দাউদ (Ringworm or Tinea) তয় বর্ষ, বিষয়:প্রাকটিস অব মেডিসিন, সিলেবাস:বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল এডুকেশন কাউন্সিল

দাউদ (Ringworm or Tinea) এর সংজ্ঞা: 
দাউদ একটি ছত্রাকজনিত (Fungal) সংক্রমণ,যা সাধারণত ত্বকে গোলাকার দাগ বা ক্ষত সৃষ্টি করে। এটি শরীরের বিভিন্ন স্থানে হতে পারে, যেমন মাথা,হাত,পা, এবং নখে। সংক্রমণটি ত্বকের উপরিভাগে হয় এবং সাধারণত চুলকানি সৃষ্টি করে। দাউদ একটি কষ্টকর ও বিশ্রী ধরনের রোগ। 

কারণ:
দাউদ ছত্রাকের কারণে হয়। এটি সাধারণত ট্রাইকোফাইটন (Trichophyton), মাইক্রোস্পোরাম (Microsporum), এবং এপিডার্মোফাইটন (Epidermophyton) নামে তিন ধরনের ছত্রাকের কারণে ঘটে। সংক্রমণটি সাধারণত শরীরের এক ব্যক্তির থেকে অন্য ব্যক্তির সংস্পর্শে ছড়ায়, যেমন যৌথ তোয়ালে, পোশাক, বিছানার চাদর ব্যবহারের মাধ্যমে।

দাউদ
দাউদ 


লক্ষণাবলী:
1. ত্বকে গোলাকার বা অর্ধচন্দ্রাকার লালচে দাগ। 
2. চুলকানি এবং জ্বালাপোড়া অনুভব। 
3. ক্ষতের চামড়া শুষ্ক এবং খসখসে হতে পারে। 
4. ক্ষতের চারপাশে ছোট ছোট ফুসকুড়ি বা গুটি। 
5. মাথার ত্বকে হলে চুল পড়ে যেতে পারে। 
6. পায়ে হলে ফাটা এবং দগদগে হতে পারে। 

আরো বিস্তারিত লক্ষণ:
1. আংটির মতো গোল দাগ: দাউদ আক্রান্ত স্থানে গোলাকৃতির দাগ সৃষ্টি হয়, যা মাঝখানে পরিষ্কার এবং চারপাশে লাল হয়।
2. চুলকানি: অত্যন্ত চুলকানির সৃষ্টি হয় এবং রোগী সাধারণত বেশ অস্বস্তি বোধ করেন।
3. ত্বক শুষ্ক ও ফাটল ধরা: আক্রান্ত স্থানে ত্বক শুষ্ক ও খসখসে হয়ে যায়।
4. তরল বা পুঁজ নির্গমন: কিছু ক্ষেত্রে সংক্রমণ বেশি হলে আক্রান্ত স্থানে তরল বা পুঁজ নির্গত হতে পারে।
5. নখের পরিবর্তন: যদি নখে ছত্রাকজনিত সংক্রমণ হয়, তবে নখের রং পরিবর্তিত হতে পারে, নখ মোটা হয়ে যেতে পারে বা ভেঙে যেতে পারে।

ছড়িয়ে পড়া:
দাউদ সংক্রমণ অত্যন্ত ছোঁয়াচে এবং এটি একজন থেকে অন্যজনের মধ্যে সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে:
আক্রান্ত ব্যক্তির ত্বকের সংস্পর্শে আসা।
আক্রান্ত ব্যক্তির পোশাক, বিছানার চাদর, তোয়ালে ব্যবহার করা।
আক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শে আসা, যেমন— বিড়াল বা কুকুর।

জটিলতা:
1. সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হতে পারে।
2. দীর্ঘমেয়াদী সংক্রমণ ত্বকের স্থায়ী ক্ষতি বা দাগ সৃষ্টি করতে পারে।
3. শরীরের অন্যান্য স্থানে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
4. নখে সংক্রমণ হলে নখের রং পরিবর্তন হতে পারে এবং তা মোটা হতে পারে।

প্রতিরোধ:
1. আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।
2. ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং নিয়মিতভাবে গোসল করা।
3. তোয়ালে, পোশাক বা বিছানার চাদর অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি না করা।
4. ঘামের কারণে ত্বক আর্দ্র হয়ে গেলে দ্রুত শুকিয়ে ফেলা।
5. আক্রান্ত প্রাণীর চিকিৎসা করানো এবং তাদের সংস্পর্শে আসা এড়ানো।

ভাবিফল:
সঠিক চিকিৎসা না করা হলে দাউদ ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সঠিক ভাবে চিকিৎসা না হইলে দাউদ আরোগ্য করা কষ্টদায়ক এবং স্থায়ী চর্ম রোগে তা রূপান্তরিত হয়। পাশাপাশি এটি সংক্রামক হওয়ায়, পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যেও সংক্রমণ ঘটতে পারে।

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা প্রণালী:
দাউদের জন্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা রোগীর সামগ্রিক লক্ষণ ও শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা অনুযায়ী প্রদান করা হয়। নিচে কিছু সাধারণ ওষুধের নাম ও তাদের ব্যবহারের সময়:

1. Tellurium: তীব্র চুলকানি এবং গন্ধযুক্ত ত্বকের ক্ষতের জন্য ব্যবহৃত হয়।
2. Sepia: ত্বকে ক্ষত ও চুলকানি, এবং সংক্রমণ ক্রমশ বৃদ্ধি পেলে এটি কার্যকর।
3. Sulphur: তীব্র চুলকানি এবং সংক্রমণ, বিশেষত ত্বক গরম হলে এটি ব্যবহৃত হয়।
4. Graphites: শুষ্ক এবং ফাটা ত্বকের ক্ষেত্রে।
5. Silicea: দীর্ঘমেয়াদী বা পুনরাবৃত্ত সংক্রমণের জন্য।

ইনভেস্টিগেশন:
1. পটাসিয়াম হাইড্রোক্সাইড (KOH) পরীক্ষা: ছত্রাক উপস্থিতির প্রমাণের জন্য আক্রান্ত ত্বকের নমুনা নিয়ে এই পরীক্ষা করা হয়।
2. কালচার পরীক্ষা: ছত্রাকের সঠিক প্রজাতি চিহ্নিত করার জন্য কালচার করা হয়।
3. Wood’s Lamp পরীক্ষা: বিশেষ ধরনের আলোর মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট ছত্রাকের সংক্রমণ শনাক্ত করা যায়।

সাধারণ সতর্কতা:
1. সংক্রমণ প্রতিরোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা।
2. ব্যক্তিগত সরঞ্জাম, যেমন তোয়ালে, চিরুনি ইত্যাদি আলাদাভাবে ব্যবহার করা।
3. সংক্রমিত এলাকার খালি হাতে স্পর্শ না করা।

+++++

হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারদের জানা উচিত অন্যান্য প্যাথিতে কি ধরনের চিকিৎসা দিয়ে থাকে তাদের চিকিৎসায় কি প্রকার ওষুধ প্রয়োগ করে থাকে এবং সেই সকল ওষুধের কি ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে তাহা জানা উচিত।  তাহলে একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক রোগীর সকল অবস্থা অবলোকন করে রোগীর জন্য হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতিতে ওষুধ প্রয়োগ করিতে সুবিধা হয়ে থাকে। 

ডাঃ স্যামুয়েল হানিম্যান, যিনি হোমিওপ্যাথির প্রতিষ্ঠাতা, তার বিখ্যাত গ্রন্থ "Organon of Medicine"-এ মূলত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার নীতি ও ধারণাগুলি বর্ণনা করেছেন। 

এই গ্রন্থে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, রোগের চিকিৎসা কেবল বাহ্যিক লক্ষণগুলো কমানোর উদ্দেশ্যে করা উচিত নয়, বরং রোগের আভ্যন্তরীণ কারণ বা "ভাইটাল ফোর্স" বা প্রাণশক্তির উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা করতে হবে।

বাহ্যিক প্রয়োগের বিষয়ে হানিম্যানের মতামত:
হানিম্যান সাধারণত বাহ্যিক প্রয়োগ (যেমন: মলম, ক্রিম, বা পেস্ট) এর ব্যবহারকে সমর্থন করেননি, বিশেষ করে কেবলমাত্র বাহ্যিক লক্ষণ বা উপসর্গগুলি দূর করার জন্য। 

তার মতে, বাহ্যিকভাবে রোগের উপসর্গ চাপিয়ে দিলে তা আভ্যন্তরীণ রোগকে আরও গভীরে নিয়ে যেতে পারে এবং সঠিকভাবে নিরাময় হওয়ার পরিবর্তে সমস্যাটি শরীরের ভিতরে আরও বেড়ে যেতে পারে। 

হানিম্যান এটিকে "Suppressive treatment" বা উপসর্গকে দমনকারী চিকিৎসা হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা রোগের প্রকৃত কারণ নিরাময় করে না।

Organon-এর 191 অনুচ্ছেদে তিনি বলেছেন:

> “...when a skin eruption is driven away by topical ointments or lotions, the inner disorder remains uncured and may even worsen. This method suppresses the symptoms rather than healing the vital force.”


বাহ্যিক প্রয়োগের ব্যতিক্রম:
হানিম্যান কিছু ক্ষেত্রে বাহ্যিক প্রয়োগকে গ্রহণ করেছেন, তবে সেটি তখনই যখন সেই বাহ্যিক প্রয়োগ হোমিওপ্যাথিক ঔষধের অনুরূপ শক্তি ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে কাজ করে। 

অর্থাৎ, শুধুমাত্র বাহ্যিক ক্রিম বা মলম লাগানোর পরিবর্তে আভ্যন্তরীণভাবে সেই রোগের কারণ নিরাময় করা জরুরি।

সারসংক্ষেপ:
মলম বা ক্রিম বাহ্যিকভাবে ব্যবহার: হানিম্যান একে সাধারণত সমর্থন করেননি, কারণ এটি কেবল উপসর্গ কমায়, রোগকে নিরাময় করে না।

আভ্যন্তরীণ চিকিৎসা:
তিনি রোগের মূল কারণের উপর ভিত্তি করে আভ্যন্তরীণ চিকিৎসাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, যাতে ভাইটাল ফোর্স সুস্থ থাকে এবং রোগ সম্পূর্ণরূপে নিরাময় হয়।

সুতরাং, হানিম্যানের নীতিমালা অনুযায়ী, বাহ্যিক মলম বা ক্রিম প্রয়োগ করলে সেটা রোগের প্রকৃত নিরাময় না করে আংশিক বা সাময়িক উপসর্গ দূর করতে পারে, যা হোমিওপ্যাথির মূল দর্শনের পরিপন্থী।

তা হলে জেনে নেই চলুন..........

১. অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা:
দাউদের জন্য অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসায় প্রধানত ছত্রাকনাশক ওষুধ ব্যবহার করা হয়। নিম্নোক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি সাধারণত অনুসরণ করা হয়:

প্রাথমিক চিকিৎসা:
টপিকাল অ্যান্টিফাঙ্গাল ক্রিম বা জেল: ক্লোট্রিমাজল, মাইকোনাজল বা কেটোকোনাজল জাতীয় ওষুধ ব্যবহৃত হয়। এগুলো সরাসরি সংক্রমিত স্থানে প্রয়োগ করতে হয়।

অ্যান্টিফাঙ্গাল পাউডার: সংক্রমিত স্থান শুকিয়ে রাখতে সাহায্য করে, যাতে ছত্রাকের বৃদ্ধি বন্ধ হয়।

গুরুতর সংক্রমণের ক্ষেত্রে:
ওরাল অ্যান্টিফাঙ্গাল ট্যাবলেট: যদি সংক্রমণ বড় হয়ে যায়, তখন ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করতে হয়। যেমন: ফ্লুকোনাজল, ইট্রাকোনাজল, বা টেরবিনাফিন।

নোট : এলোপ্যাথিক ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া গুলো এলোপ্যাথিক ওষুধের প্যাকেটের ভিতর থাকা লিফলেট পড়ে আমরা জেনে নিব যে এলোপ্যাথিক ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কত ধরনের জটিলতর হতে পারে। 

সাধারণ পরামর্শ:
সংক্রমিত স্থান পরিষ্কার ও শুকনো রাখা।
সংক্রমিত স্থানে কোনো রকম আঁচড়ানো বা ঘষাঘষি না করা।
ব্যক্তিগত পোশাক এবং তোয়ালে আলাদা রাখা।

২. আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা:
আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় প্রাকৃতিক উপাদান এবং ভেষজ ব্যবহৃত হয় যা শরীরের ভেতর থেকে দাউদ প্রতিরোধে সহায়ক। কিছু সাধারণ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা হলো:

প্রাথমিক চিকিৎসা:
নীম পাতা: 
নীমের অ্যান্টিফাঙ্গাল এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ রয়েছে। নীম পাতা পেস্ট তৈরি করে সংক্রমিত স্থানে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

রসুন (Garlic): 
রসুনে অ্যালিসিন নামে একটি উপাদান রয়েছে যা ছত্রাক ধ্বংস করতে সহায়ক। রসুনের পেস্ট সংক্রমিত স্থানে ব্যবহার করা যায়।

হলুদ (Turmeric): 
হলুদের অ্যান্টিসেপ্টিক ও অ্যান্টিফাঙ্গাল গুণ রয়েছে। হলুদের রস বা পেস্ট সংক্রমিত স্থানে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

বিশেষ আয়ুর্বেদিক ওষুধ:
গান্ধক রসায়ন:
এটি একটি প্রাচীন আয়ুর্বেদিক ওষুধ যা ছত্রাক সংক্রমণ নিরাময়ে কার্যকর।

চন্দন তেল:
চন্দন তেলের ঠান্ডা প্রকৃতি এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা সংক্রমণ কমাতে সহায়ক।

জীবনযাত্রায় পরিবর্তন:
খাওয়ার সময় অ্যান্টিফাঙ্গাল খাবার, যেমন: নীম, রসুন, এবং হলুদযুক্ত খাবার গ্রহণ করা।
দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নিয়মিত ব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম।

একটি ছত্রাকজনিত সংক্রমণ যা ত্বক, চুল, এবং নখকে আক্রান্ত করে। এটি বিভিন্ন ধরনের ছত্রাকের কারণে ঘটে এবং এটি সাধারণত ছোঁয়াচে। এখানে ডাউদের ইতিহাস, কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা, এবং প্রতিরোধ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

দাউদ বা টিনিয়া (Ringworm or Tinea)  ইতিহাস :দাউদের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। এটি বিভিন্ন সংস্কৃতির চিকিৎসা পদ্ধতিতে উল্লেখিত হয়েছে:

প্রাচীন গ্রিস ও রোম:
প্রাচীন গ্রিসে চিকিৎসক হিপোক্রেটিস এবং গ্যালেন দাউদের বিভিন্ন লক্ষণ এবং তার চিকিৎসা সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন। তারা এটিকে ত্বকের রোগ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন।

মধ্যযুগ
মধ্যযুগে, দাউদকে মারাত্মক রোগ হিসাবে বিবেচনা করা হত। তখনকার সময়ে বিভিন্ন রকমের প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করা হত।

আধুনিক যুগ: 
১৯শ শতাব্দীর শেষে এবং ২০শ শতাব্দীর শুরুতে আধুনিক মাইক্রোবায়োলজি ও রোগবিদ্যা গবেষণার মাধ্যমে দাউদের প্রকৃতি এবং কারণ সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।




-- কাজী সাইফ উদদীন আহমেদ,
Lecturer, Federal Homoeopathic Medical College, Dhaka.


আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ। 


>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন