এফোরিজম #১ The Organon of Medicine

 হ্যানিম্যানের "The Organon of Medicine" গ্রন্থের এফোরিজম #১  এতে হোমিওপ্যাথির মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে। এটি হল: "The physician’s high and only mission is to restore the sick to health, to cure, as it is termed."

বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়: "একজন চিকিৎসকের প্রধান এবং একমাত্র লক্ষ্য হল রোগীকে সুস্থ করা, তাকে রোগমুক্ত করা।"

এই এফোরিজমটি হোমিওপ্যাথির মূলনীতি সম্পর্কে ধারণা দেয় যে, চিকিৎসকের মূল কাজ রোগীকে সুস্থ করে তোলা।


"মিশন" বলতে কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য পূরণের জন্য একটি বিশেষ দায়িত্ব বা কাজকে বোঝানো হয়। এটি এমন একটি কাজ বা উদ্দেশ্য, যা কোনো ব্যক্তি, দল বা প্রতিষ্ঠানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যার সফলতা অর্জনের জন্য তারা বিশেষভাবে প্রচেষ্টা চালায়।


হ্যানিম্যানের এফোরিজম #১-এ "মিশন" বলতে চিকিৎসকের উদ্দেশ্য বা দায়িত্বকে বোঝানো হয়েছে, যা হল রোগীকে সুস্থ করে তোলা। "Mission: Impossible" একটি জনপ্রিয় আমেরিকান মুভি সিরিজ, যেখানে টম ক্রুজ প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন।  মিশন ইম্পসিবল মুভিটি দেখলে বুঝতে পারবেন মিশন বলতে আসলে কি বুঝায়? 

Aphorism 1


আমার চোখে...... 

চিকিৎসকের উচ্চ এবং একমাত্র লক্ষ্য হল অসুস্থদের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করা এবং তাদের সম্পূর্ণ নিরাময় করে তোলা। এটি হোমিওপ্যাথি এবং অন্যান্য চিকিৎসা শাস্ত্রের মূল নীতি হিসেবে বিবেচিত হয়। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিজ্ঞানেও এই ধারণাটি গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হয়েছে, যেখানে রোগের মূল কারণকে দূর করে রোগীকে সুস্থ করে তুলতে হয়, কেবলমাত্র উপসর্গগুলো দমন করে নয়।


হোমিওপ্যাথিতে এই লক্ষ্যে একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা হযয়েছে, যার মধ্যে রোগীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা, ব্যক্তিগত ইতিহাস ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এই ধরনের ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসা রোগ নিরাময়ে কার্যকর এবং নিরাপদ।  


হোমিওপ্যাথির দার্শনিক ভিত্তি গভীর ও বহুস্তরীয়। এর প্রণেতা, ড. স্যামুয়েল হানেমান, ১৮১০ সালে তাঁর বিখ্যাত বই “Organon of Medicine” এ হোমিওপ্যাথির মূল নীতিগুলো তুলে ধরেন। এই নীতিগুলো একাধিক দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যা চিকিৎসার একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ও সমগ্রিক ধারণা উপস্থাপন করে। এখানে হোমিওপ্যাথির মূল দার্শনিক উপাদানগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হলো:


১. Similia Similibus Curentur (Similar রোগ similar ঔষধের মাধ্যমে সারানো হয়):

এই নীতি হোমিওপ্যাথির কেন্দ্রীয় ধারণা, যা বলে যে কোনো পদার্থ যদি সুস্থ মানুষের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট লক্ষণ সৃষ্টি করে, তাহলে সেই একই পদার্থ ক্ষুদ্র ডোজে সেই লক্ষণযুক্ত রোগীকে নিরাময় করতে পারে।


দার্শনিক ভিত্তি:

প্রাচীনকালের গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিসও এই মতবাদ সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু হ্যানিম্যান এটিকে আরও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, আমাদের শরীরে যে লক্ষণগুলো দেখা যায়, সেগুলো আসলে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থারই অংশ। হোমিওপ্যাথি সেই প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উদ্দীপিত করে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।


২. Vital Force (জীবনীশক্তি):

হোমিওপ্যাথির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো জীবনীশক্তি। এটি বলে যে, মানব শরীর একটি "অদৃশ্য জীবনীশক্তি" দ্বারা পরিচালিত হয়।


দার্শনিক ভিত্তি:

হ্যানিম্যানের মতে, এই জীবনীশক্তির ভারসাম্য নষ্ট হলে রোগ দেখা দেয়। তাই হোমিওপ্যাথিক ওষুধের মূল লক্ষ্য হলো এই জীবনীশক্তির ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করা। রোগকে কেবলমাত্র শারীরিক উপসর্গ হিসেবে দেখা হয় না, বরং জীবনীশক্তির অন্তর্নিহিত গঠনেও কোনো অসামঞ্জস্যকে লক্ষ্য করা হয়। এই তত্ত্ব অনেকটা পূর্ব ও আয়ুর্বেদিক দর্শনের "প্রাণশক্তি" বা চীনা চিকিৎসা পদ্ধতির "চি" এর মতো।


৩. Minimum Dose (নিম্ন মাত্রার ওষুধ প্রয়োগ):

হোমিওপ্যাথির আরেকটি নীতি হলো, ওষুধের ক্ষুদ্রতম মাত্রায় ব্যবহার করা যাতে শরীরে এর প্রভাব পড়ে, কিন্তু কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে।


দার্শনিক ভিত্তি:

হোমিওপ্যাথি বিশ্বাস করে, ঔষধের উচ্চ মাত্রা রোগীর জীবনীশক্তিকে আরও দুর্বল করে তুলতে পারে, তাই ক্ষুদ্রমাত্রার ওষুধ ব্যবহার করা হয়। হ্যানিম্যান দাবি করেছিলেন যে, ক্ষুদ্র মাত্রা (dilution) ওষুধের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং শরীরের সাথে তার সূক্ষ্ম সংযোগ স্থাপন করে, যা প্রতিক্রিয়া হিসেবে জীবনীশক্তি পুনঃস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয়।


৪. Holistic Approach (সমগ্রিক চিকিৎসা):

হোমিওপ্যাথি দার্শনিকভাবে শুধু শারীরিক লক্ষণ নয়, বরং পুরো মানুষকে বিবেচনায় নিয়ে চিকিৎসা করে। মানসিক ও আবেগগত অবস্থা, ব্যক্তির জীবনযাপন, মানসিক চাপ সবকিছু বিশ্লেষণ করে চিকিৎসা করা হয়।


দার্শনিক ভিত্তি:

হ্যানিম্যান বিশ্বাস করতেন যে, রোগীর মানসিক ও শারীরিক অবস্থা পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত, এবং যেকোনো চিকিৎসা পদ্ধতি সফল হতে হলে তা শুধুমাত্র শারীরিক উপসর্গ নয়, মানসিক অবস্থাকেও বিবেচনায় নিতে হবে। এই সমগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি রোগীকে পূর্ণ সুস্থতা প্রদান করতে সহায়ক বলে বিবেচিত হয়।


৫. Miasms (মিয়াজম তত্ত্ব):

হোমিওপ্যাথি দার্শনিকভাবে বিশ্বাস করে যে, কিছু রোগের শিকড় খুব গভীরে প্রোথিত থাকে, যা মিয়াজম নামক বিষাক্ত উপাদান দ্বারা সৃষ্ট হয়। হ্যানিম্যানের মতে, প্রধানত তিনটি মিয়াজম রয়েছে: Psora (চর্মরোগ), Syphilis (যৌনরোগ), এবং Sycosis (গণোরিয়া)। এই মিয়াজম তত্ত্ব অনুসারে, কোনও রোগ পুরোপুরি নিরাময় না হলে শরীরের ভেতরে সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায় এবং পরবর্তীতে আরও জটিল রোগ সৃষ্টি করতে পারে।


দার্শনিক ভিত্তি:

হোমিওপ্যাথির এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে যে কেন কিছু রোগ আবার ফিরে আসে এবং কেন কিছু রোগ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। এটি একটি সূক্ষ্ম দার্শনিক দৃষ্টিকোণ যা শরীরের গভীরে থাকা রোগের মূল কারণগুলি অনুসন্ধান করে। মিয়াজম তত্ত্ব দ্বারা হানেমান রোগের গভীর মূলকে চিকিৎসা করতে চেষ্টা করেছেন।


৬. Individualization (ব্যক্তিগতকরণ):

হোমিওপ্যাথির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিটি রোগীকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা। একই রোগের জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করা হতে পারে, কারণ হোমিওপ্যাথির দৃষ্টিতে প্রতিটি রোগী ভিন্ন এবং তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ভিন্ন।


দার্শনিক ভিত্তি:

এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক নীতি যা আধুনিক ওষুধের সাধারণ নিয়মের বিপরীতে দাঁড়ায়। আধুনিক ওষুধ যেখানে একটি নির্দিষ্ট রোগের জন্য একই ওষুধ সবার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে, হোমিওপ্যাথি বিশ্বাস করে যে, প্রতিটি ব্যক্তির রোগের প্রকাশ ভিন্ন, এবং তার ব্যক্তিগত অবস্থা বিবেচনা করে ওষুধ দিতে হবে।


৭. Disease as a Dynamic Disturbance (রোগ একটি গতিশীল ব্যাঘাত):

হোমিওপ্যাথি বিশ্বাস করে যে রোগ কেবল শারীরিক নয়, এটি জীবনীশক্তির একটি গতিশীল ব্যাঘাত। হ্যানিম্যান বলেছিলেন যে, রোগ কেবল শরীরের অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট নয়, বরং শরীরের অভ্যন্তরীণ জীবনীশক্তির সঠিক ভারসাম্যহীনতা রোগ সৃষ্টি করে।


দার্শনিক ভিত্তি:

এটি শরীরের প্রতি একটি গভীর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা বলে যে, শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং শক্তির ভারসাম্যহীনতাই প্রকৃত রোগ। হোমিওপ্যাথি শরীরকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য এই শক্তির ভারসাম্য পুনঃস্থাপন করে।


উপসংহার:

হোমিওপ্যাথি শুধুমাত্র শারীরিক লক্ষণগুলোর নিরাময়ে সীমাবদ্ধ নয়; এটি মানুষের জীবনীশক্তি, মানসিক অবস্থা এবং জীবনধারার উপর ভিত্তি করে একটি গভীর ও বিস্তৃত চিকিৎসা পদ্ধতি। হ্যানিম্যানের হোমিওপ্যাথি দার্শনিক ধারণাগুলো আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে, যা রোগীর সামগ্রিক অবস্থা এবং প্রাকৃতিক নিরাময়ের ক্ষমতার উপর গুরুত্ব দেয়।



--- কাজী সাইফ উদদীন আহমেদ। 

>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন