যে সকল হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক রোগের নাম বা রোগের আকৃতি প্রকৃতি বিবেচনায় চিকিৎসা প্রদান করেন, সেই সকল চিকিৎসকরা কোনদিন হোমিওপ্যাথিক দর্শন কি তা কখনোই বিবেচনায় আনতে পারেন না এবং রোগীর জন্য সঠিক আরোগ্য কর ওষুধ নির্বাচনও করিতে পারেন না।
Homoeopathic doctors who prescribe treatment based on the name or nature of the disease can never take into account the homoeopathic philosophy and select the right medicine for the patient.
গভীর আলোচনা :
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাশাস্ত্র মূলত রোগের নাম, ধরণ, বা লক্ষণ বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে নয়; বরং এটি রোগীর মানসিক ও শারীরিক অবস্থা, প্রতিক্রিয়া, এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর জোর দেয়। এই দর্শনের মূল ভিত্তি হ'ল “সিমিলিয়া সিমিলিবাস কিউরেন্টার” অর্থাৎ “সমরূপ সমরূপ দ্বারা নিরাময় হয়।” রোগের বাহ্যিক রূপকে নিরাময়ের পরিবর্তে, হোমিওপ্যাথি এমন ওষুধ প্রয়োগ করে যা রোগীর মনের ও শরীরের মূল অবস্থা পরিবর্তনে সহায়ক হয়।
যেসব চিকিৎসক শুধুমাত্র রোগের নাম বা আকৃতি অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করেন, তারা মূলত রোগের বহিরঙ্গের উপর ভিত্তি করে ওষুধ নির্বাচন করেন, যা হোমিওপ্যাথির মূল নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই পদ্ধতিতে প্রকৃত আরোগ্য সাধন সম্ভব নয়, কারণ এতে রোগীর আভ্যন্তরীণ গঠন, মানসিক অবস্থা এবং ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনায় আনা হয় না। হোমিওপ্যাথিতে রোগীর সমগ্র অবস্থা বিশ্লেষণ করে ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসা প্রদান করা হয়, যা একটি রোগীর জন্য নির্ধারিত সঠিক ওষুধ অন্য রোগীর জন্য কার্যকর নাও হতে পারে, যদিও তাদের বাহ্যিক লক্ষণ এক মনে হতে পারে।
নিয়মিত হোমিওপ্যাথিক দর্শন অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হলে, একজন চিকিৎসকের রোগী সম্পর্কে গভীর পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন, যেখানে তিনি রোগীর শারীরিক লক্ষণের পাশাপাশি মানসিক অবস্থা, জীবনধারা, আচরণগত প্রবণতা ইত্যাদি বিষয়ও মূল্যায়ন করেন।
হোমিওপ্যাথির মূল দর্শন অনুযায়ী, প্রতিটি রোগীই আলাদা এবং তার সমস্যা ও ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী চিকিৎসা প্রয়োজন। রোগ নিরাময়ের জন্য রোগীর উপসর্গের প্রকৃতি ও অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে রোগীর ব্যক্তিত্ব, আবেগ, এবং শারীরিক ও মানসিক অবস্থা একত্রে বিবেচনা করে উপযুক্ত ওষুধ নির্বাচন করা হয়। এটি হোমিওপ্যাথির মূল নীতি, যা অন্য চিকিৎসা পদ্ধতির থেকে এই চিকিৎসাশাস্ত্রকে আলাদা করে তোলে।
যে চিকিৎসকরা রোগের নাম, ধরণ, বা বাহ্যিক লক্ষণকে ভিত্তি করে চিকিৎসা প্রদান করেন, তারা মূলত রোগের মূল কারণ বা আভ্যন্তরীণ সমস্যাটি বিবেচনা করেন না। এর ফলে তারা যে ওষুধ প্রয়োগ করেন, তা হয়তো সাময়িকভাবে কিছু উপসর্গকে দমন করতে পারে, কিন্তু রোগীকে স্থায়ীভাবে আরোগ্য করতে অক্ষম।
হোমিওপ্যাথির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মায়াজম বা রোগপ্রবণতা। হ্যানেম্যান রোগের গভীরতম কারণ হিসাবে মায়াজমের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রতিটি রোগীর মধ্যে আলাদা ধরনের মায়াজম বা গভীরস্থ দোষ বিদ্যমান থাকে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে। শুধু বাহ্যিক উপসর্গের ভিত্তিতে ওষুধ নির্বাচন করলে মায়াজমের প্রভাব উপেক্ষিত হয়, ফলে রোগটি সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয় না এবং পুনরায় ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে।
একজন প্রকৃত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক তার রোগীর জীবনের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ নিয়ে থাকে। রোগীর ইতিহাস, শৈশব, মানসিক প্রতিক্রিয়া, আবেগ, খাবারের পছন্দ, ঘুমের প্যাটার্ন, এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সবকিছুকে বিবেচনায় নিয়ে ওষুধ নির্বাচন করা হয়। রোগীর আভ্যন্তরীণ শক্তি ও প্রতিরোধ ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করতে এই গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এর ফলে রোগী পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করে এবং একই সাথে পুনরায় রোগাক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও কমে যায়।
অন্যদিকে, শুধুমাত্র রোগের বাহ্যিক লক্ষণ বিবেচনা করে যে চিকিৎসকরা ওষুধ নির্বাচন করেন, তাদের চিকিৎসা মূলত উপসর্গ দমনে সীমাবদ্ধ থাকে এবং প্রকৃত নিরাময় সাধন হয় না। এজন্য একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসককে এই দর্শন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং রোগীর সাথে সময় নিয়ে বিশদ আলাপ করতে হবে, যেন তিনি সঠিক ও ব্যক্তিকৃত চিকিৎসা প্রদান করতে পারেন।
এই পুরো প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি হলেও, হোমিওপ্যাথি দীর্ঘস্থায়ী এবং গভীর আরোগ্য আনতে সক্ষম, যা অন্য কোনো চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে তুলনীয় নয়।
অর্গানন অফ মেডিসিন গ্রন্থ থেকে.....
হোমিওপ্যাথির এই মৌলিক নীতিগুলো হানেমানের অর্গানন অফ মেডিসিন গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে, রোগ নিরাময়ে রোগীর সমগ্র অবস্থাকে বিবেচনায় নেওয়ার বিষয়টি §6 এবং §18 এফোরিজমে উল্লেখিত রয়েছে। এখানে তিনি বলেছেন যে রোগের বাহ্যিক লক্ষণ, মানসিক অবস্থা, এবং ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যসহ রোগীর সামগ্রিক অবস্থার ভিত্তিতে ওষুধ নির্বাচন করতে হবে।
§153 এফোরিজম অনুযায়ী, রোগীর সকল লক্ষণের মধ্যে সর্বাধিক প্রকট বা বিশেষ লক্ষণগুলিকে মূল্যায়ন করতে হবে, কারণ সেগুলিই উপযুক্ত ওষুধের নির্বাচনকে সহজ করে তোলে।
এছাড়া, §3 এফোরিজমে তিনি উল্লেখ করেন যে একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসককে রোগ নিরাময়ের জন্য রোগীর আভ্যন্তরীণ শক্তি বা “ভাইটাল ফোর্স”-কে পুনরুদ্ধার করতে হবে, যা রোগীর শরীর ও মনের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ফিরিয়ে আনে।
-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি,
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা
প্রভাষক,
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ।
আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ।
>Share by:
Make a comments as guest/by name or from your facebook:
Make a comment by facebook: