আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক ও মানসিক যে সকল স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দেয় এবং তার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে লেখা। আল কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী, স্বামী যদি স্ত্রীর এই ৪টি হক আদায় না করে, সেই স্বামী জাহান্নামী এবং এর কারনে প্রকৃতিতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক ও মানসিক যে সকল স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দেয় এবং তার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নিয়ে আজকের আলোচনা, যেন বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের সফলতা বয়ে আনে ঘরে ঘরে। 

ইসলাম ধর্মে স্ত্রী ও স্বামীর সম্পর্ক একটি পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কিছু বিশেষ দায়িত্ব ও অধিকার রয়েছে, এবং এগুলো আদায় না করা হলে, তা আল্লাহর নাফরমানি হিসেবে গণ্য হবে। নিচে স্ত্রীর প্রধান চারটি অধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. মেহর (Mehr) আদায় করা:
মেহর হলো স্ত্রীর প্রতি স্বামীর পক্ষ থেকে একটি বাধ্যতামূলক আর্থিক প্রতিশ্রুতি, যা বিয়ের সময় নির্ধারিত হয়। এটি স্ত্রীর জন্য তার ব্যক্তিগত সম্পদ এবং স্বামীর দায়িত্ব তা প্রদান করা।

কুরআনের নির্দেশনা: আল্লাহ বলেন, "তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের তাদের মেহর দাও আনন্দ সহকারে" (সূরা নিসা: ৪)।

মেহর হলো নারীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার যা তাকে আর্থিক নিরাপত্তা ও মর্যাদা দেয়। যদি স্বামী এটি আদায় না করে, তা শরিয়ত অনুযায়ী হারাম এবং আল্লাহর নিকট শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

২. নাফকা (Nafaqa) বা ভরণপোষণ নিশ্চিত করা:
স্বামীর প্রধান দায়িত্বের মধ্যে স্ত্রীর এবং পরিবারের ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করা রয়েছে। নাফকা বলতে খাবার, পোশাক, বাসস্থান এবং অন্যান্য দৈনন্দিন প্রয়োজনের চাহিদা পূরণকে বোঝায়।

কুরআনের নির্দেশনা: আল্লাহ বলেন, "পুরুষেরা নারীদের রক্ষণাবেক্ষক, কারণ আল্লাহ তাদেরকে (পুরুষদেরকে) অন্যদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং তারা তাদের সম্পদ ব্যয় করে" (সূরা নিসা: ৩৪)।

হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, "তোমরা উত্তম তাদের মধ্যে যারা তাদের স্ত্রীদের জন্য উত্তম" (তিরমিজি)।

ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন না করলে স্বামীকে ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী জবাবদিহি করতে হবে এবং এটি একটি গুরুতর গুনাহর মধ্যে পড়ে।

৩. স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা, সম্মান ও সঙ্গ দেওয়া:
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা, সম্মান এবং সঠিকভাবে সম্পর্ক রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কুরআন ও হাদিসে স্ত্রীদের প্রতি সদয় এবং মানবিক আচরণের ওপর অনেক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

কুরআনের নির্দেশনা: "আর তাদের (নারীদের) সঙ্গে তোমরা সদ্ব্যবহার করো" (সূরা নিসা: ১৯)।

হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, "তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো সেই ব্যক্তি, যে তার পরিবারের প্রতি ভালো আচরণ করে" (তিরমিজি)।

স্ত্রীর মানসিক ও শারীরিক সঙ্গ না দেওয়া, তাকে অবহেলা করা, কিংবা তার অধিকার নষ্ট করা সুন্নাহর বিরুদ্ধাচরণ হিসেবে দেখা হয়।
World mental health day
World mental health day


৪. স্ত্রীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দেওয়া:
স্ত্রীর সম্মান, ইজ্জত এবং শারীরিক ও মানসিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা স্বামীর অন্যতম দায়িত্ব। স্বামীকে স্ত্রীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে যাতে সে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিরাপদ থাকে।

কুরআনের নির্দেশনা: "তোমরা একে অপরের পোশাক স্বরূপ" (সূরা বাকারা: ১৮৭)। অর্থাৎ, স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের আবরণ এবং সুরক্ষার উৎস।

হাদিসে এসেছে, "তোমরা স্ত্রীর সুরক্ষা নিশ্চিত কর এবং তাদের প্রতি সদয় হও" (মুসলিম)।

কোনো স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি অবহেলা করে, তাকে শারীরিক বা মানসিকভাবে আঘাত করে, তাহলে তা ইসলামের বিধান অনুযায়ী হারাম এবং এজন্য জবাবদিহি করতে হবে।

ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী স্বামীর করণীয়:
ইসলামী শরিয়াহ্ অনুযায়ী, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সুন্দরভাবে রক্ষা করতে কুরআন ও সুন্নাহর পথ অনুসরণ করতে হবে। কোনো অধিকার যদি পূরণ না হয়, তবে তা আল্লাহর কাছে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। স্ত্রী তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে আল্লাহর আদালতে বিচার চাইতে পারে, আর এর জন্য স্বামীর ওপর কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।

Relationship between husband and wife
Relationship between husband and wife

-------পরিণতি:
যদি কোনো স্বামী এই অধিকারগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হয় এবং স্ত্রীর প্রতি অবিচার করে, তাহলে সে ইসলামের দৃষ্টিতে গুনাহগার এবং আল্লাহর শাস্তির যোগ্য হতে পারে।

------হাদিসে এসেছে:
"মুসলিমদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে উত্তম, যে তার স্ত্রীর প্রতি উত্তম" (তিরমিজি)।

কিয়ামতের দিন আল্লাহ এই বিষয়ে প্রত্যেককে জবাবদিহি করতে বাধ্য করবেন এবং যারা তাদের স্ত্রীদের অধিকার আদায় করেনি, তারা কঠোর শাস্তি পাবে।


-------উপসংহার:
 ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হলো পারস্পরিক ভালোবাসা, সম্মান এবং অধিকার ও দায়িত্বের ভিত্তিতে গঠিত। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর এই চারটি প্রধান অধিকার আদায় করতে ব্যর্থ হলে, তা ইসলামিক শরিয়াহ অনুযায়ী একটি গুরুতর অপরাধ এবং আল্লাহর শাস্তির কারণ হতে পারে।


হোমিওপ্যাথিক দৃষ্টিকোণ থেকে:
হোমিওপ্যাথিতে, পারিবারিক এবং দাম্পত্য জীবনের মানসিক এবং শারীরিক চ্যালেঞ্জগুলোকে বিবেচনা করে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। 

স্ত্রীর অধিকার পূরণ না করা বা দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দায়িত্বগুলো পালনের অভাব অনেক সময় মানসিক চাপ, হতাশা, রাগ বা হতাশা সৃষ্টি করতে পারে। হোমিওপ্যাথি এই ধরনের মানসিক ও শারীরিক অবস্থার জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ প্রদান করে, যার উদ্দেশ্য রোগীর মানসিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করা এবং সম্পর্কের সমস্যাগুলোকে প্রশমিত করা।

স্বামী যদি স্ত্রীর অধিকার আদায় না করে বা স্ত্রী যদি স্বামীর প্রতি ন্যায্য আচরণ না করে, তখন দুই পক্ষেই মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

এই ধরনের মানসিক অবস্থা থেকে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক অসুস্থতা উদ্ভব হতে পারে যেমন,
----হতাশা
----উদ্বেগ
----মাথাব্যথা
----অনিদ্রা
----বদহজম
----রাগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা

হোমিওপ্যাথিতে মানসিক ও সম্পর্কের সমস্যা:
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিশ্বাস করে যে মানসিক অবস্থা এবং আবেগের চাপ শারীরিক রোগকে প্রভাবিত করতে পারে। 

তাই দাম্পত্য জীবনে যে মানসিক চাপ এবং বিবাদ হতে পারে, তার চিকিৎসার জন্য হোমিওপ্যাথিতে কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ:

1. Natrum Muriaticum: 
যদি কোনো ব্যক্তি সম্পর্কের মধ্যে হতাশা, দুঃখ এবং মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, এবং সেই আবেগগুলোকে চেপে রাখতে চেষ্টা করে, তবে এই ওষুধটি সাহায্য করতে পারে। এটি তাদের সাহায্য করে যারা একাকীত্ব, মানসিক অবদমন বা সম্পর্কের যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যায়।

2. Ignatia Amara: 
এই ওষুধটি ব্যবহার করা হয় যাদের মানসিক আঘাত বা সম্পর্কের বিচ্ছেদজনিত দুঃখ আছে। এটি আবেগের ভারসাম্য আনতে সাহায্য করে, বিশেষ করে যখন একজন ব্যক্তি শোক, দুঃখ বা বিরহের কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।

3. Staphysagria
এই ওষুধটি সাধারণত সেসব পরিস্থিতিতে ব্যবহার করা হয় যখন কেউ নিজেদের মর্যাদাহানি অনুভব করে, সম্পর্কের মধ্যে নিপীড়ন বা অন্যায়ের শিকার হয়। এটি দাম্পত্য জীবনে উত্তেজনা, রাগ এবং নির্যাতনের প্রভাব থেকে সেরে উঠতে সাহায্য করে।

4. Sepia
যদি একজন স্ত্রী নিজেকে অবহেলিত, মানসিকভাবে ক্লান্ত এবং সম্পর্কের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতা অনুভব করে, তাহলে Sepia ওষুধটি ব্যবহার করা হয়। এটি বিশেষত মহিলাদের মানসিক ও শারীরিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে।

৫. Lachesis:
যদি কেউ সম্পর্কের মধ্যে ক্রমাগত ঈর্ষা, সন্দেহ বা তীব্র রাগ অনুভব করেন, Lachesis ব্যবহার করা হয়। এটি পারস্পরিক অবিশ্বাস বা অতিরিক্ত মানসিক উত্তেজনার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে।

৬. Nux Vomica:
যদি দাম্পত্য জীবনে মানসিক চাপের কারণে শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় যেমন বদহজম, মাথাব্যথা বা স্নায়বিক অস্থিরতা, তবে Nux Vomica কার্যকরী হতে পারে। এটি মানসিক চাপের কারণে শরীরে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তা কমাতে সাহায্য করে।

দাম্পত্য জীবনে ভারসাম্য আনার   হোমিওপ্যাথিক ভূমিকা:
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুধুমাত্র শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি মানুষের মানসিক এবং আবেগের ওপরও কাজ করে। দাম্পত্য জীবনে যদি স্বামী-স্ত্রী একে অপরের অধিকার পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তবে উভয়ের মধ্যে মানসিক চাপ ও বিরোধ দেখা দিতে পারে। 

 এতে যে মানসিক ও শারীরিক সমস্যা তৈরি হয়, তা নিরাময়ের জন্য হোমিওপ্যাথিক ওষুধ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এভাবে, হোমিওপ্যাথি সম্পর্কের সমস্যাগুলোকে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে, যেখানে শরীর এবং মন উভয়কেই সুস্থ করার জন্য  হোমিওপ্যাথি ওষুধ প্রয়োগ করা হয়।

হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা পদ্ধতির ধাপগুলো:
1. রোগীর সম্পূর্ণ ইতিহাস নেওয়া:
রোগীর পারিবারিক জীবন, দাম্পত্য সমস্যার কারণ, মানসিক অবস্থা, অতীত অভিজ্ঞতা, এবং শারীরিক উপসর্গ সবই বিশদভাবে আলোচনা করা হয়।

2. ওষুধ নির্ধারণ:
রোগীর মানসিক ও শারীরিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট ওষুধ নির্ধারণ করা হয়। এখানে একক বা একাধিক ওষুধ প্রয়োগ করা হতে পারে, যার উদ্দেশ্য হলো রোগীর মানসিক ও শারীরিক স্থিতি ফিরিয়ে আনা।

3. নিয়মিত পর্যবেক্ষণ:
হোমিওপ্যাথি দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা পদ্ধতি, যেখানে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং ওষুধের প্রয়োগের সময়সীমা মানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দাম্পত্য জীবনের সমস্যা ধীরে ধীরে সেরে উঠতে থাকে এবং মানসিক ও শারীরিক উন্নতি ঘটে।

৪. দাম্পত্য জীবনের উন্নতি এবং হোমিওপ্যাথির গুরুত্ব:
হোমিওপ্যাথি শুধু শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসায় সীমাবদ্ধ নয়, এটি সম্পর্কের মধ্যে সৃষ্ট মানসিক চাপ, দাম্পত্য জীবন নিয়ে উদ্বেগ ও দ্বন্দ্বেরও সমাধান করতে পারে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি সম্পর্কের উত্তেজনা, মানসিক ক্ষোভ বা অবিচার থেকে সৃষ্ট সমস্যা থাকে, হোমিওপ্যাথি সেইসব সমস্যার গভীরে গিয়ে মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।


-- কাজী সাইফ উদদীন আহমেদ,
Lecturer, Federal Homoeopathic Medical College, Dhaka.


আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। 
>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন