পর্যাপ্ত সংখ্যক হোমিওপ্যাথিক ওষুধের জ্ঞান না থাকলে ওষুধ নির্বাচন যেভাবে করতে হয়।
হ্যাঁ, হ্যানিম্যানের অর্গাননের এফোরিজম #১৬২ থেকে #১৭৯-এর মধ্যে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় ওষুধ নির্বাচন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা, দর্শন ও প্রয়োগিক বিজ্ঞানভিত্তিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, বিশেষ করে তখন যখন একক ওষুধের নির্ভুল নির্বাচন সম্ভব নয় বা পর্যাপ্ত তথ্য-লক্ষণ অনুযায়ী সরাসরি উপযুক্ত ঔষধ নির্ধারণ করা যায় না।
নিচে আমরা এফোরিজম #১৬২–১৭৯ এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করব তিনটি দৃষ্টিভঙ্গিতে:
---
✅ ১। দর্শনভিত্তিক আলোচনা: হ্যানিম্যানের দৃষ্টিতে রোগ ও রোগী।
---
🔹 রোগ নয়, রোগীকে বোঝা – এই নীতি থেকেই শুরু:
হ্যানিম্যান মনে করেন, প্রকৃত চিকিৎসা তখনই সম্ভব যখন চিকিৎসক রোগের বাহ্যিক নাম বা প্রকাশ নয়, রোগীর ব্যক্তিগত লক্ষণগত স্বভাব ও তার অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া-ক্ষমতা বুঝে চিকিৎসা করেন।
> এফোরিজম 162 থেকে শুরু হয় এমন পরিস্থিতি নিয়ে, যেখানে একটি মাত্র ওষুধ রোগের সমস্ত লক্ষণ ঢাকতে পারে না।
🔹 একাধিক ওষুধের প্রয়োজনীয়তা দর্শনগত দিক থেকে:
অনেক রোগে একাধিক স্তর বা প্যাথলজিক্যাল জটিলতা থাকে।
সেক্ষেত্রে একটি মাত্র ওষুধে রোগী পুরোপুরি সাড়া দেয় না, তখন প্রয়োজন হয় ধাপে ধাপে একাধিক উপযুক্ত ওষুধ প্রয়োগের।
🔹 রোগের স্তর অনুযায়ী চিকিৎসা:
কখনো কখনো "ধ্বংসপ্রাপ্ত Vital Force" কে ধীরে ধীরে পুনরুজ্জীবিত করতে হয়।
এজন্য হ্যানিম্যান বলেন, একের পর এক কিছুটা উপযুক্ত ওষুধ প্রয়োগ করে রোগীর অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হয় – যেন চূড়ান্ত উপযুক্ত ওষুধ কাজ করতে পারে।
---
✅ ২। বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা: ক্লিনিক্যাল জটিলতা ও পরিবর্তনশীল লক্ষণ।
---
📘 Aphorism 162–169:
🔍 বিষয়: যদি একটি ওষুধ পুরো রোগচিত্র কভার না করে, তাহলে কীভাবে পরবর্তী ওষুধ নির্বাচন করা যায়
হ্যানিম্যান দেখিয়েছেন:
> প্রথমে একটি ওষুধ দিন, যা সম্ভবপর লক্ষণগুলো কভার করে, তারপর লক্ষণগুলো কিভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তা দেখুন।
লক্ষণ পরিবর্তনের ভিত্তিতে পরবর্তী ওষুধ দিন – এটাকে তিনি বলেন "Sequential remedy selection".
📘 Aphorism 170–171:
🔍 বিষয়: যৌগিক রোগ বা মিশ্র লক্ষণসমষ্টিতে (complex chronic cases) ওষুধ নির্বাচন।
একাধিক ঔষধ প্রয়োগের নীতিমালা তখন প্রয়োজন, যখন রোগটি
১) দীর্ঘস্থায়ী,
২) দমন করা রোগের পুনরাগমন,
৩) জটিল প্যাথলজির উপস্থিতি ইত্যাদি থাকে।
বিজ্ঞানসম্মতভাবে তখন একাধিক ঔষধ "ফেইজ বাই ফেইজ" প্রয়োগ করতে হয়।
📘 Aphorism 172–174:
🔍 বিষয়: যখন নতুন নতুন লক্ষণ উদ্ভব হয় বা আগের লক্ষণগুলো পরিবর্তিত হয়।
পূর্বে দেয়া ওষুধ কাজ করার পর রোগী নতুন উপসর্গ তৈরি করতে পারে — তখন সেগুলো আবার পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী ওষুধ দিতে হয়।
এটাই হলো “Successive prescribing”।
📘 Aphorism 175–176:
🔍 বিষয়: দমন করা রোগ ও মেডোরিনাল প্যাথলজি।
যদি রোগের একটি অংশ চেপে রাখা হয় (যেমন: কর্টিকোস্টেরয়েড, অ্যান্টিবায়োটিক ইত্যাদির মাধ্যমে), তাহলে হ্যানিম্যান নির্দেশ দেন সেই দমন করা লক্ষণ ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে এমন ওষুধ নির্বাচন করা।
📘 Aphorism 177–179:
🔍 বিষয়: উপসর্গহীন অবস্থায় ওষুধ নির্বাচন এবং পল্লবিত (palliation) চিকিৎসা।
যখন রোগী এমন অবস্থায় থাকে, যেখানে তাঁর কোনো প্রকাশ্য লক্ষণ নেই, তখন ঐতিহাসিক তথ্য (past history) ও মিয়াজমেটিক ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে ওষুধ নির্বাচন করতে হয়।
শেষ এফোরিজমগুলোতে তিনি বলেন, পল্লবিত ( palliation) চিকিৎসাও হোমিওপ্যাথির মধ্যে স্থান পায়, তবে সেটা রোগ নিরাময়ের জন্য নয়, রোগীকে আরাম দেওয়ার জন্য।
---
✅ ৩। হোমিও নিয়মনীতি ভিত্তিক আলোচনা: বাস্তব প্রয়োগ ও নির্দেশনা।
---
🔹 একাধিক ওষুধ কখন প্রয়োগ করবেন না:
কখনোই দুটি ওষুধ একসাথে নয় — এটি হ্যানিম্যান কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।
রোগীকে ধৈর্যের সাথে পর্যবেক্ষণ করে একটির পর একটি ওষুধ দিন।
🔹 লক্ষণ পর্যবেক্ষণের পদ্ধতি:
ওষুধ দেয়ার পর প্রতিটি নতুন বা পরিবর্তিত উপসর্গ লিখে রাখুন।
এগুলো মিলিয়ে পরবর্তী ওষুধ নির্বাচন করুন।
এই পদ্ধতি হ্যানিম্যান বলেছেন “second best medicine for remaining symptoms”।
🔹 মিয়াজম বিবেচনা:
জটিল রোগে মিয়াজমিক অবস্থান বিশ্লেষণ করে পর্যায়ক্রমিকভাবে
Anti-psoric → Anti-sycotic → Anti-syphilitic ওষুধ প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে।
---
✅ সারাংশ টেবিলে:
এফোরিজম # 162–169
বিষয়বস্তু : একাধিক ধাপে ওষুধ নির্বাচন।
মূল দর্শন / বিজ্ঞান: লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে ক্রমান্বয়ে ওষুধ।
এফোরিজম # 170–171
বিষয়বস্তু : জটিল ও মিশ্র রোগ
মূল দর্শন / বিজ্ঞান: স্তরভিত্তিক চিকিৎসা
এফোরিজম # 172–174
বিষয়বস্তু : নতুন লক্ষণ উদ্ভব
মূল দর্শন / বিজ্ঞান: Successive prescribing।
এফোরিজম # 175–176
বিষয়বস্তু : দমন করা রোগ
মূল দর্শন / বিজ্ঞান: মিয়াজমিক ওষুধ প্রয়োগ।
এফোরিজম # 177–179
বিষয়বস্তু : উপসর্গহীন অবস্থা / পল্লবিত চিকিৎসা
মূল দর্শন / বিজ্ঞান: ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে নির্বাচন।
---
📌 উপসংহার:
হ্যানিম্যান এখানে অত্যন্ত সুবিবেচক ও বাস্তববাদীভাবে বুঝিয়েছেন, যে প্রতিটি রোগী, প্রতিটি কেস আলাদা।
পর্যাপ্ত ওষুধজ্ঞান না থাকলেও, যদি আপনি কেস পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা রাখেন এবং ধাপে ধাপে রোগীর প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করতে পারেন – তবে সঠিক ও কার্যকর ওষুধের পথে পৌঁছানো সম্ভব।
-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি,
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা
প্রভাষক,
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ।
আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ।
>Share by:
Make a comments as guest/by name or from your facebook:
Make a comment by facebook: