গর্ভাবস্থা বা গর্ভধারণের সময়কাল মোটামুটি ৪০ সপ্তাহের হয়ে থাকে, যা একজন নারীর শেষ মাসিক চক্রের প্রথম দিন থেকে শুরু করে প্রসব পর্যন্ত গণনা করা হয়। গর্ভাবস্থার এই সময়কালকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়, যেগুলোকে ত্রৈমাসিক বলা হয়।
১ম ত্রৈমাসিক (১-১২ সপ্তাহ):
প্রাথমিক পর্যায়ের গর্ভাবস্থা: এই সময়ে ভ্রূণটি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং প্রধান অঙ্গগুলির গঠন শুরু হয়।
লক্ষণসমূহ:
গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে অনেক নারী বমি বমি ভাব (মর্নিং সিকনেস), বমি, ক্লান্তি, এবং স্তনে ব্যথা অনুভব করেন।
এই সময়ে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তন বেশি অনুভূত হয়।
২য় ত্রৈমাসিক (১৩-২৬ সপ্তাহ):
ভ্রূণের বৃদ্ধি: এই সময়ে ভ্রূণটি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং মা ভ্রূণের নড়াচড়া অনুভব করতে শুরু করেন।
লক্ষণসমূহ:
বমিভাব কমে আসে এবং গর্ভের আকার বৃদ্ধি পায়।
পায়ে এবং পায়ের গোড়ালিতে ফোলাভাব দেখা দিতে পারে।
মায়ের ত্বক ও চুলে কিছু পরিবর্তন দেখা যেতে পারে।
৩য় ত্রৈমাসিক (২৭-৪০ সপ্তাহ):
ভ্রূণের পূর্ণতা: ভ্রূণটি আরও বড় হয়ে উঠে এবং প্রসবের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।
লক্ষণসমূহ:
এই সময়ে শ্বাসকষ্ট, পিঠের ব্যথা, এবং ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
মায়ের শরীরে অতিরিক্ত ওজনের কারণে শারীরিক কষ্ট বাড়তে পারে এবং প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসে।
প্রসব:
গর্ভাবস্থার ৩৭ থেকে ৪২ সপ্তাহের মধ্যে প্রসব ঘটে। প্রসবের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগে কিছু লক্ষণ দেখা যায়, যেমন প্রসব বেদনা বা নিয়মিত সংকোচন, যা সময়ের সঙ্গে আরও তীব্র হতে থাকে।
গর্ভাবস্থাকে সাধারণত মাস ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা হল :
গর্ভধারণের সময়কালে প্রতি মাসে মা এবং ভ্রূণের শরীরে বিভিন্ন ধরণের পরিবর্তন ঘটে। গর্ভাবস্থাকে সাধারণত মাস ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা হয়।
এখানে প্রতি মাসের প্রধান ঘটনা ও লক্ষণগুলো বর্ণনা করা হলো:
১ম মাস:
প্রাথমিক ভ্রূণের গঠন শুরু: নিষেকের পর ভ্রূণটি জরায়ুতে স্থাপন হয় এবং এর কোষ বিভাজন শুরু হয়। প্লাসেন্টা (অমরা) গঠিত হতে থাকে, যা ভ্রূণকে পুষ্টি প্রদান করে।
লক্ষণসমূহ: মাসিক বন্ধ হয়ে যায়, হালকা ক্লান্তি, স্তনে কোমলতা, এবং মেজাজের পরিবর্তন দেখা দিতে পারে।
২য় মাস:
অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন শুরু: এই সময়ে ভ্রূণের প্রধান অঙ্গগুলো যেমন হার্ট, ব্রেইন, এবং স্পাইনাল কর্ড গঠন হতে থাকে।
লক্ষণসমূহ: মর্নিং সিকনেস, বমি বমি ভাব এবং ক্লান্তি বেড়ে যায়।
৩য় মাস:
প্রাথমিক অঙ্গ গঠন সম্পূর্ণ: ভ্রূণটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গঠিত হয়, তবে পুরোপুরি বিকশিত হয়নি। এখন থেকে এটিকে ভ্রূণ বলা হয়।
লক্ষণসমূহ: ক্লান্তি এবং বমির প্রকোপ থাকতে পারে, তবে কিছু নারী এর থেকে মুক্তি পেতে শুরু করেন।
৪র্থ মাস:
ভ্রূণের বিকাশ: ভ্রূণটি দ্রুত বৃদ্ধি পায়, এবং তার মুখ, আঙুল, এবং পায়ের আঙুলগুলো স্পষ্টভাবে গঠিত হয়।
লক্ষণসমূহ: মায়ের বমিভাব কমে যেতে পারে এবং পেটের আকার কিছুটা বেড়ে যেতে পারে। মা ভ্রূণের নড়াচড়া অনুভব করতে শুরু করতে পারেন।
৫ম মাস:
ভ্রূণের নড়াচড়া স্পষ্ট: এই সময়ে মা স্পষ্টভাবে ভ্রূণের নড়াচড়া অনুভব করবেন। এই সময়ে ভ্রূণের চুল এবং ভ্রূণ ত্বকের উপর ল্যানুগো নামক পাতলা লোম বৃদ্ধি পেতে থাকে।
লক্ষণসমূহ: পেটে টান টান ভাব, কোমর ও পিঠে ব্যথা হতে পারে।
৬ষ্ঠ মাস:
ভ্রূণের বৃদ্ধি ও প্রতিক্রিয়া: ভ্রূণ এখন বাইরে থেকে আলো বা শব্দের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।
লক্ষণসমূহ: পেটে বা পায়ে ফোলাভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, বুক জ্বালাপোড়া এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে।
৭ম মাস:
ভ্রূণের দ্রুত ওজন বৃদ্ধি: ভ্রূণের মস্তিষ্ক দ্রুত বিকশিত হয় এবং শরীরে চর্বি জমতে শুরু করে।
লক্ষণসমূহ: শারীরিক অস্বস্তি বৃদ্ধি পায়, পেটে চাপ পড়া, ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রবণতা দেখা যায়।
৮ম মাস:
প্রসবের জন্য প্রস্তুতি: ভ্রূণ এখন প্রসবের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং এর মাথাটি নিচের দিকে নামতে শুরু করে।
লক্ষণসমূহ: পেটে ও পিঠে ব্যথা, পায়ে ফোলাভাব এবং ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রবণতা।
৯ম মাস:
ভ্রূণের পূর্ণ বিকাশ: ভ্রূণ এখন জন্ম নেওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। এটি এখন প্রায় ৪৫-৫০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ২.৫ থেকে ৩.৫ কেজি ওজনের হয়।
লক্ষণসমূহ: তীব্র ব্যথা, পিঠে এবং তলপেটে চাপ, এবং প্রসব বেদনা দেখা দিতে পারে।
এই সময়ের মধ্যে মায়ের শরীরে বিভিন্ন হরমোন পরিবর্তন হয়, যা তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে বাধ্য করে।
৷৷৷ গর্ভাবস্থা বা গর্ভধারণের ৪০ সপ্তাহের আলোচনা করুন :
গর্ভাবস্থা সাধারণত ৪০ সপ্তাহের হয়, যা ভ্রূণের বিকাশের একটি ধাপে ধাপে প্রক্রিয়া।
প্রতিটি সপ্তাহে ভ্রূণের বিকাশ এবং মায়ের শরীরে পরিবর্তন ঘটে। এখানে প্রতিটি সপ্তাহের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং লক্ষণগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো:
প্রথম ত্রৈমাসিক (১ম থেকে ১২তম সপ্তাহ):
১-২ সপ্তাহ:
নিষেক ও প্রস্তুতি: জরায়ুতে ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া ঘটে। প্রথম দিকে মাসিক চক্রের জন্য জরায়ু প্রস্তুত হয়, এবং নিষেক ঘটলে ডিম্বাণু জরায়ুর দেয়ালে স্থাপন হয়।
৩-৪ সপ্তাহ:
ভ্রূণের গঠন শুরু: কোষ বিভাজন শুরু হয় এবং একটি ছোট্ট ভ্রূণ তৈরি হয়, যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
লক্ষণ: অনেক নারী এই পর্যায়ে এখনও গর্ভাবস্থার লক্ষণগুলি টের পান না, তবে হালকা ক্লান্তি বা বমিভাব হতে পারে।
৫ সপ্তাহ:
হার্ট স্পন্দন শুরু: ভ্রূণের হৃদযন্ত্রের গঠন সম্পন্ন হয় এবং এটি স্পন্দন করতে শুরু করে। মস্তিষ্ক, মেরুদণ্ড এবং অন্যান্য প্রধান অঙ্গের গঠন শুরু হয়।
লক্ষণ: স্তনে কোমলতা, ক্লান্তি, এবং ঘন ঘন প্রস্রাবের প্রবণতা দেখা দিতে পারে।
৬-৭ সপ্তাহ:
অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন: হাত, পা এবং মুখের প্রাথমিক গঠন শুরু হয়।
লক্ষণ: মর্নিং সিকনেস বৃদ্ধি পেতে পারে, স্তনে ব্যথা এবং ক্লান্তি বেশি অনুভূত হতে পারে।
৮-৯ সপ্তাহ:
ভ্রূণের নড়াচড়া: ভ্রূণটি হাত-পা নাড়াতে শুরু করে, যদিও মা এটি এখনো অনুভব করতে পারেন না।
লক্ষণ: ক্লান্তি বাড়তে থাকে এবং কিছু মায়ের ত্বকে ব্রণ দেখা দিতে পারে।
১০-১২ সপ্তাহ:
ভ্রূণের পুরো শরীরের গঠন: সমস্ত প্রধান অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গঠন সম্পন্ন হয়। হাত, পা, আঙ্গুল এবং পায়ের আঙ্গুল স্পষ্টভাবে গঠিত হয়।
লক্ষণ: মায়ের শরীরে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মেজাজের ওঠানামা, ক্লান্তি এবং বমিভাব অব্যাহত থাকতে পারে।
দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক (১৩তম থেকে ২৬তম সপ্তাহ):
১৩-১৪ সপ্তাহ:
হাড়ের বিকাশ: ভ্রূণের হাড়গুলি শক্ত হতে শুরু করে। লিঙ্গ নির্ধারণ সম্ভব হয়।
লক্ষণ: পেটের আকার বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং বমিভাব কমে আসতে পারে।
১৫-১৬ সপ্তাহ:
নাড়াচাড়া শুরু: ভ্রূণটি শক্তিশালীভাবে নড়াচড়া করতে শুরু করে, যদিও মা তা খুব স্পষ্টভাবে এখনো অনুভব নাও করতে পারেন।
লক্ষণ: মায়ের শক্তি কিছুটা ফিরে আসতে পারে এবং ত্বকের পরিবর্তন দেখা দিতে পারে।
১৭-১৮ সপ্তাহ:
শব্দ শুনতে পারে: ভ্রূণটি এখন বাইরের শব্দ শুনতে এবং আলো অনুভব করতে পারে।
লক্ষণ: মা কিছুটা নড়াচড়া অনুভব করতে শুরু করতে পারেন।
১৯-২০ সপ্তাহ:
নড়াচড়া স্পষ্টভাবে অনুভূত হয়: মায়ের পক্ষে স্পষ্টভাবে ভ্রূণের নড়াচড়া অনুভব করা সম্ভব।
লক্ষণ: পেট আরও বড় হয় এবং কোমর বা পিঠে ব্যথা হতে পারে।
২১-২২ সপ্তাহ:
ফুসফুসের বিকাশ: ভ্রূণের ফুসফুস বিকশিত হতে থাকে, তবে এটি এখনো নিজে শ্বাস নিতে অক্ষম।
লক্ষণ: কিছু মায়ের পায়ে বা মুখে ফোলাভাব দেখা দিতে পারে।
২৩-২৪ সপ্তাহ:
ভ্রূণের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা: যদি এই সময়ে ভ্রূণ জন্ম নেয়, তবে এটি কিছু উন্নত চিকিৎসার সহায়তায় বেঁচে থাকতে পারে।
লক্ষণ: পেটের আকার আরও বৃদ্ধি পায় এবং পায়ে ও পিঠে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
২৫-২৬ সপ্তাহ:
চোখের বিকাশ: ভ্রূণটি এখন চোখ খুলতে ও বন্ধ করতে পারে এবং আলোর প্রতি প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে।
লক্ষণ: বুক জ্বালাপোড়া, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে।
তৃতীয় ত্রৈমাসিক (২৭তম থেকে ৪০তম সপ্তাহ):
২৭-২৮ সপ্তাহ:
মস্তিষ্কের দ্রুত বিকাশ: ভ্রূণের মস্তিষ্ক দ্রুত বিকাশ লাভ করে। এটি এখন স্বপ্ন দেখতে সক্ষম হতে পারে।
লক্ষণ: শারীরিক অস্বস্তি বেড়ে যেতে পারে এবং মা রাতে ভাল ঘুমাতে কষ্ট পেতে পারেন।
২৯-৩০ সপ্তাহ:
ওজন বৃদ্ধি: ভ্রূণের ওজন দ্রুত বাড়তে থাকে। তার ফুসফুস এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলিও আরও বিকশিত হয়।
লক্ষণ: মায়ের পায়ে, হাতে এবং মুখে ফোলাভাব দেখা দিতে পারে।
৩১-৩২ সপ্তাহ:
ভ্রূণের স্থির অবস্থান: ভ্রূণটি এখন প্রসবের জন্য নিচের দিকে (মাথা নিচে) অবস্থান করে।
লক্ষণ: শারীরিক কষ্ট বেড়ে যায়, বিশেষত শ্বাস নিতে অসুবিধা হতে পারে।
৩৩-৩৪ সপ্তাহ:
প্রসবের প্রস্তুতি: ভ্রূণ এখন প্রায় প্রসবের জন্য প্রস্তুত। চর্বির স্তর জমা হয় এবং ফুসফুস প্রায় পুরোপুরি বিকশিত হয়।
লক্ষণ: পেটের আকার বড় হওয়ার কারণে পিঠের ব্যথা, অস্বস্তি এবং অনিদ্রা দেখা দিতে পারে।
৩৫-৩৬ সপ্তাহ:
সম্পূর্ণ পরিণত: ভ্রূণ প্রায় পরিণত হয় এবং যদি এখন জন্ম হয়, এটি বেঁচে থাকার জন্য প্রস্তুত।
লক্ষণ: তলপেটে ব্যথা এবং প্রসবের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
৩৭-৪০ সপ্তাহ:
প্রসবের প্রস্তুতি: ভ্রূণ জন্মের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। এর ওজন প্রায় ২.৫-৩.৫ কেজি এবং লম্বা প্রায় ৪৫-৫০ সেন্টিমিটার হয়।
লক্ষণ: প্রসব বেদনা, তলপেটে চাপ এবং নিয়মিত সংকোচন দেখা দিতে পারে।
সারাংশ:
গর্ভাবস্থার ৪০ সপ্তাহে ভ্রূণের বিকাশ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। প্রতিটি সপ্তাহে ভ্রূণের শরীর এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন ও বিকাশ ঘটে, এবং মায়ের শরীরে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে। মায়ের নিয়মিত চিকিৎসা, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, সুষম খাবার এবং মানসিক সমর্থন গর্ভাবস্থার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি,
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা
প্রভাষক,
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ।
আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ।
Tags:
Pregnancy
>Share by:
Make a comments as guest/by name or from your facebook:
Make a comment by facebook: