নাভীর অস্ত্রবৃদ্ধি
(Navel Rupture of Umbilical Hernia)
অন্ত্রের কতকটা অংশ নাভিকুণ্ডল দিয়া ঠেলিয়া বাহির হইয়া আসে, তাহাতে ঐ স্থান উঁচু হয়।
ইহা দুই প্রকার হয়।
জন্মগত (congenital) কারণ হইতে জাত। উদর গহ্বরের সম্মুখের প্রাচীর (anterior wall) ভালোভাবে পুষ্ট হয় না বা পূর্ণতা লাভ করে না, সেজন্য উদরমধ্যের অস্ত্রের অংশ নাভিমধ্যে প্রবিষ্ট হয়। কোন কোন শিশুর ইহা অর্জিত (acquired) | কোষ্ঠবদ্ধতা বা আমাশয়ে কোঁথপাড়ায় বা একটু বয়স্ক শিশুতে হুপিং কাশির আক্ষেপের জন্য নাভিপ্রদেশে চোট লাগা হইতে এরূপ হইয়া থাকে।
চিকিৎসা
ঘোরোয়া চিকিৎসা :
শিশুর এই সাংঘাতিক উপসর্গ টের পাইবামাত্রই তাহার প্রতিকারের ব্যবস্থা করিবে। একখানি কর্ক জায়ফলের অর্ধাংশ আকারে (shaped like the half of a nutmeg) লইয়া উহা একখানি পাতলা পরিষ্কার ন্যাকড়া দিয়া ঢাকিয়া (বোতামের আকার করিয়া) একটি ব্যান্ডেজের সঙ্গে সেলাই করিবে। কর্কের তলদেশ মধ্যস্থানে থাকিবে। কর্কের শীর্ষভাগ ধরিয়া বিদারণ স্থলে (opening) চাপ দিবে এবং শিশুর গাত্রে ৩।৪ ফের করিয়া জড়াইয়া বাঁধিয়া রাখিবে।।
আভ্যন্তরিক সেবনের জন্য নিম্নলিখিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ব্যবহার করিবে:
আর্নিকা : নাভিপ্রদেশে চোট লাগা কারণ হইলে বিশেষ ফলপ্রদ হইয়া থাকে।
নাক্স ভমিকা : একমাত্র এই ঔষধেই অনেক সময়ে ব্যাধি নির্দোষ আরোগ্য হইয়া থাকে।
ক্যামোমিলা : শিশু অত্যন্ত খিটখিটে এবং ক্রন্দনশীল হইলে ইহা বিশেষ উপযোগিতার সহিত ব্যবহৃত হয়।
সালফার : দুর্দম্য রোগে অন্য সুনির্বাচিত ঔষধ প্রয়োগে উপকার না পাইলে, ব্যবহার করিবে।
সাইলিসিয়া : নাভিমূলে ক্ষত জন্মিলে ইহা বিশেষ উপযোগিতার সহিত ব্যবহৃত হইয়া থাকে।
নাভীর অস্ত্রবৃদ্ধি (Umbilical Hernia) — বিস্তারিত আলোচনা (বাংলায়):
নাভীর অস্ত্রবৃদ্ধি (Umbilical Hernia)
সংজ্ঞা (Definition):
নাভীর অস্ত্রবৃদ্ধি বলতে বোঝায়, যখন পেটের অভ্যন্তরের কোনও অঙ্গ (যেমনঃ অন্ত্র) বা চর্বি নাভীর কাছের পেশির দুর্বল অংশ দিয়ে বাইরে ফেঁসে যায় বা স্ফীত হয়ে উঠে, তখন তাকে Umbilical Hernia বলা হয়।
বাংলায় একে নাভীর গিঁট ফোলা বা নাভীর ফাঁপা বা নাভীর অস্ত্রবৃদ্ধি বলেও চিহ্নিত করা হয়।
কারণসমূহ (Causes):
Umbilical Hernia সাধারণত নিচের কারণগুলোর জন্য হয়ে থাকে—
1. শিশুদের ক্ষেত্রে:
জন্মের সময় নাভীর পেশি সম্পূর্ণরূপে না জোড়া লাগা।
অপরিণত বা কম ওজন নিয়ে জন্মানো শিশু।
অতিরিক্ত কান্না বা কাশি, যা পেটের চাপ বাড়ায়।
2. বড়দের ক্ষেত্রে:
অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা।
অতিরিক্ত ভার উত্তোলন।
বারবার গর্ভধারণ (Multiple pregnancies)।
পেটের তরল জমা (Ascites)।
দীর্ঘমেয়াদী কাশি বা কোষ্ঠকাঠিন্য।
পূর্বে পেটের অস্ত্রোপচার।
নাভীর আশেপাশে নরম বা শক্ত স্ফীতি (মাঝেমধ্যে ব্যথাযুক্ত)।
হাঁচি, কাশি, কান্না বা হাঁটার সময় স্ফীতি বড় হয়ে দেখা যায়।
শুয়ে গেলে স্ফীতি ছোট বা অদৃশ্য হয়ে যায়।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে হঠাৎ ব্যথা বেড়ে যায় বা বমি হয় (Strangulated hernia হলে)।
জটিলতা (Complications):
Strangulation: যখন Hernia-র অংশ আটকে গিয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, তখন সেটা খুবই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
Obstruction: অন্ত্র আটকে গিয়ে পেট ব্যথা, বমি, ও বায়ু/মল না হওয়া দেখা দিতে পারে।
রোগ নির্ণয় (Diagnosis):
শারীরিক পরীক্ষা (নাভীর ওপর চাপ দিলে স্ফীতি ভিতরে চলে যায় কি না)।
আল্ট্রাসোনোগ্রাফি বা সিটি স্ক্যান প্রয়োজন হতে পারে জটিলতার ক্ষেত্রে।
চিকিৎসা (Treatment):
১. শিশুদের ক্ষেত্রে:
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিকিৎসা ছাড়াই ২-৩ বছরের মধ্যে সেরে যায়।
৪ বছর বয়সের পরও থাকলে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন।
২. বড়দের ক্ষেত্রে:
যদি Hernia বড় হয়, ব্যথা দেয়, অথবা আটকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবে অস্ত্রোপচার (Surgical Repair) প্রয়োজন।
Open Surgery বা Laparoscopic Surgery মাধ্যমে Mesh বসিয়ে পেশি শক্ত করা হয়।
প্রতিরোধ (Prevention):
শিশুর জন্মের সময় যথাযথ প্রসবসেবা।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
অতিরিক্ত ভার উত্তোলন এড়িয়ে চলা।
দীর্ঘমেয়াদি কাশি বা কোষ্ঠকাঠিন্য হলে চিকিৎসা নেওয়া।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় সম্ভাব্য ওষুধ (সচেতনতার জন্য):
(নিচের ওষুধগুলো অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ব্যবহারযোগ্য)
Nux Vomica: কোষ্ঠকাঠিন্য ও গ্যাস সহ নাভীর হের্নিয়ার জন্য।
Calcarea Carbonica: স্থূলতা ও দুর্বল পেশির জন্য।
Lycopodium: পেট ফাঁপা, গ্যাস, ডান পাশে ব্যথা থাকলে। পেটের ডান পাশে গ্যাস, বায়ু আটকে থাকা, ক্ষুধা কম থাকা, নাভীর নিচে স্ফীতি ও ব্যথা। বাচ্চা বা বড়দের ক্ষেত্রে,
Bellis Perennis: হের্নিয়া ও পেশির আঘাতজনিত সমস্যা হলে।
Sulphur : দীর্ঘস্থায়ী হের্নিয়া, গরম সহ্য করতে না পারা, নাভী ফোলা ও তাতে চুলকানি বা জ্বালাভাব। সকালে খালি পেটে প্রয়োগে ভালো ফল দেয়।
Opium : নাভীতে স্ফীতি থাকে, কিন্তু রোগী একদম চিন্তাহীন, মলত্যাগের ইচ্ছা কম বা অনিয়মিত। শিশুদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগযোগ্য।
কখন অস্ত্রোপচার প্রয়োজন?
Umbilical Hernia সাধারণত দুইভাবে দেখা যায়:
১. অপারেশন ছাড়াও সেরে যেতে পারে (বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে):
শিশুর বয়স যদি ১–২ বছরের মধ্যে হয়।স্ফীতির আকার ছোট হয় (১.৫ সেমি বা তার কম)।ধীরে ধীরে কমে আসছে, বাড়ছে না।কোনো ব্যথা বা বমি নেই।
২. অস্ত্রোপচার প্রয়োজন (বড়দের ও জটিলতার ক্ষেত্রে):
নিচের যেকোনো অবস্থায় অপারেশন বাধ্যতামূলক:নাভীর স্ফীতি ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে।স্ফীতিতে ব্যথা হয় বা শক্ত হয়ে থাকে।অন্ত্র আটকে গেছে (Strangulated hernia) — এতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায় ও জীবন ঝুঁকি হয়।প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে সাধারণত অপারেশন ছাড়া ভালোভাবে সারে না।পেটের চামড়ায় লালচে রঙ হয়ে যাওয়া, বমি হওয়া, জ্বর এসব জটিলতা দেখা দিলে।
অস্ত্রোপচারের প্রকারভেদ:
১. Open Hernia Repair (খোলা পদ্ধতি):
সার্জেন একটি কাট দিয়ে ফোলা অংশ ভিতরে ঢুকিয়ে পেশি সেলাই করেন।কখনো কখনো Mesh বসানো হয়।
২. Laparoscopic Surgery (ছিদ্র পদ্ধতি):
ছোট ছোট ছিদ্র করে ক্যামেরা দিয়ে ভেতরের কাজ করা হয়।ব্যথা কম, দ্রুত সেরে ওঠা যায়।
অস্ত্রোপচার ছাড়া চিকিৎসা কি সম্ভব?
হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে সম্ভব। বিশেষ করে:
শিশুদের হের্নিয়া (বেশিরভাগ নিজে থেকেই সেরে যায়)।
ছোট সাইজের হের্নিয়া, যেটি বাড়ছে না এবং উপসর্গহীন।
হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় উপশমের সম্ভাবনা থাকলেও তা দীর্ঘমেয়াদি সময় ও নিয়মিত ফলোআপের ওপর নির্ভর করে।
উপসংহার (Conclusion):
নাভীর অস্ত্রবৃদ্ধি ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে সাধারণত ক্ষতিকর না হলেও বড়দের ক্ষেত্রে এটি গুরুতর হয়ে উঠতে পারে।
নাভীর অস্ত্রবৃদ্ধি গর্ভবতী নারী থেকে শুরু করে শিশু বা বয়স্ক – যেকোনো বয়সেই দেখা দিতে পারে। এটি সময়মতো নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা না পেলে জটিল রূপ নিতে পারে।
হোমিওপ্যাথি, যদি লক্ষণ অনুযায়ী যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে অস্ত্রোপচার ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে উপশম পাওয়া সম্ভব।
Umbilical Hernia একটি অস্ত্রোপচারযোগ্য রোগ।
শিশুদের ক্ষেত্রে সময় দিলে ভালো হয়ে যেতে পারে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে বা যদি জটিলতা থাকে, তাহলে অপারেশনই সবচেয়ে নিরাপদ ও কার্যকর পন্থা।
সময়মতো চিকিৎসা না নিলে অন্ত্র আটকে গিয়ে জীবনহানির ঝুঁকি পর্যন্ত তৈরি হতে পারে। তাই লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি,
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা
প্রভাষক,
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ।
আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ।
>Share by:
Make a comments as guest/by name or from your facebook:
Make a comment by facebook: