আসছে গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্মকালীন বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ সমূহের ঘরোয়া এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি

গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ও ঘামের প্রভাবে চর্মরোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। নিচে কিছু সাধারণ গ্রীষ্মকালীন চর্মরোগ, তার ঘরোয়া প্রতিকার এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা আলোচনা করা হলো:


সাধারণ গ্রীষ্মকালীন চর্মরোগসমূহ

1. ঘামাচি (Heat Rash)

2. চুলকানি (Fungal infection)

3. সানবার্ন (Sunburn)

4. দাদ (Tinea/Ringworm)

5. একজিমা

6. অ্যালার্জি বা চামড়ায় ফুসকুড়ি

গ্রীষ্মকালে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ দেখা যায় এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতিতে এ রোগসমূহ অত্যন্ত কার্যকরভাবে চিকিৎসা করা যায়। হোমিওপ্যাথির মূলনীতি হলো "সদৃশ সদৃশকে নিরাময় করে" (Similia Similibus Curentur)। এখানে রোগীর শারীরিক ও মানসিক লক্ষণ, রোগের প্রকৃতি, অবস্থান, সময় অনুযায়ী ওষুধ নির্বাচন করা হয়।

চর্মরোগের হোমিওপ্যাথিক দর্শন :  (Homoeopathic Philosophy of Skin Diseases)

হ্যানিম্যান তার Organon of Medicine-এ বলেছেন:

> “A skin eruption is often the external manifestation of an internal derangement.”

অর্থাৎ, চর্মরোগ শুধুই বাহ্যিক নয় — এটি শরীরের গভীর কোনো বিকারের বাহ্যিক চিহ্নমাত্র। তাই হোমিওপ্যাথি শুধুমাত্র চামড়ায় ওষুধ লাগিয়ে বা উপসর্গ চাপিয়ে রাখে না; বরং গোটা মানুষকে নিরাময় করে।

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা কৌশল (Treatment Strategy)

১. কনস্টিটিউশনাল রেমেডি নির্বাচন:

রোগীর শারীরিক গঠন, ত্বকের প্রকৃতি, মানসিক অবস্থা, রোগের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে মূল ওষুধ নির্বাচন করা হয়।

২. ইন্টারকুরেন্ট ওষুধ:

যদি বারবার চর্মরোগ হয়, তবে Psorinum, Tuberculinum, বা Sulphur ইন্টারকুরেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

৩. লোকাল অ্যাপ্লিকেশন এড়ানো:

হোমিওপ্যাথিতে ত্বকে সরাসরি কিছু লাগানো নিরুৎসাহিত করা হয়। কারণ এতে উপসর্গ চেপে গিয়ে ভেতরের রোগ গভীরতর হতে পারে।

নিচে গ্রীষ্মকালীন সাধারণ চর্মরোগগুলোর জন্য ঘরোয়া ও  হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:

---




১. ঘামাচি (Prickly Heat / Heat Rash)

কারণ:
গ্রীষ্মকালে অতিরিক্ত ঘামের কারণে ঘামগ্রন্থির ছিদ্র বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ঘাম চামড়ার নিচে জমে গিয়ে ছোট ছোট লাল দানা ও চুলকানির সৃষ্টি করে।

উপসর্গ:

গলা, পিঠ, বুক, কুচকি ও বগলের আশপাশে লালচে ছোট দানা

জ্বালাপোড়া ও চুলকানি

তাপমাত্রা বাড়লে উপসর্গ বৃদ্ধি পায়


ঘরোয়া চিকিৎসা:

নিমপাতা ও বেসন মিশিয়ে গোসল করা

বেবি পাউডার ব্যবহার করা

ঠান্ডা পানি দিয়ে দিনে ২-৩ বার গোসল


হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা:

ঘামাচি (Miliaria / Heat Rash)

প্যাথলজি:

ঘামগ্রন্থির মুখ বন্ধ হয়ে ঘাম আটকে যায়, ত্বকের নিচে জমে যায়।

সুসংগঠিত হোমিও বিশ্লেষণ:

Sulphur:

কনস্টিটিউশন: শুকনো, গরম শরীর, অলস, মলত্যাগ বিলম্বিত হয়।

রিপার্টরি: Skin – Eruptions – itching – warm – agg.

মানসিক: অহংকারী, মলিন, আত্মপ্রেমে মগ্ন।


Natrum Mur:

কনস্টিটিউশন: রুচিশীল, সংবেদনশীল, দুঃখ লুকায়, একাকী থাকতে চায়।

ত্বক: মুখে তেলতেলে ভাব, লোমকূপ বড়, ঘামাচি সূর্যে বেড়ে যায়।


Calcarea Carb:

কনস্টিটিউশন: মোটা, ঘামে ভেজা, কুঁচকানো ত্বক, মাথায় ঘাম বেশি।

ঘামাচি সহজেই হয়, শরীর ঠান্ডা থাকে।

---

২. দাদ (Tinea / Ringworm)

কারণ:

একটি ছত্রাক (Fungus) দ্বারা সংক্রমিত হয়। গ্রীষ্মকালে ঘাম ও আর্দ্রতার কারণে দাদ বেশি হয়।

উপসর্গ:

গোলাকার দাগ, মাঝখান হালকা ও চারপাশে লাল

তীব্র চুলকানি, বিশেষ করে রাতে

ধীরে ধীরে দাগ বড় হয়


ঘরোয়া চিকিৎসা:

তুলসী পাতার রস ব্যবহার

লেবুর রস ও নারিকেল তেল মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে লাগানো

পরিষ্কার ও শুকনো কাপড় ব্যবহার


হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা:

দাদ (Tinea / Dermatophytosis)

প্যাথলজি:

ছত্রাকের সংক্রমণ; কেরাটিনযুক্ত ত্বক, চুল ও নখে আক্রমণ করে।

গভীর হোমিও বিশ্লেষণ:

Tellurium:

দাগ গোলাকার ও আঁচড় দিলে পুঁজ বের হয়।

রিপার্টরি: Skin – eruptions – ringworm-like.

ঘামে বা ভেজা আবহাওয়ায় বেড়ে যায়।


Sepia:

নারীদের চর্মরোগে কার্যকর; হরমোনজনিত সমস্যা থেকে হলে ভালো কাজ করে।

চামড়া শুষ্ক ও বাদামি দাগ।

মানসিক: ক্লান্ত, পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধে জর্জরিত, চুপচাপ।


Graphites:

আঠালো নির্গমনযুক্ত একজিমা বা দাদ হলে।

ত্বকে ফাটা, মোটা হয়ে যাওয়া।

রিপার্টরি: Skin – eruptions – moist – sticky.

---

৩. চুলকানি (Itching / Scabies / Fungal Infection)

কারণ:

ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকজনিত সংক্রমণ, অ্যালার্জি বা গরমে অতিরিক্ত ঘাম।

উপসর্গ:

তীব্র চুলকানি, বিশেষ করে রাতে

লালচে দাগ ও মাঝে মাঝে ফোস্কা

আঁচড়ানোর ফলে রক্ত বা পুঁজ


ঘরোয়া চিকিৎসা:

নিমপাতা দিয়ে গোসল

চন্দনের গুঁড়া ও গোলাপজল মিশিয়ে লাগানো

তুলসী ও হলুদের পেস্ট ব্যবহার


হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা:

Psorinum: গন্ধযুক্ত শরীর, সপ্তাহে একবার ব্যবহার

Hepar Sulph: খোসা উঠা, ফোড়া হওয়া

Rhus Tox: পানি লাগলে আরাম পাওয়া, বৃষ্টির সময় বাড়ে

---

৪. সানবার্ন (Sunburn)

কারণ:

সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি (UV rays) সরাসরি ত্বকে পড়লে চামড়া পুড়ে যায়।

উপসর্গ:

চামড়া লাল হয়ে যায়

ফোস্কা পড়ে যেতে পারে

জ্বালাপোড়া ও ব্যথা


ঘরোয়া চিকিৎসা:

ঠান্ডা দুধ বা দই লাগানো

অ্যালোভেরা জেল ব্যবহার

শসা বাটলে আরাম পাওয়া যায়


হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা:

স্ক্যাবিস / চুলকানি (Scabies / Prurigo)

প্যাথলজি:

সারকোপটিস স্ক্যাবেই নামক পরজীবীর সংক্রমণ, ঘন ঘন চুলকানি

Psorinum:

গভীর প্রডিসপোজিশন, বারবার রোগ হয়।

কনস্টিটিউশন: অস্বাস্থ্যকর, গন্ধযুক্ত ঘাম ও শরীর, ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না।

রিপার্টরি: Skin – eruptions – recurrent.


Hepar Sulph:

খোসপাঁচড়া বা ফোঁড়া হলে, স্পর্শে ব্যথা।

ঠান্ডা আবহাওয়ায় বেড়ে যায়।


Sulphur:

সর্বজনীন চর্মরোগ প্রতিকারক।

রিপার্টরি: Skin – unhealthy; every little injury suppurates.

---

৫. একজিমা (Eczema)

কারণ:

জেনেটিক প্রবণতা, অ্যালার্জি, ঘাম জমে থাকা বা রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার।

উপসর্গ:

শুষ্ক, লাল ও খসখসে ত্বক

মাঝে মাঝে তরল বের হয়

তীব্র চুলকানি


ঘরোয়া চিকিৎসা:

নারিকেল তেল ও হলুদের মিশ্রণ

ওটমিল বাথ (গোসলের পানিতে ওটমিল)

সরিষার তেল ও নিমপাতা সিদ্ধ করে মালিশ


হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা:

একজিমা (Eczema / Dermatitis)

প্যাথলজি:

ইমিউন প্রতিক্রিয়ায় চামড়ায় প্রদাহ, চুলকানি, ফাটল।

হোমিওপ্যাথিক দৃষ্টিভঙ্গি:

একজিমা হল শরীরের গভীর প্রবণতা, যেটি দমন করলে অ্যাজমা বা অন্যান্য গভীর রোগ হতে পারে। তাই হোমিও চিকিৎসা উপরে নয়, ভেতর থেকে নিরাময় করে।

Mezereum:

ফুসকুড়ি হয় ও তাতে সাদা রস বা পুঁজ হয়।

তীব্র জ্বালাপোড়া ও রাতে বেড়ে যায়।

মানসিক: অত্যন্ত সংবেদনশীল ও নিঃসঙ্গ।


Rhus tox:

গরম পানিতে গোসল করলে উপশম হয়।

ফোস্কা ও প্রদাহ দেখা যায়।

ফাংগাল একজিমা বা সংক্রমণে উপকারী।


---

প্রতিরোধমূলক পরামর্শ:

1. সুতির ঢিলেঢালা জামা পরুন

2. দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন

3. ঘামে ভেজা জামা দ্রুত পাল্টান

4. প্রতিদিন একবার করে গোসল করুন

5. রোদে বের হলে ছাতা বা ক্যাপ ব্যবহার করুন

6. চর্মরোগ হলে চুলকান না করে দ্রুত চিকিৎসা নিন। 

শেষ কথাঃ 

হোমিওপ্যাথি ও গ্রীষ্মকালীন চর্মরোগে সার্বিক সুস্থতা : 

চর্মরোগ (Skin Diseases) যেমন – দাদ, সোরিয়াসিস, একজিমা, এলার্জি, চুলকানি ইত্যাদির চিকিৎসায় এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদ – তিনটি চিকিৎসা পদ্ধতিরই নিজস্ব বিশেষত্ব আছে।

চর্মরোগের ক্ষেত্রে, 
এলোপ্যাথি উপসর্গ উপশমে দ্রুত, 
কিন্তু হোমিওপ্যাথি রোগ নির্মূলে বেশি কার্যকর। 
আপনি রোগের প্রকৃতি, রোগীর সহ্যশক্তি, এবং সময় বিবেচনা করে পদ্ধতি নির্বাচন করুন।

হোমিওপ্যাথি চর্মরোগকে শুধু ত্বকের সমস্যা হিসেবে দেখে না — এটি পুরো মানুষকে দেখে। হোমিও চিকিৎসায় চর্মরোগের পুনরাবৃত্তি বন্ধ হয়, রোগের মূল কারণ ধ্বংস হয় এবং রোগী দেহ-মনে সুস্থ থাকে।




-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি, 
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা    
প্রভাষক, 
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ। 

আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। 

>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন