রোগের চিকিৎসা কেবল বাহ্যিক লক্ষণগুলো কমানোর উদ্দেশ্যে করা উচিত নয়, বরং প্রাণশক্তির উপর ভিত্তি করে করা উচিত ।

ডাঃ স্যামুয়েল হানিম্যান, যিনি হোমিওপ্যাথির প্রতিষ্ঠাতা, তার বিখ্যাত গ্রন্থ "Organon of Medicine"-এ মূলত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার নীতি ও ধারণাগুলি বর্ণনা করেছেন। 

এই গ্রন্থে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, রোগের চিকিৎসা কেবল বাহ্যিক লক্ষণগুলো কমানোর উদ্দেশ্যে করা উচিত নয়, বরং রোগের আভ্যন্তরীণ কারণ বা "ভাইটাল ফোর্স" বা প্রাণশক্তির উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা করতে হবে।

বাহ্যিক প্রয়োগের বিষয়ে হানিম্যানের মতামত:

হানিম্যান সাধারণত বাহ্যিক প্রয়োগ (যেমন: মলম, ক্রিম, বা পেস্ট) এর ব্যবহারকে সমর্থন করেননি, বিশেষ করে কেবলমাত্র বাহ্যিক লক্ষণ বা উপসর্গগুলি দূর করার জন্য। 

তার মতে, বাহ্যিকভাবে রোগের উপসর্গ চাপিয়ে দিলে তা আভ্যন্তরীণ রোগকে আরও গভীরে নিয়ে যেতে পারে এবং সঠিকভাবে নিরাময় হওয়ার পরিবর্তে সমস্যাটি শরীরের ভিতরে আরও বেড়ে যেতে পারে।

 হানিম্যান এটিকে "Suppressive treatment" বা উপসর্গকে দমনকারী চিকিৎসা হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা রোগের প্রকৃত কারণ নিরাময় করে না।

Organon-এর 191 অনুচ্ছেদে তিনি বলেছেন:

> “...when a skin eruption is driven away by topical ointments or lotions, the inner disorder remains uncured and may even worsen. This method suppresses the symptoms rather than healing the vital force.”


বাহ্যিক প্রয়োগের ব্যতিক্রম:

হানিম্যান কিছু ক্ষেত্রে বাহ্যিক প্রয়োগকে গ্রহণ করেছেন, তবে সেটি তখনই যখন সেই বাহ্যিক প্রয়োগ হোমিওপ্যাথিক ঔষধের অনুরূপ শক্তি ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে কাজ করে। 

অর্থাৎ, শুধুমাত্র বাহ্যিক ক্রিম বা মলম লাগানোর পরিবর্তে আভ্যন্তরীণভাবে সেই রোগের কারণ নিরাময় করা জরুরি।

সারসংক্ষেপ:

মলম বা ক্রিম বাহ্যিকভাবে ব্যবহার: হানিম্যান একে সাধারণত সমর্থন করেননি, কারণ এটি কেবল উপসর্গ কমায়, রোগকে নিরাময় করে না।

আভ্যন্তরীণ চিকিৎসা

তিনি রোগের মূল কারণের উপর ভিত্তি করে আভ্যন্তরীণ চিকিৎসাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, যাতে ভাইটাল ফোর্স সুস্থ থাকে এবং রোগ সম্পূর্ণরূপে নিরাময় হয়।

সুতরাং, হানিম্যানের নীতিমালা অনুযায়ী, বাহ্যিক মলম বা ক্রিম প্রয়োগ করলে সেটা রোগের প্রকৃত নিরাময় না করে আংশিক বা সাময়িক উপসর্গ দূর করতে পারে, যা হোমিওপ্যাথির মূল দর্শনের পরিপন্থী।



+++++

ডাঃ হানিম্যানের "Organon of Medicine"-এর ধারণা আরও গভীরে বিবেচনা করলে দেখা যায়, তিনি বাহ্যিকভাবে মলম বা ক্রিম ব্যবহারকে শুধুমাত্র উপসর্গের সাময়িক মুক্তি হিসাবে দেখেছেন।

 তার মতে, রোগের বাহ্যিক লক্ষণসমূহ শরীরের আভ্যন্তরীণ ভারসাম্যহীনতার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

 তাই বাহ্যিকভাবে এই লক্ষণগুলো দমন করলে, রোগের ভেতরের মূল কারণটি আরও গভীরে চলে যেতে পারে এবং শরীরের অন্যান্য জায়গায় গুরুতরভাবে প্রকাশ পেতে পারে। 

এই ধরনের চিকিৎসাকে তিনি "Palliative treatment" বা দমনমূলক চিকিৎসা বলেছেন।

১. বাহ্যিক চিকিৎসার ফলাফল সম্পর্কে হানিম্যানের উদ্বেগ:

হানিম্যানের মতে, যদি শুধুমাত্র বাহ্যিক চিকিৎসার মাধ্যমে (যেমন মলম, ক্রিম বা পেস্ট ব্যবহার) রোগের চর্মরোগের মতো লক্ষণ দূর করা হয়, তাহলে মূল রোগটি শরীরের ভিতরে থেকে যায় এবং এটি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর আরও বড় প্রভাব ফেলতে পারে। 

উদাহরণস্বরূপ, তিনি বলেছিলেন যে, যদি চর্মরোগ (যেমন: দাউদ বা একজিমা) মলম বা ক্রিম দিয়ে দমন করা হয়, তাহলে তা শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে এবং ফুসফুস, যকৃত বা অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

২. মায়াজম তত্ত্ব:

হানিম্যানের মায়াজম তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রতিটি রোগের পেছনে কিছু মায়াজম বা গভীর মূল কারণ থাকে। 

তিনি রোগের তিনটি প্রধান মায়াজমের কথা উল্লেখ করেছেন:

Psora (চর্মরোগজনিত মায়াজম)

Sycosis (সর্দি বা অন্যান্য পুরানো সংক্রমণের মায়াজম)

Syphilis (গভীর সংক্রমণমূলক মায়াজম)


যখন শুধুমাত্র বাহ্যিকভাবে চর্মরোগের চিকিৎসা করা হয়, তখন এই মায়াজমগুলো দমন হয় এবং অন্যান্য গুরুতর শারীরিক বা মানসিক সমস্যার আকারে ফিরে আসে। তাই, হানিম্যান রোগের আভ্যন্তরীণ কারণ নিরাময়ে মনোযোগ দিয়েছেন, যাতে রোগ সম্পূর্ণভাবে সেরে যায়।

৩. হোমিওপ্যাথির নীতি:

হোমিওপ্যাথিতে “Similia Similibus Curentur” বা “Like cures like” নীতির উপর জোর দেওয়া হয়। অর্থাৎ, একটি ঔষধ যা একটি সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে রোগের মতো লক্ষণ তৈরি করতে পারে, তা একটি অসুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে একই রোগ নিরাময় করতে পারে। এটি বাহ্যিক মলম বা ক্রিম ব্যবহারের বিপরীত, যেখানে শুধুমাত্র লক্ষণগুলো ঢেকে দেওয়া হয়।

৪. বাহ্যিক চিকিৎসার সীমিত ব্যবহার:

হানিম্যান কিছু ক্ষেত্রে বাহ্যিক প্রয়োগ অনুমোদন করেছেন, তবে সেটি অবশ্যই সঠিকভাবে নির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সঙ্গে সমন্বিত হতে হবে। 

উদাহরণস্বরূপ, কিছু ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ যেমন Calendula বা Arnica পেস্ট আকারে বা বাহ্যিকভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে, যদি তা রোগের আভ্যন্তরীণ কারণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। কিন্তু এটি প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে নয়, বরং সম্পূরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

৫. বাহ্যিক লক্ষণ এবং অভ্যন্তরীণ কারণের মধ্যে সম্পর্ক:

হানিম্যান মনে করতেন যে বাহ্যিক লক্ষণ (যেমন ত্বকের সংক্রমণ) শরীরের অভ্যন্তরীণ অসুস্থতার একটি প্রকাশ মাত্র। তাই বাহ্যিকভাবে এই লক্ষণগুলো চিকিৎসা করার পরিবর্তে, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগের মূল কারণকে নিরাময় করতে হবে, যাতে শরীরের স্বাভাবিক ভারসাম্য এবং ভাইটাল ফোর্স পুনরুদ্ধার হয়।

সারসংক্ষেপ:

বাহ্যিক মলম বা ক্রিম লাগিয়ে রোগের উপসর্গ দূর করা হানিম্যানের মতে সমস্যার সমাধান নয়; এটি রোগকে দমন করে এবং ভেতরে গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

হোমিওপ্যাথির প্রধান লক্ষ্য হলো আভ্যন্তরীণ রোগের মূল কারণকে নিরাময় করা, বাহ্যিক লক্ষণকে শুধু দমন করা নয়।

বাহ্যিক প্রয়োগে হানিম্যানের সীমিত সমর্থন ছিল, যদি তা আভ্যন্তরীণ চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।

ডাঃ হানিম্যানের ধারণা অনুসারে, চিকিৎসার লক্ষ্য হওয়া উচিত রোগের গভীরে যাওয়া এবং বাহ্যিক লক্ষণ নয়, বরং সম্পূর্ণ নিরাময় নিশ্চিত করা।

+++

হোমিওপ্যাথির ইতিহাসে বিভিন্ন দার্শনিক ও চিকিৎসকরা তাদের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছেন, যা হোমিওপ্যাথির বিকাশ ও তার নীতিগুলোকে প্রভাবিত করেছে। 

ডাঃ স্যামুয়েল হানিম্যান এই চিকিৎসা পদ্ধতির মূল প্রতিষ্ঠাতা হলেও, পরবর্তীতে আরও অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হোমিওপ্যাথির তত্ত্ব ও চর্চা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত করেছেন। নিচে হোমিওপ্যাথির কিছু প্রধান দার্শনিক এবং চিকিৎসকদের মতামত তুলে ধরা হলো:

১. ডাঃ স্যামুয়েল হানিম্যান:

(1755-1843)
হোমিওপ্যাথির প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ হানিম্যান তার মূল গ্রন্থ “Organon of Medicine”-এ হোমিওপ্যাথির নীতিমালা এবং চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার মতবাদে প্রধান দিকগুলো হলো:

“Similia Similibus Curentur”: অর্থাৎ, “Like cures like” বা অনুরূপ রোগের লক্ষণ সৃষ্টি করতে সক্ষম ঔষধ দিয়েই সেই রোগ নিরাময় করা যেতে পারে।

Vital force: তার মতে, শরীরের একটি অভ্যন্তরীণ জীবনীশক্তি বা ভাইটাল ফোর্স আছে, যা রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে। রোগের মূল কারণ হলো এই ভাইটাল ফোর্সের ভারসাম্যহীনতা।

Holistic Treatment: হানিম্যান পুরো ব্যক্তিকে, মানসিক, শারীরিক এবং আবেগীয় দিক বিবেচনা করে চিকিৎসা করতেন। শুধুমাত্র রোগের বাহ্যিক লক্ষণ নয়, রোগের গভীরে গিয়ে কারণ খুঁজে বের করা তার মূল লক্ষ্য ছিল।


২. ডাঃ কনস্ট্যান্টিন হার্নিং (Constantine Hering):

(1800-1880)
ডাঃ হার্নিংকে হোমিওপ্যাথির "পিতা" হিসেবে বিবেচনা করা হয়, বিশেষত আমেরিকায়। তিনি “Hering’s Law of Cure” এর প্রণেতা, যা রোগ নিরাময়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছু মৌলিক নীতিমালা তুলে ধরেছে:

রোগ নিরাময় হয় ভিতর থেকে বাহিরে (From within outward)।

উপর থেকে নিচের দিকে (From above downwards)।

রোগের নিরাময় প্রক্রিয়ায় পুরনো উপসর্গগুলো পুনরায় দেখা দিতে পারে (Old symptoms reappear).


হার্নিং আরও বিশ্বাস করতেন যে একটি সঠিকভাবে নির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ শরীরের জীবনীশক্তিকে পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করে এবং এটি রোগের স্বাভাবিক নিরাময় প্রক্রিয়া চালু করে।

৩. ডাঃ জেমস টাইলার কেন্ট (James Tyler Kent):

(1849-1916)
ডাঃ কেন্ট হোমিওপ্যাথির এক বিখ্যাত শিক্ষক এবং চিকিৎসক। তিনি “Kent’s Repertory” এবং “Lectures on Homeopathic Philosophy” নামক গ্রন্থের রচয়িতা। কেন্টের দর্শন এবং শিক্ষাগুলি হোমিওপ্যাথির আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তার কিছু মূল মতবাদ হলো:

মনের গুরুত্ব: কেন্ট বিশ্বাস করতেন যে, রোগের গভীরতম কারণ হলো মানসিক স্তরে। তার মতে, রোগ নিরাময়ের জন্য মনের অবস্থানকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

ডায়নামিক পদ্ধতি: তিনি মনে করতেন যে ঔষধ শুধু উপসর্গ দূর করার জন্য নয়, বরং পুরো দেহের অভ্যন্তরীণ শক্তির ওপর প্রভাব ফেলে রোগের নিরাময় ঘটাতে হবে।


৪. ডাঃ রবার্টস (Herbert A. Roberts):

(1868-1950)
ডাঃ রবার্টস তার বই “The Principles and Art of Cure by Homeopathy”-এ হোমিওপ্যাথির নীতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি হোমিওপ্যাথির মৌলিক নীতিগুলো বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে উপস্থাপন করেছেন। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে:

রোগ নিরাময়ের জন্য সঠিক ঔষধ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোগীর পুরো পরিস্থিতি বিবেচনা করে ঔষধ বাছাই করা উচিত।

তিনি বিশ্বাস করতেন যে চিকিৎসা পদ্ধতিটি রোগীর স্বাভাবিক নিরাময় ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।


৫. ডাঃ জর্জ ভিথুলকাস (George Vithoulkas):

(1932-)
ডাঃ ভিথুলকাস একজন সমসাময়িক হোমিওপ্যাথ এবং ১৯৯৬ সালে “Right Livelihood Award” (যা প্রায়শই “বিকল্প নোবেল পুরস্কার” হিসেবে পরিচিত) পেয়েছেন হোমিওপ্যাথিতে তার অবদানের জন্য। তার দার্শনিক মতামতগুলির মধ্যে রয়েছে:

“Levels of Health” তত্ত্ব: তিনি রোগীর স্বাস্থ্যকে বিভিন্ন স্তরে বর্ণনা করেছেন এবং এই স্তর অনুযায়ী চিকিৎসা পরিকল্পনা করেন।

Totality of Symptoms: ভিথুলকাস রোগীর সমস্ত উপসর্গের মিলিত রূপ বিবেচনা করে ঔষধ নির্বাচন করেন। তিনি মানসিক এবং শারীরিক উভয় উপসর্গের সমন্বয়ে চিকিৎসার উপর জোর দেন।


৬. ডাঃ রঘুবীর সিং (Raghubir Singh):

একজন বিশিষ্ট ভারতীয় হোমিওপ্যাথ ছিলেন ডাঃ রঘুবীর সিং। তিনি "নেতৃত্বমূলক" (Keynote) চিকিৎসার ধারণা নিয়ে কাজ করেছেন, যেখানে রোগের কয়েকটি প্রধান লক্ষণকে ভিত্তি করে চিকিৎসা করা হয়। তার মতে, রোগের Keynote symptoms অনুযায়ী সঠিক ঔষধ নির্বাচন করতে পারলে রোগ দ্রুত নিরাময় সম্ভব।

সারসংক্ষেপ:

হোমিওপ্যাথির বিভিন্ন দার্শনিক এবং চিকিৎসকরা বিভিন্ন সময়ে হোমিওপ্যাথির বিভিন্ন নীতি এবং পদ্ধতির উপর আলোকপাত করেছেন। 

তবে তাদের সকলের মূল বিশ্বাস ছিল যে রোগ শুধুমাত্র বাহ্যিক লক্ষণ নয়, বরং গভীর আভ্যন্তরীণ কারণের ফলাফল। 

এজন্য হোমিওপ্যাথির চিকিৎসায় রোগীর সামগ্রিক অবস্থাকে বিবেচনা করে চিকিৎসা করা হয়, যাতে রোগের মূল কারণ চিহ্নিত করে সেটাকে নিরাময় করা যায়।

++++

হোমিওপ্যাথির জগতে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ও চিকিৎসক রয়েছেন, যারা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ করেছেন এবং তত্ত্বগুলোকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন। নিচে তাদের সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য দেওয়া হলো:

৭. ডাঃ রিচার্ড হিউজেস (Richard Hughes):

(1836-1902)
ডাঃ রিচার্ড হিউজেস হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তার বই “A Manual of Pharmacodynamics”-এ হোমিওপ্যাথির মৌলিক ঔষধশাস্ত্র নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। হিউজেসের মতবাদে:

তিনি হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করার ওপর জোর দিয়েছিলেন।

তিনি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার মূল নীতি “similia similibus curentur” এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন এবং এটি বাস্তব জীবনের রোগ নিরাময়ের প্রক্রিয়ায় কীভাবে কাজ করে তা বুঝতে সাহায্য করেছেন।

হিউজেস বিশ্বাস করতেন যে, রোগ নিরাময়ের জন্য রোগীর শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো উচিত, যাতে রোগের বিরুদ্ধে শরীর নিজেই লড়াই করতে পারে।


৮. ডাঃ জন হেনরি ক্লার্ক (John Henry Clarke):

(1853-1931)
ডাঃ ক্লার্ক ছিলেন একজন বিশিষ্ট হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক এবং লেখক। তার রচিত “A Dictionary of Practical Materia Medica” তিনটি খণ্ডে বিভক্ত এবং এটিকে হোমিওপ্যাথির অন্যতম প্রধান গ্রন্থ হিসেবে গণ্য করা হয়। তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ ছিল:

ঔষধের ক্ষমতা: তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রতিটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধের বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে, যা রোগীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উপর প্রভাব ফেলে।

তিনি রোগের সামগ্রিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে ঔষধ নির্বাচন করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন এবং প্রায়শই প্রাচীন ঔষধশাস্ত্রের সাথে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার তুলনা করতেন।


৯. ডাঃ জে. টি. বিগল (J. T. Kent's Followers):

ডাঃ কেন্টের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত আরও অনেক চিকিৎসক ক্লাসিকাল হোমিওপ্যাথি-র ধারার প্রচার ও প্রসার করেছেন। তারা ডাঃ কেন্টের কাজের ওপর ভিত্তি করে হোমিওপ্যাথির নানা দিক নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং তার দার্শনিক মতবাদকে আরও গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন। 
কেন্টের অনুসারীদের মধ্যে অনেকেই তার Repertory এবং Philosophy নিয়ে আরও বিস্তারিত কাজ করেছেন।

১০. ডাঃ ক্লডিয়া ডি মেইও (Claudia De Meo):

একজন আধুনিক হোমিওপ্যাথ এবং শিক্ষিকা, ডাঃ ক্লডিয়া ডি মেইও হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা পদ্ধতির উপরে গঠনমূলক দার্শনিক আলোচনার জন্য পরিচিত। তিনি বিশ্বাস করেন:

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যক্তিগত চিকিৎসা হওয়া উচিত। রোগীর মানসিক, শারীরিক এবং আবেগীয় অবস্থা বিবেচনা করে প্রতিটি রোগীর জন্য আলাদা আলাদা ঔষধ নির্বাচন করতে হবে।

তিনি আরও যুক্তি দেন যে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার মাধ্যমে শুধুমাত্র শারীরিক রোগ নয়, মানসিক এবং আবেগীয় সমস্যাও সমাধান করা সম্ভব।


১১. ডাঃ এমিল শেগাল (Emil Schlegel):

ডাঃ শেগাল ছিলেন একজন জার্মান হোমিওপ্যাথ যিনি হোমিওপ্যাথির ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রেখেছেন। তিনি বিশেষত:

চিকিৎসার সম্পূর্ণতা: তিনি বিশ্বাস করতেন যে রোগীর পুরো চিত্র বা সম্পূর্ণ অবস্থাকে বিবেচনা করে চিকিৎসা করা উচিত, যেখানে রোগীর মানসিক এবং শারীরিক উভয় অবস্থার প্রতি সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়।

তার মতে, কনস্টিটিউশনাল রেমেডি বা রোগীর সামগ্রিক শারীরিক এবং মানসিক গঠনকে বিবেচনা করে চিকিৎসা করা হোমিওপ্যাথির সঠিক পদ্ধতি।


১২. ডাঃ লুস ডার্শিনভেল্ড (Luc De Schepper):

ডাঃ লুস ডার্শিনভেল্ড হোমিওপ্যাথিতে মনোসিমিলিমাস (একক ঔষধ ব্যবহারের) তত্ত্বের প্রচারক। তিনি আধুনিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার এক অগ্রগামী ব্যক্তিত্ব, তার কিছু মতামত হলো:

রোগীকে প্রাথমিকভাবে একটি একক ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করা উচিত, যাতে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে।

মনোথেরাপি-র ধারণা ব্যবহার করে রোগ নিরাময়ের জন্য সঠিক ঔষধ বেছে নেওয়ার ওপর তিনি জোর দেন।


১৩. ডাঃ শ্রীপদ কৃ. বৎস (S.K. Bhatta):

ভারতীয় হোমিওপ্যাথদের মধ্যে একজন গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসক ছিলেন ডাঃ শ্রীপদ বৎস। তিনি মূলত ভারতের হোমিওপ্যাথি চর্চার প্রসারে কাজ করেছেন এবং ক্লাসিকাল হোমিওপ্যাথির মূল নীতিগুলোকে তুলে ধরেছেন:

রোগীর সামগ্রিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্বাচন করা এবং রোগের অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে বের করা ছিল তার প্রধান লক্ষ্য।

সারসংক্ষেপ:

হোমিওপ্যাথির দার্শনিক ও চিকিৎসকরা রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে রোগীর সামগ্রিক অবস্থার গুরুত্ব এবং রোগের গভীরে গিয়ে চিকিৎসা করার ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। 

তারা সবাই এই বিষয়ে একমত যে, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা কেবল বাহ্যিক উপসর্গ নয়, বরং রোগের মূল কারণ নিরাময়ের দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত।


-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি, 
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা    
প্রভাষক, 
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ। 


আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ।

>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন