হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় ওষুধ সিলেকশনের নিয়মাবলী এবং ওষুধ গ্রহণের নিয়মাবলী.

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় ওষুধ সিলেকশন ও গ্রহণের নিয়মাবলী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সঠিকভাবে নির্ধারণ করা ওষুধ এবং সঠিক ডোজ না হলে চিকিৎসার ফলাফল কার্যকর নাও হতে পারে। হোমিওপ্যাথির মূল নীতি হল "সমস্যার মতো সমস্যা" বা Similia Similibus Curantur, যার মাধ্যমে রোগীর উপসর্গ ও সমস্যা অনুযায়ী ওষুধ নির্ধারণ করা হয়।

১. ওষুধ সিলেকশনের নিয়মাবলী :

‌‌(i) রোগীর শারীরিক ও মানসিক উপসর্গ বিশ্লেষণ :

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা রোগীর সামগ্রিক অবস্থা, অর্থাৎ শারীরিক ও মানসিক উপসর্গের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। কোনো নির্দিষ্ট রোগের জন্য নির্দিষ্ট একটি ওষুধ ব্যবহার করা হয় না, বরং রোগীর ব্যক্তিগত লক্ষণগুলোর উপর ভিত্তি করে ওষুধ নির্বাচন করা হয়।

যেমন, একজন রোগী যদি মানসিক অবসাদ, শারীরিক দুর্বলতা, এবং যৌন সমস্যা ভোগে, তবে তাকে এই তিনটি উপসর্গের ভিত্তিতে ওষুধ দেওয়া হবে।




(ii) রোগীর কনস্টিটিউশন (Constitution) :

কনস্টিটিউশন মানে রোগীর শারীরিক গঠন, মানসিক প্রবণতা, এবং আবেগগত অবস্থার সমন্বয়। এটি হোমিওপ্যাথির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কারণ একজন ব্যক্তির শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা সঠিক ওষুধ নির্ধারণে সহায়তা করে।

উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন রোগী খুব দুর্বল ও নিস্তেজ থাকে এবং ছোটখাটো আঘাতেও মেজাজ হারায়, তবে সেই কনস্টিটিউশনের জন্য Calcarea Carbonica ব্যবহৃত হতে পারে।


(iii) ব্যক্তিগত ইতিহাস ও পারিবারিক ইতিহাস :

রোগীর ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক ইতিহাস হোমিওপ্যাথিতে ওষুধ সিলেকশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি কোনো রোগীর পরিবারে জেনেটিক বা দীর্ঘস্থায়ী কোনো রোগের ইতিহাস থাকে, তবে সেটিও বিবেচনায় নেওয়া হয়।

যেমন, কোনো রোগীর পরিবারে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ থাকলে, সেই ইতিহাস দেখে প্রয়োজনীয় ওষুধ নির্বাচন করা হয়।


(iv) উপসর্গের ধরন, তীব্রতা ও সময়কাল :

রোগীর সমস্যা কত দিন ধরে আছে, কিভাবে সেটা শুরু হয়েছে, উপসর্গের তীব্রতা কেমন—এসব দেখে ওষুধ নির্বাচন করা হয়।

কিছু ওষুধ অ্যাকিউট (সাময়িক) অবস্থার জন্য কার্যকর, আবার কিছু ওষুধ ক্রনিক (দীর্ঘস্থায়ী) অবস্থার জন্য কার্যকর। 
যেমন, Aconite অ্যাকিউট সমস্যার জন্য ব্যবহৃত হয়, যেখানে Sulphur ক্রনিক সমস্যায় কার্যকর।


(v) Modalities (পরিবেশগত বা অন্যান্য প্রভাব) :

Modalities বলতে বোঝানো হয় উপসর্গ কোন পরিস্থিতিতে ভালো হয় বা খারাপ হয়। অর্থাৎ, রোগীর অবস্থার উন্নতি বা অবনতি কোন পরিস্থিতিতে হয়।

উদাহরণস্বরূপ, রোগী যদি রাতে বেশি অস্থিরতা অনুভব করে বা গরমে সমস্যা বৃদ্ধি পায়, তবে সেই লক্ষণ অনুযায়ী ওষুধ বেছে নেওয়া হয়।


(vi) মেডিকেল পরীক্ষা ও ডায়াগনোসিস :

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় মেডিকেল রিপোর্ট বা ডায়াগনোসিসের ভিত্তিতেও ওষুধ সিলেকশন করা হতে পারে। যেমন, শুক্রাণু উৎপাদন কম থাকলে চিকিৎসক রোগীর মেডিকেল রিপোর্ট এবং অন্যান্য পরীক্ষা দেখে প্রয়োজনীয় ওষুধ নির্বাচন করতে পারেন।


২. ওষুধ গ্রহণের নিয়মাবলী

‌‌(i) ওষুধের ডোজ :

হোমিওপ্যাথিক ওষুধ সাধারণত ক্ষুদ্র ডোজে (potency) দেওয়া হয়। এটি বিভিন্ন ক্ষমতায় (পটেন্সি) যেমন 6C, 30C, 200C, 1M M/2 ইত্যাদিতে পাওয়া যায়।

রোগের তীব্রতা অনুযায়ী ওষুধের ক্ষমতা (পটেন্সি) নির্ধারণ করা হয়। তীব্র সমস্যায় সাধারণত কম পটেন্সি এবং দীর্ঘস্থায়ী সমস্যায় উচ্চ পটেন্সি ব্যবহার করা হয়। তবে ওষুধের মাত্রা নির্ধারণ করতে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।


(ii) ওষুধ গ্রহণের সময় :

হোমিওপ্যাথিক ওষুধ সাধারণত খালি পেটে বা খাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিট আগে বা পরে নেওয়া উচিত। ওষুধ গ্রহণের আগে এবং পরে অন্তত ১৫-২০ মিনিট কিছু খাওয়া বা পান করা উচিত নয়, বিশেষ করে মসলা, পেঁয়াজ, রসুন, ক্যাফিন ইত্যাদি।

খাবারের সাথে নিলে ওষুধের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে, তাই তা খালি পেটে নেওয়া হয়।


(iii) জিহ্বার নিচে রেখে গ্রহণ :

হোমিওপ্যাথিক ওষুধ সাধারণত  তরল আকারে দেওয়া হয়, যা জিহ্বার নিচে রেখে সেবন  করিলে  এটি দ্রুত শোষিত হয়ে শরীরে কাজ শুরু করে।

তরল ওষুধ ব্যবহার করলে কয়েক ফোঁটা ওষুধ সরাসরি মুখে দেওয়া যেতে পারে বা পানির সাথে মিশিয়ে নেওয়া যেতে পারে।


(iv) ওষুধ গ্রহণের মধ্যে বিরতি :

যদি উচ্চ পটেন্সির ওষুধ ব্যবহার করা হয়, তবে ওষুধের মধ্যে সাধারণত একটি বিরতি রাখা হয়, কারণ হোমিওপ্যাথিক ওষুধ শরীরে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে। ওষুধের পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন অনুযায়ী করা হয়।

তবে অ্যাকিউট অবস্থায় ওষুধের পুনরাবৃত্তি দ্রুত করা যেতে পারে, যেমন প্রতি কয়েক ঘণ্টা পর পর।


(v) ওষুধের সঙ্গতিপূর্ণ ব্যবহার :

একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ওষুধ সঠিকভাবে ব্যবহার করা উচিত। চিকিৎসক পরামর্শ দিলে পুরো কোর্স সম্পন্ন করতে হবে।

ওষুধ বন্ধ করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, কারণ মাঝে মাঝে ওষুধ হঠাৎ বন্ধ করা হলে সমস্যার পুনরাবৃত্তি হতে পারে।


(vi) আনুষঙ্গিক পদার্থ থেকে দূরে থাকা :

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সময় কিছু পদার্থ যেমন ক্যাফিন, মসলা, রসুন, পেঁয়াজ, এবং ধূমপান ইত্যাদি থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়, কারণ এগুলি ওষুধের কার্যকারিতা ব্যাহত করতে পারে।

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় গন্ধযুক্ত বা তীব্র স্বাদের খাবার ও পানীয় পরিহার করা উচিত।


৩. ওষুধের প্রতিক্রিয়া বা হেরিং'স ল আইন (Hering's Law of Cure)

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় একটি সাধারণ নীতি রয়েছে, যার নাম Hering's Law of Cure। এটি বলে যে, ওষুধ প্রয়োগের পরে রোগ প্রথমে শরীরের উপরিভাগ বা বাইরে থেকে ভেতরের দিকে সরে যায়। প্রথমে তীব্র উপসর্গ ভালো হতে শুরু করে, এরপর ক্রমে গভীর সমস্যাগুলি নিরাময় হয়।

ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় কোনো উপসর্গ সাময়িকভাবে বাড়তে পারে, কিন্তু এটি ভালো লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। একে হোমিওপ্যাথিতে "First aggravation" বলা হয়, যা পরে কমে যায়।


উপসংহার:

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় সঠিক ওষুধের নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি রোগীর ব্যক্তিগত উপসর্গ ও শারীরিক-মানসিক অবস্থার উপর নির্ভর করে। সঠিকভাবে ওষুধ গ্রহণের নিয়মাবলী মেনে চললে এই চিকিৎসা কার্যকর হতে পারে।




-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি, 
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা    
প্রভাষক, 
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ। 

আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। 

>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন