এফোরিজম #২ The Organon of Medicine

এফোরিজম #২ হ্যানিম্যানের "The Organon of Medicine" বইয়ের দ্বিতীয় উক্তি। এতে চিকিৎসা প্রণালী ও রোগ নিরাময়ের পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। এটি হল:

"The highest ideal of cure is the rapid, gentle, and permanent restoration of health; or the removal and annihilation of the disease in its whole extent, in the shortest, most reliable, and most harmless way, on easily comprehensible principles."

বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়: "চিকিৎসার সর্বোচ্চ আদর্শ হল দ্রুত, কোমল এবং স্থায়ীভাবে স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার; অথবা সহজবোধ্য নীতির উপর ভিত্তি করে রোগকে তার সম্পূর্ণ মাত্রায়, সবচেয়ে দ্রুত, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং সবচেয়ে নিরাপদ উপায়ে দূরীকরণ ও ধ্বংস করা।"

এফোরিজম #২ হোমিওপ্যাথির মূল আদর্শকে তুলে ধরে, যেখানে দ্রুত, নিরাপদ এবং রোগের স্থায়ী নিরাময়ই চিকিৎসকের প্রধান লক্ষ্য।

এফোরিজম #২ হ্যানিম্যানের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য ও আদর্শ সম্পর্কে গভীর একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। এই এফোরিজমটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা পদ্ধতির ভিতরে কিছু মৌলিক নীতিমালা রয়েছে, যা রোগ নিরাময়ের প্রক্রিয়াকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। এখানে কিছু মূল বিষয় গভীরভাবে আলোচনা করা হলো:

১. "সর্বোচ্চ আদর্শ" বা "The highest ideal":
এফোরিজম #২-এর শুরুতে হ্যানিম্যান চিকিৎসার "সর্বোচ্চ আদর্শ" বা চূড়ান্ত লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তার মতে, রোগীর সম্পূর্ণ আরোগ্যই চিকিৎসার একমাত্র এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত। এই আরোগ্য প্রক্রিয়া হবে কেবল রোগের উপসর্গ দূর করা নয়, বরং রোগের মূল কারণকে খুঁজে বের করে সেটির স্থায়ীভাবে নিরাময়। হোমিওপ্যাথিতে রোগকে দমিয়ে রাখা নয়, তাকে পুরোপুরি দূর করার লক্ষ্য থাকে।


২. "দ্রুত, কোমল এবং স্থায়ী" (Rapid, gentle, and permanent):
হ্যানিম্যানের মতে, রোগ নিরাময়ের প্রক্রিয়া দ্রুত হওয়া উচিত। তবে দ্রুততার অর্থ এমন কোনো প্রক্রিয়া নয়, যা রোগীকে অস্থির বা কষ্ট দেয়। রোগ নিরাময়ের প্রক্রিয়া হবে কোমল বা মৃদু, যাতে শরীরে কোনো অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া তৈরি না হয়। পাশাপাশি, এই নিরাময় হবে স্থায়ী; অর্থাৎ রোগটি আবার ফিরে আসবে না। এটি হোমিওপ্যাথির অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য, যা অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে এটিকে পৃথক করে।

৩. "রোগের সম্পূর্ণ পরিসরে নিরাময়" (Annihilation of the disease in its whole extent):
হ্যানিম্যান এখানে শুধুমাত্র উপসর্গের নিরাময়ের কথা বলেননি; তিনি রোগের সম্পূর্ণ ধ্বংস বা চূড়ান্ত নিরাময়ের কথা বলেছেন। 
অর্থাৎ, রোগের মূল কারণকে খুঁজে সেটিকে ধ্বংস করতে হবে। এই নীতি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার ভিত্তি, যেখানে শরীরের স্বাভাবিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করা হয়, যাতে শরীর নিজেই রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময় করতে পারে।

৪. "স্বল্পতম, নির্ভরযোগ্য এবং নিরাপদ উপায়ে" (Shortest, most reliable, and harmless way):
হ্যানিম্যানের মতে, চিকিৎসা পদ্ধতি হবে সহজবোধ্য, নির্ভরযোগ্য এবং সবচেয়ে কম ক্ষতিকর।
 এর অর্থ, চিকিৎসা এমনভাবে পরিচালিত হবে যাতে রোগী কোনো বাড়তি ক্ষতির সম্মুখীন না হন। 
প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে অনেক সময় রোগের উপসর্গ দূর করার জন্য এমন ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যা শরীরের অন্যান্য অংশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
 কিন্তু হোমিওপ্যাথির নীতিমালা অনুসারে, এই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রাহ্য নয়।

৫. "সহজবোধ্য নীতির উপর ভিত্তি করে" (On easily comprehensible principles):
হ্যানিম্যানের মতে, চিকিৎসা পদ্ধতি হবে এমন নীতির উপর ভিত্তি করে, যা সহজে বোঝা যায় এবং চিকিৎসক ও রোগী উভয়ের জন্যই বোধগম্য হয়। 
এখানে তিনি পরোক্ষভাবে চিকিৎসকদের দায়িত্বের কথা উল্লেখ করেছেন, যে চিকিৎসককে রোগ নিরাময়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করতে হবে।

৬. হ্যানিম্যানের নৈতিক ও পেশাগত দায়বদ্ধতা:
এফোরিজম #২ শুধু হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য তুলে ধরে না, এটি চিকিৎসকের নৈতিক ও পেশাগত দায়বদ্ধতার কথাও প্রকাশ করে। 
হ্যানিম্যানের মতে, একজন চিকিৎসকের নৈতিক দায়িত্ব হল রোগীর সর্বোচ্চ মঙ্গল নিশ্চিত করা এবং রোগের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান প্রদান করা।

 এটি হোমিওপ্যাথির একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য, যা রোগের সাময়িক উপশম নয়, বরং রোগের মূল নিরাময় নিশ্চিত করতে চায়।

উপসংহার:
হ্যানিম্যানের এফোরিজম #২ গভীর এবং বৈজ্ঞানিকভাবে সুস্পষ্ট একটি নীতিকে তুলে ধরে, যেখানে রোগ নিরাময়ের প্রক্রিয়াকে দ্রুত, নিরাপদ এবং দীর্ঘস্থায়ী করার কথা বলা হয়েছে। 
এই এফোরিজমটি হোমিওপ্যাথির মৌলিক দর্শন এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেয়, যা চিকিৎসকদের সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে রোগ নিরাময়ে সর্বোচ্চ আদর্শ অনুসরণ করতে।

আরো...... 

হোমিওপ্যাথির ক্ষেত্রে হ্যানিম্যানের দর্শন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও অন্যান্য দার্শনিক ও চিকিৎসা পদ্ধতিতে বিশেষজ্ঞরা রোগ নিরাময়ের ধারণা এবং চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন। 
এখানে কিছু উল্লেখযোগ্য দার্শনিক ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের মতামত আলোচনা করা হলো:

১. হিপোক্রেটিস (Hippocrates):
হিপোক্রেটিসকে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক বলা হয়।
 তার দর্শনের মূল নীতি ছিল, "প্রকৃতিই রোগ নিরাময়ের মূল মাধ্যম" (Nature is the best physician বা Vis Medicatrix Naturae)। 

তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানবদেহের নিজস্ব নিরাময়ক্ষমতা আছে, এবং চিকিৎসকের কাজ হল রোগীর এই প্রাকৃতিক নিরাময় ক্ষমতাকে সহায়তা করা।

হিপোক্রেটিস রোগ নিরাময়ে চারটি শারীরিক রস (হিউমার) বা দেহরসের ভারসাম্য বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তার মতে, দেহের এই রসগুলির ভারসাম্যহীনতার ফলেই রোগের সৃষ্টি হয় এবং এই ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠাই চিকিৎসার মূল কাজ।

২. আবু আলী ইবনে সিনা (Avicenna):
মধ্যযুগের অন্যতম বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ছিলেন আবু আলী ইবনে সিনা। তার রচিত "Canon of Medicine" গ্রন্থটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক অনন্য দলিল। 

ইবনে সিনা বিশ্বাস করতেন যে, চিকিৎসা পদ্ধতিকে রোগীর প্রকৃতি অনুযায়ী নির্ধারণ করা উচিত। তিনি বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ও চিকিৎসা প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং উল্লেখ করেছেন যে, চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত রোগীর স্বাস্থ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ঠিক যেমন হ্যানিম্যান বলেছেন।

৩. রেনে দেকার্ত (René Descartes):
দার্শনিক রেনে দেকার্ত চিকিৎসা ও দার্শনিক চিন্তাধারায় "দেহ-মনের দ্বৈতবাদ" (Dualism) তত্ত্বের প্রবক্তা। তার মতে, দেহ এবং মন পৃথক সত্তা। এই দর্শন থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় একটি ধারণা গড়ে উঠেছিল যে রোগ শুধুমাত্র শারীরিক উপাদানের কারণে ঘটে এবং এর চিকিৎসাও হতে হবে শারীরিক উপাদানগুলির ভিত্তিতে। তবে মনের অবস্থা এবং মানসিক অবস্থাও রোগের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, যা পরবর্তীতে সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করে।

৪. কার্ল জাসপার্স (Karl Jaspers):
কার্ল জাসপার্স একজন দার্শনিক এবং সাইকিয়াট্রিস্ট ছিলেন, যিনি রোগ এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গভীরভাবে কাজ করেছেন। তার মতে, চিকিৎসকের দায়িত্ব রোগীকে তার অসুস্থতার মানসিক এবং শারীরিক উভয় দিক থেকেই বুঝতে সাহায্য করা। তিনি রোগী-চিকিৎসকের সম্পর্কের ওপর জোর দিয়েছেন এবং উল্লেখ করেছেন যে, একটি রোগীকে শুধুমাত্র শারীরিক লক্ষণ দিয়ে বিচার করা উচিত নয়, বরং তার মানসিক এবং সামাজিক দিকও বিবেচনায় নিতে হবে।

৫. মাইকেল ফুকো (Michel Foucault):
ফুকো ছিলেন একজন ফরাসি দার্শনিক যিনি চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার সামাজিক এবং রাজনৈতিক দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার বিখ্যাত বই "The Birth of the Clinic" (ক্লিনিকের জন্ম) এ তিনি উল্লেখ করেছেন যে, আধুনিক চিকিৎসা কেবল শারীরিক লক্ষণের উপর নির্ভরশীল নয়, বরং এটি একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া। ফুকোর মতে, চিকিৎসা প্রথা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা মূলত একটি সামাজিক ক্ষমতা কাঠামোর মধ্য দিয়ে কাজ করে, যেখানে রোগী এবং চিকিৎসক উভয়ই একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর অধীনে পরিচালিত হয়।

৬. জর্জ এনগেল (George Engel):
জর্জ এনগেল একজন মনোবিজ্ঞানী ও চিকিৎসক ছিলেন, যিনি "জীবৈষমিক-মনের মডেল" (Biopsychosocial Model) প্রবর্তন করেছেন। তার মতে, কোনো রোগের কারণ শুধুমাত্র শারীরিক নয়, বরং এর মধ্যে মানসিক এবং সামাজিক কারণও অন্তর্ভুক্ত থাকে। এই মডেল অনুযায়ী, রোগ নিরাময় শুধুমাত্র শারীরিক চিকিৎসা নয়, মানসিক ও সামাজিক দিক থেকেও রোগীকে সহায়তা করতে হবে। এই ধারণাটি হ্যানিম্যানের হোমিওপ্যাথির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, যেখানে রোগীকে একটি সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা করা হয়।

৭. আর্থার শোপেনহাওয়ার (Arthur Schopenhauer):
জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ারের দর্শন ছিল দার্শনিক নিরাশাবাদ ও মানব জীবনের কষ্ট নিয়ে। তার মতে, জীবন কষ্টে ভরা এবং এই কষ্টের অংশ হল রোগ। শোপেনহাওয়ারের মতে, চিকিৎসা হচ্ছে সেই প্রক্রিয়া, যা কষ্ট কমানোর দিকে কাজ করে। যদিও তার দর্শন নিরাময়ের চেয়ে নিরাশাবাদী, তবে তার কষ্ট কমানোর উপর জোর দেওয়া অনেকটাই আধুনিক মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার মত।

উপসংহার:
যদিও হ্যানিম্যানের হোমিওপ্যাথি নিরাময়ের জন্য একটি অনন্য পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত, অন্যান্য দার্শনিক ও চিকিৎসকরা বিভিন্নভাবে রোগ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ শারীরিক চিকিৎসার উপর জোর দিয়েছেন, আবার কেউ কেউ মানসিক এবং সামাজিক প্রভাবকে বিবেচনায় নিয়েছেন। হোমিওপ্যাথির মতো অন্যান্য পদ্ধতিতেও রোগীকে একটি সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে দেখা হয়, যেখানে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক উপাদান একত্রিত হয়ে কাজ করে।



---কাজী সাইফ উদদীন আহমেদ,
Lecturer, Federal Homoeopathic Medical College, Dhaka.


আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। 


>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন