হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষদের যা জানা প্রয়োজন।
হোমিওপ্যাথি একটি সমন্বিত ও প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি যা রোগ নিরাময়ে লক্ষণ এবং ব্যক্তিগত প্রকৃতির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়।
এটি ১৭৯৬ সালে জার্মান চিকিৎসক ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান আবিষ্কার করেন। নিচে হোমিওপ্যাথির বিভিন্ন দিক বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।
নিচে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরা হলো:
১. হোমিওপ্যাথির মূলনীতি
হোমিওপ্যাথি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নীতির ওপর ভিত্তি করে কাজ করে। সেগুলো হলো:
(ক) "Like Cures Like"
রোগের যে উপসর্গগুলো দেখা দেয়, সেই উপসর্গগুলোর মতো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এমন পদার্থের খুব ক্ষুদ্র ডোজ রোগ নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়।
উদাহরণ: পেঁয়াজ (Allium Cepa) কাঁচা অবস্থায় চোখ ও নাক দিয়ে পানি ঝরায়। তবে হোমিওপ্যাথিক Allium Cepa ঔষধ এলার্জি বা ঠান্ডার কারণে চোখ-নাক দিয়ে পানি ঝরার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
(খ) Minimum Dose (ক্ষুদ্রতম মাত্রা)
ওষুধের পরিমাণ খুবই ক্ষুদ্র হয়, যা শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা সক্রিয় করে।
ক্ষুদ্র ডোজ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত এবং দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
(গ) Individualization (ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিকিৎসা)
প্রতিটি রোগীর ব্যক্তিগত লক্ষণ, শারীরিক গঠন, আবেগগত অবস্থা এবং জীবনধারা অনুযায়ী চিকিৎসা নির্ধারণ করা হয়।
দুইজন রোগীর একই রোগ হলেও, তাদের জন্য ভিন্ন ওষুধ নির্ধারিত হতে পারে।
২. হোমিওপ্যাথি ওষুধের উৎপত্তি এবং প্রস্তুতি
(ক) উৎস
প্রাকৃতিক উপাদান যেমন গাছপালা (Belladonna, Arnica), খনিজ (Sulphur, Calcarea Carbonica), এবং প্রাণিজ পদার্থ (Apis Mellifica, Sepia) থেকে ওষুধ তৈরি করা হয়।
(খ) প্রস্তুত প্রণালী
Dilution (জলকরণ): ওষুধকে বারবার মিশ্রিত ও ঝাঁকিয়ে খুব ক্ষুদ্র পরিমাণ সক্রিয় পদার্থ তৈরি করা হয়।
Potentization (শক্তিবৃদ্ধি): প্রতিটি ধাপে ঝাঁকানোর মাধ্যমে ওষুধের কার্যক্ষমতা বাড়ানো হয়। এতে ওষুধ শক্তিশালী হলেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমে যায়।
৩. হোমিওপ্যাথি কিভাবে কাজ করে
হোমিওপ্যাথি শরীরের প্রাকৃতিক নিরাময় ক্ষমতা উদ্দীপিত করে।
এটি রোগের মূলে কাজ করে, শুধুমাত্র লক্ষণগুলো দূর করে না।
হোমিওপ্যাথিক ওষুধ শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে দীর্ঘমেয়াদী সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
৪. হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার কার্যকারিতা
হোমিওপ্যাথি বিভিন্ন ধরনের শারীরিক এবং মানসিক রোগের জন্য কার্যকর। এটি দীর্ঘমেয়াদী এবং জটিল রোগে ভালো ফলাফল দেয়।
(ক) তীব্র রোগ (Acute Diseases):
ঠান্ডা, কাশি, জ্বর, ডায়রিয়া, এবং ভাইরাল সংক্রমণ।
সঠিক ওষুধ দ্রুত আরোগ্য দিতে পারে।
(খ) দীর্ঘমেয়াদী রোগ (Chronic Diseases):
অ্যাজমা, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, এবং সোরিয়াসিস।
এসব রোগে ধৈর্য এবং ধারাবাহিক চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
(গ) মানসিক ও আবেগজনিত সমস্যা:
উদ্বেগ (Anxiety), হতাশা (Depression), এবং ঘুমের সমস্যা।
হোমিওপ্যাথি মানসিক প্রশান্তি আনে এবং ভারসাম্য বজায় রাখে।
(ঘ) নারী ও শিশুদের সমস্যা:
গর্ভাবস্থার জটিলতা, মেনস্ট্রুয়াল ডিসঅর্ডার, এবং বাচ্চাদের বৃদ্ধি সংক্রান্ত সমস্যা।
৫. হোমিওপ্যাথির সুবিধা
(ক) পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত
হোমিওপ্যাথিক ওষুধ ক্ষুদ্রমাত্রায় হওয়ায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
এটি নিরাপদ এবং গর্ভবতী নারী ও শিশুদের জন্যও উপযোগী।
(খ) সমন্বিত চিকিৎসা
এটি শারীরিক, মানসিক এবং আবেগগত দিকগুলো বিবেচনা করে সম্পূর্ণ সমাধান দেয়।
(গ) দীর্ঘমেয়াদী সমাধান
রোগের মূলে কাজ করে এবং পুনরায় রোগ না হওয়ার নিশ্চয়তা দেয়।
(ঘ) সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী
হোমিওপ্যাথিক ওষুধ তুলনামূলকভাবে সস্তা এবং সহজে পাওয়া যায়।
৬. সাধারণ ভুল ধারণা এবং সতর্কতা
ভুল ধারণা:
1. ধীরগতি চিকিৎসা: হোমিওপ্যাথি শুধু দীর্ঘমেয়াদী নয়, তীব্র রোগেও কার্যকর।
2. বিশ্বাসভিত্তিক পদ্ধতি: এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত এবং লক্ষণের ভিত্তিতে কাজ করে।
সতর্কতা:
সঠিক ওষুধ এবং ডোজ নিশ্চিত করতে একজন যোগ্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
নিজের ইচ্ছামতো ওষুধ গ্রহণ করা উচিত নয়।
যদি রোগ গুরুতর হয়, তবে হোমিওপ্যাথির পাশাপাশি প্রয়োজন হলে অন্য চিকিৎসা গ্রহণ করুন।
৭. চিকিৎসার সফলতার শর্ত
1. রোগীর সম্পূর্ণ ইতিহাস জানা।
2. রোগীর মানসিক, শারীরিক, পারিবারিক বশংগত অবস্থা এবং সামাজিক অবস্থা এমন কি মায়ের পেটে নয় মাস এর ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করা।
3. রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে আস্থা এবং যোগাযোগ বজায় রাখা।
৮. কেন হোমিওপ্যাথি বেছে নেবেন
এটি প্রাকৃতিক, নিরাপদ এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক।
রোগের মূলে কাজ করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করে।
দীর্ঘমেয়াদী এবং জটিল রোগে কার্যকর।
হোমিওপ্যাথি সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে এটি একটি সুরক্ষিত এবং কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি যা রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা সম্পর্কে আরো গভীরভাবে আলোচনা করতে গেলে এর দর্শন, কার্যকারিতা, চিকিৎসার পদ্ধতি, এবং বিশেষ সুবিধাসমূহ বিশদভাবে বোঝা প্রয়োজন। নিচে এই বিষয়গুলোর প্রতিটিকে আরও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো।
১. হোমিওপ্যাথির দর্শন
হোমিওপ্যাথি বিশ্বাস করে যে মানবদেহ নিজেই আরোগ্যের শক্তি ধারণ করে। এটি কেবল রোগের লক্ষণ দূর করার চেষ্টা করে না, বরং রোগের মূল কারণ খুঁজে বের করে তাকে নির্মূল করে।
মূল দর্শন:
Vital Force বা জীবনীশক্তি: হোমিওপ্যাথির মতে, দেহে একটি জীবনীশক্তি (Vital Force) আছে, যা দেহকে সুস্থ রাখে। এই শক্তি দুর্বল হলে রোগ সৃষ্টি হয়। হোমিওপ্যাথি এই শক্তিকে উদ্দীপিত করে।
সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গি: এটি রোগীকে কেবল দেহের একটি অংশ হিসেবে নয়, বরং শারীরিক, মানসিক এবং আবেগগত একটি পূর্ণাঙ্গ সত্তা হিসেবে বিবেচনা করে।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য: দেহের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখাই হল হোমিওপ্যাথির লক্ষ্য।
২. হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার মূল স্তম্ভ
(ক) রোগীর সম্পূর্ণ ইতিহাস:
হোমিওপ্যাথি কেবল রোগ নয়, রোগীর সমগ্র জীবনধারা, ব্যক্তিত্ব, এবং আবেগগত অবস্থার উপর জোর দেয়।
উদাহরণ: একজন মানুষ যদি অ্যাজমায় ভোগেন এবং একইসঙ্গে রাগ খুব বেশি হয়, তাহলে চিকিৎসার সময় সেই রাগের দিকটিও বিবেচনা করা হয়।
(খ) ব্যতিক্রমী লক্ষণ খুঁজে বের করা:
রোগী যেসব ব্যতিক্রমী লক্ষণ দেখান, তা থেকে নির্ধারণ করা হয় কোন ওষুধ কার্যকর হবে।
উদাহরণ: মাথা ব্যথার ওষুধ দুইজন মানুষের জন্য ভিন্ন হতে পারে যদি তাদের ব্যথার ধরন ও সময় ভিন্ন হয়।
(গ) প্রতিস্থাপন নীতি:
হোমিওপ্যাথি রোগের মূলে কাজ করে, তাই এটি কেবল উপসর্গ দমন করার চেষ্টা করে না।
উপসংহার
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা কেবল একটি চিকিৎসা পদ্ধতি নয়, বরং এটি জীবনের প্রতি একটি পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি। এটি রোগীকে তার শরীরের প্রাকৃতিক শক্তি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। সঠিক প্রয়োগে, এটি রোগীর শারীরিক, মানসিক এবং আবেগগত সুস্থতার জন্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে।
-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি,
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা
প্রভাষক,
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ।
আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ।
>Share by:
Make a comments as guest/by name or from your facebook:
Make a comment by facebook: