সাধারণ মানুষদের যা জানা প্রয়োজন - হোমিওপ্যাথিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি শিশুর চিকিৎসার জন্য কি কি বিষয় প্রয়োজন - একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের ।



হোমিওপ্যাথি একটি সমগ্রিক চিকিৎসা পদ্ধতি, যেখানে রোগীকে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তি হিসেবে দেখা হয়। একটি শিশুর চিকিৎসার ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসককে বিভিন্ন দিক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। নিচে এই বিষয়গুলোর বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. শিশুর জন্মপূর্ব ইতিহাস (Ante-Natal History)

শিশুর গর্ভকালীন সময়টি তার ভবিষ্যৎ শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।

মায়ের শারীরিক অবস্থা:

গর্ভাবস্থায় মা কোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ছিলেন কিনা (যেমন, ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার, থাইরয়েড)। 

হাইপ্রেশার, ডায়াবেটিস বা থাইরয়েড ইত্যাদি গর্ভাবস্থায় থাকলে শিশুর জন্মগত সমস্যার সম্ভাবনা বাড়ে।

মায়ের গর্ভকালীন পুষ্টি এবং খাদ্যাভ্যাস।

নোট : শিশুর চিকিৎসার জন্য, শিশু গর্ভে থাকাকালীন মায়ের গর্ভকালীন ইতিহাস অর্থাৎ প্রেগনেন্সি প্রোফাইল রিপোর্ট সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে। 


মায়ের মানসিক অবস্থা:

গর্ভাবস্থায় মা মানসিক চাপে ছিলেন কিনা (যেমন, দাম্পত্য কলহ, অর্থনৈতিক সমস্যা)।

মায়ের ভীতি, রাগ, দুঃখ, বা হতাশা শিশুর উপর কীভাবে প্রভাব ফেলেছে।

যদি মা গর্ভাবস্থায় কোনো মানসিক আঘাত পান, যেমন অপমান, দুঃখ, বা ভয়, তবে এটি শিশুর ভবিষ্যৎ মানসিকতায় প্রভাব ফেলতে পারে।

উদাহরণ:

গর্ভাবস্থায় যদি মা মানসিক চাপে ভুগে থাকেন, তবে শিশুর আচরণে উদ্বেগ বা ভয় প্রবণতা দেখা দিতে পারে।


২. প্রসব এবং জন্মের ইতিহাস

প্রসব প্রক্রিয়া কেমন ছিল (স্বাভাবিক, সিজারিয়ান, বা ফোর্সেপ ব্যবহৃত হয়েছে কিনা)।

প্রসবকালীন কোনো জটিলতা (যেমন, শ্বাসকষ্ট, নাভির সমস্যা, রক্তক্ষরণ)।

জন্মের সময় শিশুর স্বাস্থ্যগত অবস্থা (যেমন, কম ওজন, জন্মের সময় চিৎকার করেছিল কিনা, নীলাভ ত্বক)।

প্রসবকালীন জটিলতার জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে। 

শিশুর জন্মের সময়ের যেকোনো সমস্যা তার ভবিষ্যতের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে প্রভাব ফেলতে পারে।

জন্মের সময় অক্সিজেনের অভাব শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।

ফোর্সেপ বা ভ্যাকুয়াম ব্যবহারের কারণে মাথায় আঘাত বা রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা হতে পারে।

নোট : শিশুর চিকিৎসার জন্য, শিশুর জন্মইবার সময় যে সকল বিষয় পরিলক্ষিত করা গেছে তার ইতিহাস অর্থাৎ হাসপাতাল থেকে দেওয়া "বার্থ ডেলিভারি সার্টিফিকেট" সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে । 


 ৩. শিশু টিকা  : 

শিশুদের টিকা দেওয়ার পরে কিছু সাধারণ বা গভীর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যা সাধারণত ক্ষণস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী এবং তেমন ক্ষতিকারক নয় আবার ক্ষতিকারকও । তবে কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর প্রতিক্রিয়াও দেখা দিতে পারে। নিচে উল্লেখ করা হলো:

সাধারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া:

1. ইঞ্জেকশনের স্থানে ব্যথা বা ফোলা:
টিকা দেওয়ার স্থানে সামান্য লালচে ভাব, ফোলা, বা ব্যথা হতে পারে।

2. জ্বর:
হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার জ্বর হতে পারে।

3. ঝিমুনিভাব বা ক্লান্তি:
টিকার পরে শিশুরা ঘুম বেশি পেতে পারে বা ক্লান্ত অনুভব করতে পারে।


4. বিরক্তি বা কান্নাকাটি:
টিকার পরে শিশুরা কিছুটা অস্বস্তি বা বিরক্তি অনুভব করতে পারে।

5. ক্ষুধামন্দা:
টিকা দেওয়ার পরে কয়েকদিন শিশুর খাওয়া কমে যেতে পারে।

6. মাংসপেশির ব্যথা বা শক্ত হওয়া:
বিশেষ করে যে স্থানে টিকা দেওয়া হয়েছে সেখানে এই উপসর্গ হতে পারে।


কমন কিছু তীব্র পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া (বিরল):

1. অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া (Anaphylaxis):
এটি অত্যন্ত বিরল হলেও বিপজ্জনক। এতে ত্বকে ফুসকুড়ি, শ্বাসকষ্ট, বা তীব্র অস্বস্তি হতে পারে।

2. জ্বরজনিত খিঁচুনি (Febrile Seizures):
জ্বর খুব বেশি বেড়ে গেলে খিঁচুনি হতে পারে।

3. লিম্ফ নোড ফোলা:
বিশেষ করে যক্ষ্মা (BCG) টিকার পর লিম্ফ নোড ফুলে যেতে পারে।

4. অতিরিক্ত কান্না বা উত্তেজনা:
কিছু শিশু টিকার পরে দীর্ঘ সময় ধরে কান্নাকাটি বা অস্থিরতা প্রকাশ করতে পারে।

5. ত্বকের প্রদাহ বা ফুসকুড়ি:
কিছু টিকার পরে ত্বকে লালচে ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।

নোট : শিশু চিকিৎসার জন্য, শিশুর "টিকার কার্ড অর্থাৎ ভেকসিনেশন কার্ড" সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে। 


৪. শিশুর শারীরিক বিকাশ এবং বৃদ্ধির পর্যবেক্ষণ

শিশুর শারীরিক বিকাশ তার সামগ্রিক স্বাস্থ্যগত অবস্থা বুঝতে সহায়তা করে।

শিশুর ওজন এবং উচ্চতা কি বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিক?

দাঁত উঠার সময়সূচি এবং সমস্যা (যেমন, ডায়রিয়া, জ্বর)।

হাঁটা, বসা, কথা বলা—এই ধরনের মোটর স্কিলের বিকাশ।


৫. শিশুর খাদ্যাভ্যাস এবং হজম

শিশুর খাদ্যাভ্যাস থেকে তার হজম শক্তি এবং পুষ্টি গ্রহণের ক্ষমতা বোঝা যায়।

শিশুর দুধ বা কোনো নির্দিষ্ট খাবারে অ্যালার্জি আছে কিনা।

অতিরিক্ত ক্ষুধা বা ক্ষুধামন্দা।

পায়খানার ধরণ:
  • কি রঙের?
  • তরল নাকি শক্ত?
  • দুর্গন্ধযুক্ত কিনা?
  • মলের সঙ্গে রক্ত বা শ্লেষ্মা আছে কিনা।

৬. মানসিক এবং আবেগিক অবস্থা

শিশুর মানসিক অবস্থাকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়।

শিশুর মেজাজ:

সহজে কাঁদে কিনা, খুব জেদি কিনা, অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য কী ধরনের আচরণ করে।


ভয় এবং অস্বস্তি:

শিশুর কোনো নির্দিষ্ট ভয় আছে কিনা (যেমন, অন্ধকার, অপরিচিত মানুষ, উচ্চ শব্দ)।


আনন্দ এবং দুঃখ প্রকাশের ধরণ:

শিশুর অতিরিক্ত হাসা বা অস্বাভাবিক আচরণ।


সামাজিক আচরণ:

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কেমন মেশে।

অপরিচিতদের প্রতি আচরণ।


৭. রোগের লক্ষণ এবং রোগের ধরন

শিশুর শরীরে দেখা দেওয়া রোগের ধরণ থেকে রেমেডি নির্বাচন করা হয়।

তাপমাত্রা: 

জ্বর হলে তা কেমন? (উচ্চ তাপমাত্রা, বারবার ঘাম হওয়া)।

সর্দি-কাশি:

নাক বন্ধ, গলা ব্যথা, কাশির সময় শ্বাসকষ্ট।

ত্বকের সমস্যা:

একজিমা, র‍্যাশ, চুলকানি।


অন্যান্য লক্ষণ:

কান্না করলে বমি হয় কিনা।

কান্নার ধরন। 

রোগের সময় হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায় কিনা।


৮. শিশুর আচরণগত অভ্যাস

শিশুর দৈনন্দিন অভ্যাসও হোমিওপ্যাথির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

চুষা বা নখ কামড়ানোর অভ্যাস।

রাতে ঘুমের সমস্যা (যেমন, দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যাওয়া)।

ঘুমানোর অবস্থান (উপুড় হয়ে ঘুমানো, পাশে ঘুমানো)।


৯. পরিবার এবং পরিবেশের প্রভাব

শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশ তার আচরণ এবং স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।

পরিবারের মধ্যে অশান্তি বা চাপ শিশুর মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

বাবা-মায়ের সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক।

পরিবারে অন্য সদস্যদের রোগের ইতিহাস (যেমন, হাঁপানি, মানসিক রোগ)।



---

১০. প্রধান সমষ্টিগত লক্ষণ (Totality of Symptoms)

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক শিশুর লক্ষণগুলোর সমষ্টি বিচার করেন।

শারীরিক, মানসিক, এবং আবেগিক লক্ষণের সমন্বয়।

রোগের সময়কাল, রোগের প্রকৃতি এবং পূর্বের চিকিৎসার প্রতিক্রিয়া।


১১. বিশেষ চিকিৎসা এবং রেমেডি নির্বাচন

শিশুদের জন্য ন্যূনতম শক্তিশালী ওষুধ ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসক নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করেন:

শিশুর সংবেদনশীলতা।

রোগের প্রকৃতি এবং তীব্রতা।

দীর্ঘমেয়াদী রোগের ক্ষেত্রে কনস্টিটিউশনাল চিকিৎসা।


উপসংহার৷ :

একজন অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক শিশুর রোগমুক্তি এবং সামগ্রিক সুস্থতার জন্য 
তার শারীরিক, 
মানসিক, এবং 
পরিবেশগত 
সমস্ত দিক বিবেচনা করে হোমিওপ্যাথিক রেমেডি নির্ধারণ করেন।

 রোগের মূল কারণ চিহ্নিত করা এবং শিশুর শক্তি পুনরুদ্ধার করাই হোমিওপ্যাথির লক্ষ্য।





-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি, 
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা    
প্রভাষক, 
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ। 



আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। 

>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন