নারীকে শারীরিক ও মানসিক আঘাত করা সম্পর্কে ইসলাম কি বলে

ইসলাম শান্তি ও ন্যায়বিচারের ধর্ম, এবং আল কুরআন ও সুন্নাহতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন, বা অন্যায় আচরণ নিষিদ্ধ

 কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনা অনুসারে নারীদের প্রতি সম্মান, যত্ন, ও সমতা প্রদর্শন করতে বলা হয়েছে। 

আল্লাহ নারীদের প্রতি সহিংস আচরণকে কঠোরভাবে নিন্দা করেছেন এবং তাঁদের মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট আদেশ দিয়েছেন।

কুরআনের বক্তব্য:
১. আল-নিসা: ১৯ — "তোমরা তাদের সাথে সদ্ভাবে বাস করো। যদি তোমরা তাদের প্রতি অপছন্দও কর, তাহলে সম্ভবত তোমরা এমন কিছু অপছন্দ করছ, অথচ আল্লাহ তাতে অনেক কল্যাণ রেখেছেন।"
এই আয়াতে বলা হয়েছে, নারীকে সম্মানের সাথে এবং সদাচারণের সাথে সহবাস করতে হবে।

২. আল-নিসা: ৩৪ — এই আয়াতে পুরুষদের দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে নারীদের রক্ষাকারী হিসেবে। এখানে দায়িত্বশীল পুরুষদের নারীদের সুরক্ষা ও সম্মান নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

যদিও কিছু ভাষ্যকার এখানে সামান্য শাস্তির কথা উল্লেখ করেন, তবে এটি অত্যন্ত সীমাবদ্ধ এবং শরিয়া ও ইসলামী আইনবিদগণ একমত যে, শারীরিক নির্যাতন করা একেবারে গ্রহণযোগ্য নয়। এটি একটি প্রতীকী ইঙ্গিত, যা কঠোর শর্তযুক্ত এবং কোনো অবস্থাতেই নারীর প্রতি অন্যায়ভাবে প্রয়োগ করা উচিত নয়।

হাদিসের বক্তব্য:
১. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর সাথে সর্বোত্তম আচরণ করে।” (তিরমিযি)
এ থেকে বোঝা যায়, স্ত্রীর প্রতি সহানুভূতি, ভালোবাসা ও মর্যাদা প্রদর্শন করতে হবে।

২. আরও বলা হয়েছে, “তোমাদের কেউ যেন তার স্ত্রীর মুখে কখনো থাপ্পড় না মারে।” (আবু দাউদ)

এগুলি থেকে বোঝা যায়, ইসলামে নারীদের প্রতি শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। বরং তাদের প্রতি সহনশীল, স্নেহময় ও সম্মানজনক আচরণ করতে বলা হয়েছে।

++++
বিজ্ঞান ও দর্শনের ভিত্তিতেও.......

ইসলামে নারীদের প্রতি সম্মান, মর্যাদা ও সদাচরণের নির্দেশনা কেবল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বিজ্ঞান ও দর্শনের ভিত্তিতেও যুক্তিযুক্ত এবং উপকারী। 
এর বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, নারীদের প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা শুধু নৈতিক নয়, এটি মানবিক এবং মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১. বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা:

মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব:

নারীদের উপর শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
 মনোবিজ্ঞান বলছে, নির্যাতিত নারীরা দীর্ঘমেয়াদি ট্রমার শিকার হন, যা পরবর্তীতে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবিশ্বাসের জন্ম দেয়।

Post-Traumatic Stress Disorder (PTSD):

নির্যাতনের কারণে নারীদের মধ্যে PTSD-এর লক্ষণ দেখা দেয়, যার ফলে তারা দৈনন্দিন জীবনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারেন এবং তাদের কর্মক্ষমতা কমে যেতে পারে।

শিশুদের উপর প্রভাব: 

গবেষণায় দেখা গেছে, মায়ের উপর সহিংস আচরণের প্রত্যক্ষ প্রভাব শিশুদের উপরও পড়ে। শিশুরা একটি অসুস্থ পরিবেশে বেড়ে উঠলে তাদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয় এবং তাদের মধ্যেও ভবিষ্যতে সহিংস আচরণ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

শারীরিক প্রভাব:
নারী শরীর স্বাভাবিকভাবেই শারীরিক আঘাতের প্রতি পুরুষের তুলনায় অধিক সংবেদনশীল।

 শারীরিক নির্যাতনের ফলে নারীদের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ক্ষতি হতে পারে, যেমন হাড় ভেঙে যাওয়া, অভ্যন্তরীণ রক্তপাত, এবং স্থায়ী শারীরিক অক্ষমতা।

চিকিৎসা বিজ্ঞান: 
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী, শারীরিক নির্যাতন বা আঘাতের কারণে নারীদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ শরীরের বিভিন্ন রোগকে উদ্দীপিত করে, যার ফলে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা দুটোই হুমকির মুখে পড়ে।

স্নায়ুবিজ্ঞান ও হরমোনাল প্রতিক্রিয়া:

নারীরা মানসিক বা শারীরিক আঘাতের সময় কর্টিসল (Cortisol) এবং অ্যাড্রেনালিন (Adrenaline) নামক স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ করে, যা শরীর ও মনের উপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়া, এন্ডোরফিন ও অক্সিটোসিনের মতো সুখজনক হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়, যা তাদের সুখ ও সন্তুষ্টির অভাব ঘটায়।

২. দার্শনিক ভিত্তিক আলোচনা:

মানবিক মর্যাদা ও নৈতিকতা:

দার্শনিকভাবে, মানবিক মর্যাদা ও সম্মান সকল মানুষের জন্য সমান। ইমানুয়েল কান্টের "মানবিক মর্যাদা" তত্ত্ব অনুসারে, প্রতিটি মানুষকে লক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করা উচিত, কোনো মাধ্যম হিসেবে নয়। নারীর প্রতি সহিংস আচরণ একজন নারীকে কেবল একটি বস্তু হিসেবে ব্যবহার করার শামিল, যা তাঁর মৌলিক মানবিক মর্যাদার লঙ্ঘন। ইসলামেও একই কথা বলা হয়েছে, নারীদের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করা তাদের অধিকার

ন্যায্যতার নীতি: 

প্লেটোর ন্যায়বিচারের তত্ত্বে, ন্যায়ের ভিত্তি হলো সকল মানুষের প্রতি সমতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। নারীর প্রতি নির্যাতন একটি বিশাল অন্যায়, কারণ এটি ব্যক্তির অধিকার এবং মর্যাদা হরণ করে। ইসলামে পুরুষ ও নারী উভয়কেই আল্লাহর সৃষ্টির অংশ হিসেবে সমান মর্যাদার অধিকারী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

শান্তি ও পারিবারিক সুরক্ষা:

পরিবার হলো সমাজের মৌলিক একক, এবং এর সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ বিকাশের জন্য পরিবারে সকল সদস্যের মধ্যে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সমঝোতা থাকতে হবে। এ কারণে, ইসলাম শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনকে কঠোরভাবে নিষেধ করে, কারণ এটি পরিবারে অস্থিরতা ও বিভাজন সৃষ্টি করে।

অহিংসার নীতি: 

মহাত্মা গান্ধী ও বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসার ধারণা অনুযায়ী, শক্তি বা জোর প্রয়োগ করে কোন কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়। শান্তি ও ভালোবাসার মাধ্যমেই পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে স্থিতিশীলতা অর্জন সম্ভব। ইসলামের শিক্ষাও নারীদের প্রতি সহনশীল ও দয়ালু আচরণের উপর গুরুত্ব দেয়।

নারী স্বাধীনতা ও অধিকার:

নারীর স্বাধীনতা ও আত্মসম্মান আধুনিক দার্শনিক চিন্তায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। নারীরা কোনো পুরুষের অধীনস্থ নয়, বরং তারা সমাজের সমান অধিকার ভোগী। জন লকের "স্বাধীনতা ও সমতা" তত্ত্ব অনুসারে, প্রতিটি মানুষ তার মৌলিক স্বাধীনতা নিয়ে জন্মায়, যা কেবল তার শারীরিক স্বাধীনতায় নয়, তার মানসিক ও সামাজিক অবস্থানেও সমানভাবে প্রযোজ্য।

ইসলাম নারীদের এই অধিকার এবং স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রদান করেছে। নারীরা শুধুমাত্র পরিবারের অংশ নয়, তারা সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এবং তাদের অধিকারও সেভাবেই প্রতিষ্ঠিত।

৩. আবেগ ও সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রভাব:

সম্পর্কের স্থায়িত্ব:

নির্যাতন সম্পর্কের মধ্যে বিচ্ছেদ ও অবিশ্বাসের সৃষ্টি করে। নারী ও পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও বিশ্বাস না থাকলে সম্পর্কের স্থায়িত্ব অসম্ভব হয়ে পড়ে। মানবিক সম্পর্কের একটি প্রধান ভিত্তি হলো "পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমঝোতা," যা সহিংসতার মাধ্যমে সম্ভব নয়।

অভ্যন্তরীণ শান্তি:

অভ্যন্তরীণ শান্তি, যা একটি সুস্থ সম্পর্কের মূল ভিত্তি, সহিংসতা ও নির্যাতনের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেকোনো সম্পর্কের জন্য আবেগিক নিরাপত্তা এবং সুরক্ষিত মানসিক পরিবেশ অত্যন্ত জরুরি। এটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘমেয়াদে কষ্ট পেতে থাকে।

উপসংহার:

ইসলামের শিক্ষা শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, এটি মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও দর্শন থেকে দেখা হলে দেখা যায়, নারীর প্রতি সহিংসতা বা শারীরিক আঘাতের কোনো নৈতিক বা যুক্তিসংগত ভিত্তি নেই।



---কাজী সাইফ উদদীন আহমেদ,
Lecturer, Federal Homoeopathic Medical College, Dhaka.


আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। 
>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন