সুস্থ, চনমনে ও ফুরফুরে থাকার জন্য আখের রস

আখের রস:
আখের রস হলো আখ থেকে প্রাপ্ত মিষ্টি রস, যা আখের কাণ্ড থেকে নিষ্কাশন করা হয়। এটি সোজাসুজি পানীয় হিসেবে খাওয়া হয় এবং অনেক জনপ্রিয়, বিশেষ করে গরমের সময়।

 আখের রস স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী, কারণ এতে প্রচুর
  • -প্রাকৃতিক শর্করা, 
  • -খনিজ পদার্থ (যেমন ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম) এবং 
  • -ভিটামিন থাকে। 
এটি শরীরকে তাৎক্ষণিক,
  • শক্তি জোগায় এবং 
  • পানিশূন্যতা কমাতে সহায়ক।


আখের রসের স্বাস্থ্যগত এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তিক ব্যাখ্যা :
আখের রসের স্বাস্থ্যগত এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তিক ব্যাখ্যা বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি পুষ্টি এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়ক উপাদানসমূহ ধারণ করে। নিচে আখের রসের কয়েকটি স্বাস্থ্যগত এবং বৈজ্ঞানিক উপকারিতা তুলে ধরা হলো:

১. তাৎক্ষণিক শক্তির উৎস:
আখের রসে প্রাকৃতিক শর্করা (গ্লুকোজ, সুক্রোজ) থাকে, যা শরীরে দ্রুত শক্তি সরবরাহ করে। শারীরিক পরিশ্রমের পরে বা ক্লান্তি দূর করতে এটি কার্যকরী।

২. হজমে সহায়তা :
আখের রসে থাকা পটাসিয়াম হজমের প্রক্রিয়া উন্নত করতে সাহায্য করে এবং অ্যাসিডিটি কমায়। এটি অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়ক।

৩. ক্যান্সার প্রতিরোধী :
আখের রস অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা শরীরে ফ্রি র‌্যাডিকালগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে। বিশেষ করে, এটি স্তন এবং প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।

৪. লিভারের স্বাস্থ্য :
আখের রস লিভারের কার্যক্রম উন্নত করতে সহায়ক। এটি জন্ডিসের মতো রোগ প্রতিরোধে উপকারী, কারণ এটি লিভারের এনজাইমগুলোর কার্যক্ষমতা উন্নত করে।

৫. ইউরিনারি সমস্যা সমাধানে :
আখের রস ডায়ুরেটিক হিসেবে কাজ করে, যা মূত্রাশয়ে জমে থাকা টক্সিন বের করতে সহায়ক। এটি ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI), কিডনির পাথর এবং অন্যান্য মূত্রজনিত সমস্যায় উপকার করে।

৬. ত্বকের স্বাস্থ্য :
আখের রসে থাকা অ্যালফা-হাইড্রক্সি অ্যাসিড (AHA) ত্বকের কোষ পুনর্গঠন এবং ব্রণ, দাগ ইত্যাদি দূর করতে সহায়ক। এটি ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখতেও কার্যকর।

৭. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ :
আখের রসের উচ্চ পটাসিয়াম উপাদান শরীরে সোডিয়ামের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে, যা উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সহায়তা করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে।

 ৮. ওজন কমাতে সহায়ক :
যদিও আখের রসে শর্করা থাকে, এটি প্রাকৃতিক এবং কম ক্যালরিযুক্ত। নিয়মিত কিন্তু পরিমিত পরিমাণে আখের রস পান করলে মেটাবলিজম ভালো হয় এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

৯. কিডনি এবং মূত্রাশয় ভালো রাখতে :
আখের রসে প্রচুর পরিমাণে পানি এবং মিনারেলস রয়েছে যা শরীর থেকে টক্সিন বের করতে সাহায্য করে। এটি কিডনি সুস্থ রাখতে এবং মূত্রাশয়ে ইনফেকশন প্রতিরোধ করতে উপকারী।

১০. হাড় এবং দাঁতের গঠন মজবুত করে :
আখের রসে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং অন্যান্য খনিজ থাকে, যা হাড় এবং দাঁতের গঠন মজবুত করতে সহায়ক। আখের রস পান করলে হাড়ের ঘনত্ব বাড়ে এবং এটি দাঁতের ক্যাভিটি প্রতিরোধে কার্যকর হতে পারে।

১১. নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রজননে :
গবেষণায় প্রমাণিত, নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রজননের নানা সমস্যার সমাধানে বেশ কার্যকর হতে আখের রস।পুরুষদের বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা বাড়াতে ও মহিলাদের সন্তান প্রসবে সহায়তা করে আখের রস। এমনকি, স্তনদুগ্ধ নিঃসরণ ও বেড়ে যায় এই ফলের রসে।


বৈজ্ঞানিকভাবে, আখের রসের উপাদানসমূহ যেমন:
ফাইবার: এটি অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়ক।
ফ্ল্যাভোনয়েডস এবং ফেনোলিক যৌগ: অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করে।
পলিফেনলস: এটি প্রদাহ কমাতে সহায়ক এবং হার্টের রোগের ঝুঁকি হ্রাস করে।

সুতরাং, আখের রস কেবলমাত্র তৃষ্ণা মেটানোর জন্য নয়, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানা দিক থেকে উপকারী একটি প্রাকৃতিক পানীয়।

আয়ুর্বেদীতে আখের রস :
আয়ুর্বেদে আখের রসকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক পানীয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা শরীরকে বিভিন্নভাবে সুস্থ রাখতে সহায়ক। আখের রসের উপকারিতা আয়ুর্বেদে বহু প্রাচীন কাল থেকেই সুপরিচিত। 

আয়ুর্বেদের দৃষ্টিকোণ থেকে আখের রসের প্রধান উপকারিতাগুলি নিচে তুলে ধরা হলো:

১. তৃষ্ণা নিবারণ এবং দেহ শীতল রাখা :
আয়ুর্বেদ মতে, আখের রস "শীতল" প্রকৃতির এবং এটি দেহের অভ্যন্তরীণ তাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে আখের রস পান করলে দেহের অতিরিক্ত তাপ কমাতে সাহায্য করে এবং তৃষ্ণা মেটায়।

২. পিত্ত দোষ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক :
আয়ুর্বেদ মতে, আখের রস "পিত্ত" দোষ কমাতে সহায়ক। পিত্ত দোষ শরীরে অতিরিক্ত তাপ সৃষ্টি করে যা জ্বালাপোড়া, অ্যাসিডিটি, এবং হজম সমস্যার কারণ হতে পারে। আখের রস এই অবস্থায় শীতলকরণ প্রভাব ফেলে এবং পিত্ত নিয়ন্ত্রণ করে।

৩. রক্ত পরিষ্কার করা :
আখের রস আয়ুর্বেদে একটি প্রাকৃতিক রক্ত পরিষ্কারক হিসেবে পরিচিত। এটি রক্ত থেকে টক্সিন দূর করে এবং ত্বককে উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যকর রাখে। এটি ব্রণ ও ত্বকের অন্যান্য সমস্যা প্রতিরোধ করতে পারে।

৪. পাচনতন্ত্রের স্বাস্থ্য :
আখের রস হজম ক্ষমতা উন্নত করতে সাহায্য করে। আয়ুর্বেদ মতে, এটি "অগ্নি" (হজমের আগুন) কে শীতল করে এবং অতিরিক্ত পিত্ত থেকে সৃষ্ট অ্যাসিডিটি কমায়। এটি হজম প্রক্রিয়াকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করে।

৫. ইউরিনারি সিস্টেমের জন্য উপকারী  :
আয়ুর্বেদে আখের রসকে মূত্রাশয়ের সমস্যা, বিশেষ করে মূত্র সংক্রমণ বা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI) প্রতিরোধে সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আখের রস মূত্রবর্ধক হিসেবে কাজ করে, যা মূত্রের প্রবাহ বাড়িয়ে টক্সিন বের করতে সহায়তা করে।

৬. জন্ডিসের চিকিৎসায় :
আয়ুর্বেদ মতে, আখের রস লিভারকে শীতল করে এবং জন্ডিসের মতো লিভারজনিত সমস্যায় উপকারী। এটি লিভারের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং বিলিরুবিনের মাত্রা কমাতে সহায়তা করে, যা জন্ডিস নিরাময়ে সহায়ক।

৭. শক্তি পুনরুদ্ধার :
আখের রসকে আয়ুর্বেদে একটি "বাল্য" (শক্তি ও জীবনীশক্তি বৃদ্ধিকারক) পানীয় হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি ক্লান্তি দূর করে, দেহে প্রাকৃতিক শক্তি বৃদ্ধি করে এবং শারীরিক পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে।

৮. কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়ক :
আখের রসে প্রাকৃতিক ফাইবার রয়েছে, যা অন্ত্রের কার্যক্রম উন্নত করতে সাহায্য করে। আয়ুর্বেদ মতে, এটি অন্ত্রের মলত্যাগ প্রক্রিয়াকে সহজ করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়ক।

৯. ত্বক এবং চুলের জন্য উপকারী :
আয়ুর্বেদে আখের রসকে ত্বক এবং চুলের স্বাস্থ্য বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হয়। এটি রক্তকে পরিষ্কার করে, যা ত্বকের সমস্যা দূর করে এবং চুলের গঠন মজবুত করে।

১০. প্রদাহ এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক :
আখের রসে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং প্রদাহবিরোধী উপাদান রয়েছে, যা আয়ুর্বেদ মতে, দেহের ভেতরের প্রদাহ এবং সংক্রমণ কমাতে সহায়ক।

আয়ুর্বেদে আখের রসকে রোগ প্রতিরোধে এবং দৈনন্দিন জীবনে একটি পুষ্টিকর পানীয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে, আখের রসের অতিরিক্ত ব্যবহার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়, বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস বা অন্যান্য শর্করা সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে।

আখের রসের পুষ্টিগুণ (ফুড ভ্যালু) :
আখের রসের পুষ্টিগুণ (ফুড ভ্যালু) অনেক ধরনের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ। এটি প্রাকৃতিক শর্করা এবং খনিজে ভরপুর একটি পানীয়, যা দ্রুত শক্তি প্রদান করে এবং শরীরের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণ করে। 

নিচে আখের রসের প্রায় ১ কাপ (২৪০ মিলি) এর পুষ্টি উপাদানের তালিকা দেওয়া হলো:
পুষ্টিগুণ (১ কাপ আখের রস/২৪০ মিলি):

শক্তি (ক্যালোরি): ১৮০-১৮৩ ক্যালোরি
শর্করা (কার্বোহাইড্রেট): ৩০-৩৮ গ্রাম
এর মধ্যে প্রায় পুরোটা প্রাকৃতিক শর্করা।
ফাইবার: ০-০.৫ গ্রাম
প্রোটিন: ০.৫-১ গ্রাম
ফ্যাট: ০ গ্রাম

খনিজ উপাদান:
পটাসিয়াম: ১১১-১৩০ মিলিগ্রাম
ক্যালসিয়াম: ৩২-৪০ মিলিগ্রাম
ম্যাগনেসিয়াম: ৩৭-৪০ মিলিগ্রাম
ফসফরাস: ৫২-৬০ মিলিগ্রাম
লৌহ (আয়রন): ০.৭ মিলিগ্রাম
সোডিয়াম: ২০-৩০ মিলিগ্রাম

ভিটামিন:
ভিটামিন সি: ৩-৪ মিলিগ্রাম
ফোলেট (ভিটামিন B9): সামান্য পরিমাণে
রিবোফ্লাভিন (ভিটামিন B2): সামান্য পরিমাণে

অন্যান্য উপাদান:
অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস: আখের রস অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ, যা শরীরের ফ্রি র‍্যাডিক্যালের ক্ষতি থেকে সুরক্ষা প্রদান করে।
ফ্ল্যাভোনয়েডস এবং পলিফেনলস: এগুলো শরীরের প্রদাহ কমাতে সহায়ক এবং হৃদপিণ্ড ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর জন্য উপকারী।

সবশেষে,
আখের রসের প্রধান উপকারিতা:
  • প্রাকৃতিক শর্করা থাকায় তাৎক্ষণিক শক্তি জোগায়।
  • পটাসিয়াম সমৃদ্ধ, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
  • ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম, হাড় ও দাঁত মজবুত করে।
  • লৌহ (আয়রন) সমৃদ্ধ হওয়ায় রক্তাল্পতা প্রতিরোধে সহায়ক।
আখের রস কম ফ্যাট এবং প্রাকৃতিকভাবে মিষ্টি হওয়ায় এটি স্বাস্থ্যকর পানীয় হিসেবে বিবেচিত হয়, বিশেষ করে যাদের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য প্রাকৃতিক পানীয় প্রয়োজন।




-- কাজী সাইফ উদদীন আহমেদ,
Lecturer, Federal Homoeopathic Medical College, Dhaka.


আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। 


>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন