রোগ বলতে কিছুই নেই, যা আছে তা হলো অসুস্থ মানুষ। সাইন্টিফিক ব্যাখ্যাসহ হোমিওপ্যাথিক দার্শনিকদের মতামত

হোমিওপ্যাথি দর্শনের "রোগ বলতে কিছুই নেই, যা আছে তা হলো অসুস্থ মানুষ" এই ধারণাটি আসলে মানুষের স্বাস্থ্য এবং অসুস্থতার প্রকৃতি সম্পর্কে একটি মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।

এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও হোমিওপ্যাথিক দৃষ্টিকোণ বিস্তারিতভাবে বোঝার জন্য প্রথমে বুঝতে হবে হোমিওপ্যাথির মূল দর্শন ও জীবনশক্তির ধারণা সম্পর্কে।

১. জীবনশক্তি ও তার ভারসাম্য:

হোমিওপ্যাথির প্রতিষ্ঠাতা, ডাঃ স্যামুয়েল হ্যানিম্যান, জীবনশক্তি বা "vital force" ধারণাকে হোমিওপ্যাথির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ধরেছেন। তাঁর মতে, মানুষের শরীরের মধ্যে এক প্রকার অদৃশ্য শক্তি কাজ করে, যা তার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই শক্তিটি যখন সঠিকভাবে কাজ করে, তখন মানুষ সুস্থ থাকে। কিন্তু যখন এই শক্তি ভারসাম্য হারায় বা "ডিস্টার্বড" হয়, তখনই বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক লক্ষণ প্রকাশ পায়, যেগুলোকে আমরা অসুস্থতা হিসেবে চিহ্নিত করি।

২. রোগ নয়, বরং লক্ষণের গুরুত্ব:

হোমিওপ্যাথি অনুসারে, রোগ মানে নির্দিষ্ট কোনো শত্রু বা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া নয়; বরং এটি শরীরের অভ্যন্তরীণ জীবনশক্তির ব্যাঘাতের ফল। এই কারণে, হোমিওপ্যাথরা রোগের নাম বা নির্দিষ্ট কারণ নিয়ে তেমন গুরুত্ব দেন না। তারা লক্ষণগুলোর (symptoms) প্রতি গুরুত্ব দেন, কারণ লক্ষণগুলোই জীবনীশক্তির অভ্যন্তরীণ অবস্থা প্রকাশ করে।

ধরুন, একজন রোগী মাথাব্যথা, অবসাদ, এবং অবসন্নতার অভিযোগ নিয়ে হোমিওপ্যাথের কাছে আসেন। হোমিওপ্যাথরা এই সমস্যাগুলোর আলাদা করে চিকিৎসা করেন না; বরং তারা রোগীর সমস্ত শারীরিক এবং মানসিক লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বোঝার চেষ্টা করেন যে জীবনশক্তি কোথায় এবং কীভাবে ভারসাম্য হারিয়েছে। তারপর তারা সেই শক্তিকে পুনরুদ্ধার করার জন্য উপযুক্ত হোমিওপ্যাথিক ওষুধ প্রয়োগ করেন।

 




৩. Individualization বা ব্যক্তির বিশেষ লক্ষণের গুরুত্ব:

হোমিওপ্যাথি মতে, কোনো নির্দিষ্ট রোগ নেই যা সকল মানুষের মধ্যে একভাবে প্রকাশ পায়। প্রত্যেক ব্যক্তির শরীর, মন, এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে তাদের অসুস্থতা প্রকাশের ধরন আলাদা হয়। 
এই জন্য হোমিওপ্যাথরা "individualization" এর উপর জোর দেন, অর্থাৎ একজন রোগীকে তাঁর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ভিন্নতা অনুযায়ী আলাদাভাবে মূল্যায়ন করে চিকিৎসা করা।

ধরুন, দুই জন মানুষ একই রোগে আক্রান্ত (যেমন, সর্দি-কাশি)। এক ব্যক্তির ক্ষেত্রে এর সাথে অবসন্নতা, উচ্চ তাপমাত্রা, ও মেজাজে চঞ্চলতা আছে। অন্যজনের ক্ষেত্রে কেবল হালকা জ্বর, কিন্তু উদ্বেগ এবং অস্থিরতা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। হোমিওপ্যাথরা দুইজনকেই আলাদা ভাবে চিকিৎসা করবেন, কারণ তাদের জীবনশক্তির ভারসাম্য ভিন্নভাবে বিঘ্নিত হয়েছে।

৪. চিকিৎসার লক্ষ্য:

হোমিওপ্যাথির লক্ষ্য হলো রোগের লক্ষণকে কেবল দূর করা নয়, বরং রোগীর জীবনশক্তি বা vital force পুনরুদ্ধার করা যাতে শরীর নিজেই তার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে এবং সম্পূর্ণ সুস্থতা ফিরে পায়। এটি রোগীর শরীরকে নিজেই তার সমস্যার সমাধান করতে সহায়তা করে, যা অনেক ক্ষেত্রে প্রথাগত চিকিৎসায় মেলে না।

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় বলা হয়, একটি উপযুক্ত ওষুধ কেবল রোগের নিরাময় করে না, বরং জীবনীশক্তিকে পুনরায় সক্রিয় করে। এতে রোগী শুধু সিম্পটম থেকে মুক্ত হয় না; বরং শরীর ও মনের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা এমনভাবে উন্নত হয় যে ভবিষ্যতেও শরীর নিজেকে সুরক্ষিত করতে সক্ষম হয়।

৫. উদাহরণ: মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতার ভারসাম্য:

বিভিন্ন মানসিক ও শারীরিক সমস্যার মধ্যে যেমন: আতঙ্ক, বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তা, অথবা যেকোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে এগুলো সরাসরি শারীরিক উপসর্গে রূপ নিতে পারে। যেমন, কারো জীবনে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ থাকলে, তা তার শারীরিক অসুস্থতার কারণ হতে পারে। তাই হোমিওপ্যাথি মতে মানসিক ও শারীরিক দিক দুটোই রোগের সমানভাবে অংশ।

উদাহরণস্বরূপ, একজন মানুষ যদি ক্রমাগত অবহেলিত বোধ করেন এবং এই অনুভূতি থেকে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তবে তা শারীরিক অসুস্থতা হিসেবেও প্রকাশ পেতে পারে। হোমিওপ্যাথরা এ ধরনের ক্ষেত্রে রোগীর মানসিক অবস্থার পাশাপাশি শারীরিক লক্ষণগুলোকেও বিবেচনায় নেন।

৬. হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার দৃষ্টিকোণ:

রোগ বলতে কেবল একটি নাম মাত্র নয়, বরং পুরো ব্যক্তির উপর প্রভাবিত একটি অবস্থা।

লক্ষণ হলো শরীরের একটি অভ্যন্তরীণ বার্তা যা জীবনশক্তির ভারসাম্যহীনতার প্রকাশ।

প্রতিটি ব্যক্তির জন্য আলাদা চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ, যার মাধ্যমে তার শরীর ও মন উভয়ের সামগ্রিক উন্নতি সম্ভব।


এইভাবে, হোমিওপ্যাথির মূল লক্ষ্য কেবল রোগের উপসর্গকে নয়, বরং পুরো ব্যক্তিকে সুস্থ করে তোলা, যাতে রোগী দীর্ঘস্থায়ী সুস্থতার দিকে অগ্রসর হতে পারেন।






-- কাজী সাইফ উদদীন আহমেদ,
Lecturer, Federal Homoeopathic Medical College, Dhaka.


আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। 


>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন