জের মাধ্যমে রক্ত বের করা হয়।
প্রতিকার ও প্রতিরোধ:
গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চেকআপ।
প্রসবকালীন সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ।
শিশুকে পড়ে যাওয়া বা আঘাত থেকে রক্ষা করা।
মাথায় আঘাত পেলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
পুনরুদ্ধারকাল:
Cephalhematoma সাধারণত ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে শোষিত হয়ে যায়।
বড় আকারের বা জটিল Cephalhematoma-এ শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
ক্যালসিফিকেশন হলে সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধারে ২-৩ মাস সময় লাগতে পারে।
বিশেষ সতর্কতা:
যদি শিশুর জন্ডিস, ইনফেকশন বা অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যায়, তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
Cephalhematoma-এর পাশাপাশি অন্যান্য মাথার আঘাত বা আভ্যন্তরীণ রক্তপাতের ঝুঁকিও বিবেচনায় রাখতে হবে।
Cephalhematoma-এর
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীর শারীরিক ও মানসিক লক্ষণ অনুযায়ী ওষুধ নির্বাচন করা হয়। Cephalhematoma-এর ক্ষেত্রে, আঘাতজনিত রক্তক্ষরণ ও ফোলাভাব নিরাময়ে বেশ কিছু কার্যকরী ওষুধ রয়েছে।
প্রধান হোমিওপ্যাথিক ওষুধসমূহ:
1. Arnica Montana:
লক্ষণ:
আঘাত বা পড়ে যাওয়ার ফলে ফোলাভাব।নীলচে বা কালচে ফোলাভাব।রক্তপাত রোধে কার্যকর।ফোলাভাব চাপ দিলে ব্যথা বৃদ্ধি পায়।শিশুর মাথায় আঘাতজনিত কারণে প্রথমিক চিকিৎসা।
2. Calcarea Phosphorica:
লক্ষণ:
হাড়ের গঠন ও পুনর্গঠনে কার্যকর।শিশুর মাথার খুলির উপর ফোলা বা শক্ত পিণ্ড।রক্ত সঞ্চালনজনিত কারণে সৃষ্ট ফোলাভাব।ফোলাভাবের ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে যাওয়া।
3. Symphytum Officinale:
লক্ষণ:
আঘাতজনিত হাড়ের ব্যথা ও ফোলাভাব।হাড়ের ফাটল বা ভাঙনের ক্ষেত্রে কার্যকর।পেরিওস্টিয়ামের (হাড়ের আবরণী) আঘাত।শক্ত বা ক্যালসিফাইড অংশ কমিয়ে আনে।
Arnica-এর পর Symphytum ব্যবহার করা উত্তম।-
4. Bellis Perennis:
লক্ষণ:
গভীর টিস্যু বা মাংসপেশির আঘাত।প্রসব পরবর্তী ফোলাভাব বা রক্তক্ষরণ।ঠান্ডা সেঁকেও আরাম না পেলে।আঘাতের স্থানে নীলচে রঙ ও চাপ দিয়ে ফোলা।
5. Ruta Graveolens:
লক্ষণ:
আঘাতজনিত হাড়ের ব্যথা।পেরিওস্টিয়ামের ব্যথা।দীর্ঘস্থায়ী ফোলাভাব বা ক্যালসিফিকেশন।ফোলাভাব স্পর্শে নরম এবং চাপ দিলে ব্যথা।
6. Calcarea Fluorica:
লক্ষণ:
শক্ত ও ক্যালসিফাইড ফোলাভাব।দীর্ঘস্থায়ী রক্ত জমাট বাঁধা।হাড়ের উপরে শক্ত পিণ্ড।
7. Hypericum Perforatum:
লক্ষণ:
স্নায়বিক ব্যথা বা আঘাতজনিত স্নায়ুর ব্যথা।আঘাতের কারণে স্নায়ুর ধমনীতে ব্যথা।রক্ত জমাট বাঁধার সাথে স্নায়বিক যন্ত্রণা।
অতিরিক্ত যত্ন ও নির্দেশনা:
আঘাতের পরপরই 200C প্রদান করুন।
যদি ফোলাভাব শক্ত হয়ে যায়, তবে Calcarea Phos এবং Symphytum পরপর ব্যবহার করা যেতে পারে।
সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকলে Hypericum এবং Bellis Perennis প্রয়োগ করা যেতে পারে।
যদি ফোলাভাব বা জমাট বাঁধা স্থানে ক্যালসিফিকেশন দেখা যায়, তবে Calcarea Fluorica 6X বা 12X দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করতে হবে।
শিশুর ক্ষেত্রে দুধ, ক্যালসিয়াম ও আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দিন।
আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে ঠান্ডা সেঁক দিন এবং মাথায় অতিরিক্ত চাপ পড়া থেকে রক্ষা করুন।
গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা:
Cephalhematoma দীর্ঘস্থায়ী হলে এবং ক্যালসিফিকেশন দেখা দিলে, শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
মাথার আঘাতজনিত কারণে যদি শিশু খিঁচুনি, জ্বর, অতিরিক্ত কান্না বা অস্বাভাবিক আচরণ করে, তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।
-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি,
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা
প্রভাষক,
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ।
আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ।
>Share by:
Make a comments as guest/by name or from your facebook:
Make a comment by facebook: