এলোপ্যাথিক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলাফল হল থাইরয়েড ডিজঅর্ডার।

এলোপ্যাথিক (বা আধুনিক) ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় থাইরয়েড ডিজঅর্ডারের সমস্যা দেখা দিতে পারে। থাইরয়েড ডিজঅর্ডার হলে থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে হরমোনের নিঃসরণে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়, যা শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রভাব ফেলে। এখানে এলোপ্যাথিক ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে থাইরয়েড ডিজঅর্ডার কীভাবে সৃষ্টি হতে পারে, তা ব্যাখ্যা করা হলো:

১. ঔষধের প্রভাবের কারণে হাইপোথাইরয়েডিজম

কিছু এলোপ্যাথিক ওষুধ, 
যেমন লিথিয়াম এবং অ্যামিওডারোন হাইপোথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোনের অভাব) সৃষ্টি করতে পারে। লিথিয়াম থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়, যার ফলে হরমোনের নিঃসরণে সমস্যা হয়। অ্যামিওডারোনেও উচ্চমাত্রায় আয়োডিন থাকায় এটি থাইরয়েড হরমোনের উৎপাদন কমাতে পারে।

২. ঔষধের প্রভাবে হাইপারথাইরয়েডিজম

বেশ কিছু ওষুধ হাইপারথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত নিঃসরণ) ঘটাতে পারে। 

উদাহরণস্বরূপ, ইন্টারফেরন-আলফা এবং ইমিউনোথেরাপি হাইপারথাইরয়েডিজম সৃষ্টি করতে পারে। 
এই ওষুধগুলো শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে উদ্দীপ্ত করে, যা থাইরয়েড গ্রন্থিতে অতিরিক্ত কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে হরমোনের নিঃসরণ বাড়ায়।

৩. স্টেরয়েড ওষুধের প্রভাব

স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ যেমন কোর্টিকোস্টেরয়েড দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহারে থাইরয়েড হরমোনের বিপাক প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে পারে। ফলে থাইরয়েডের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে।

৪. অন্যান্য এলোপ্যাথিক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

এছাড়াও, অ্যান্টি-থাইরয়েড ওষুধ (যেমন মেথিমাজল, প্রোপিলথাইউরাসিল) অতিরিক্ত মাত্রায় সেবনে থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যক্ষমতা হ্রাস করতে পারে এবং হাইপোথাইরয়েডিজম সৃষ্টি করতে পারে।

থাইরয়েড ডিজঅর্ডার নিরাময়ে সচেতনতা

থাইরয়েড সমস্যার কারণে সৃষ্ট পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমাতে ডাক্তারদের সাথে আলোচনা করে সঠিক ডোজ এবং সঠিক ওষুধ নির্বাচন করা গুরুত্বপূর্ণ।

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা থাইরয়েড সমস্যা প্রতিরোধে সহায়ক।

থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায় ওষুধের সঠিক ডোজ নির্ধারণ এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ।


এলোপ্যাথিক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়াতে ও থাইরয়েড ডিজঅর্ডার প্রতিরোধে ডাক্তারদের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।



++++

থাইরয়েড ডিজঅর্ডার এবং এলোপ্যাথিক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা যাক। থাইরয়েড গ্রন্থি শরীরের মেটাবলিজম, হৃৎপিণ্ডের গতি, মানসিক স্বাস্থ্য, এবং শরীরের বিভিন্ন সিস্টেম নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এলোপ্যাথিক ওষুধের দীর্ঘমেয়াদী বা অতিরিক্ত ব্যবহার থাইরয়েড গ্রন্থির স্বাভাবিক কার্যকারিতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। নিচে বিভিন্ন ওষুধের প্রভাবে কিভাবে থাইরয়েড ডিজঅর্ডার দেখা দেয়, তা বিশদে আলোচনা করা হলো।

১. লিথিয়াম ওষুধের প্রভাব

লিথিয়াম সাধারণত বাইপোলার ডিজঅর্ডার এবং অন্যান্য মানসিক রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এটি থাইরয়েড হরমোনের নিঃসরণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে। লিথিয়াম থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যক্ষমতাকে হ্রাস করে এবং হাইপোথাইরয়েডিজম সৃষ্টি করতে পারে। প্রায় ৫-৫০% রোগী যারা লিথিয়াম গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে হাইপোথাইরয়েডিজম দেখা দেয়।

২. অ্যামিওডারোন ও আয়োডিনযুক্ত ওষুধের প্রভাব

অ্যামিওডারোন হৃদরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত একটি ওষুধ, যা উচ্চমাত্রায় আয়োডিন ধারণ করে। থাইরয়েড হরমোনের উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রণে আয়োডিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অ্যামিওডারোনে থাকা অতিরিক্ত আয়োডিন থাইরয়েড গ্রন্থিতে অতিরিক্ত হরমোন নিঃসরণ ঘটাতে পারে, যা হাইপারথাইরয়েডিজম সৃষ্টি করে। একই সময়ে, এটি কিছু রোগীর ক্ষেত্রে হাইপোথাইরয়েডিজমও সৃষ্টি করতে পারে।

৩. ইন্টারফেরন ও ইমিউনোথেরাপি

ইন্টারফেরন-আলফা একটি ইমিউনোথেরাপি, যা সাধারণত হেপাটাইটিস ও কিছু ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ইন্টারফেরন ইমিউন সিস্টেমকে উদ্দীপ্ত করে এবং এর মাধ্যমে থাইরয়েড গ্রন্থিতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। ইন্টারফেরনের প্রভাবে অটোইমিউন থাইরয়েডিটিস নামক অবস্থা দেখা দিতে পারে, যেখানে শরীরের নিজস্ব ইমিউন সিস্টেম থাইরয়েড গ্রন্থিকে আক্রমণ করে, যার ফলে হাইপোথাইরয়েডিজম বা হাইপারথাইরয়েডিজম হতে পারে।

৪. গ্লুকোকার্টিকয়েড ওষুধের প্রভাব

গ্লুকোকার্টিকয়েড (যেমন প্রেডনিসোন) প্রদাহ কমাতে ব্যবহৃত হয়। এটি থাইরয়েড হরমোনের কার্যকারিতাকে হ্রাস করতে পারে এবং এর দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কমে যেতে পারে।

৫. অ্যান্টি-থাইরয়েড ওষুধ (যেমন মেথিমাজল এবং প্রোপিলথাইউরাসিল)

এই ওষুধগুলো থাইরয়েড হরমোনের নিঃসরণ কমাতে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু অতিরিক্ত সেবনে হাইপোথাইরয়েডিজম হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, এই ওষুধগুলো থাইরয়েড গ্রন্থিকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করে ফেলে।

৬. এলোপ্যাথিক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রতিরোধ ব্যবস্থা

থাইরয়েড ডিজঅর্ডার প্রতিরোধে কিছু পদক্ষেপ নিচে উল্লেখ করা হলো:

নিয়মিত থাইরয়েড পরীক্ষা: যারা দীর্ঘমেয়াদী ওষুধ সেবন করেন, তাদের জন্য থাইরয়েড ফাংশন পরীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ।

ডোজ নিয়ন্ত্রণ: ডাক্তারদের নির্দেশ অনুযায়ী ওষুধের সঠিক ডোজ গ্রহণ।

প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাস: আয়োডিনযুক্ত খাবার এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস থাইরয়েডের কার্যকারিতা রক্ষা করতে সহায়ক।

স্টেরয়েড ওষুধের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ: দীর্ঘমেয়াদী স্টেরয়েড সেবনের ক্ষেত্রে ডাক্তারি পরামর্শ প্রয়োজন।


এলোপ্যাথিক ওষুধের অতিরিক্ত বা দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার প্রায়শই থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা পরিবর্তন করতে পারে, তাই থাইরয়েড ডিজঅর্ডার প্রতিরোধে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং সতর্কতা প্রয়োজন।



-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি, 
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা    
প্রভাষক, 
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ। 



আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। 
>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন