হোমিওপ্যাথিতে, ক্রনিক রোগের চিকিৎসার সময় যদি একুইট (তীব্র) রোগ দেখা দেয়, তখন সাধারণত নিম্নলিখিত নীতিগুলো অনুসরণ করা হয়:
1. প্রথমে একুইট রোগের চিকিৎসা:
একুইট অবস্থায় রোগীকে তীব্র উপসর্গের তাড়াতাড়ি উপশম দেওয়া জরুরি। একুইট রোগের উপসর্গ অনুযায়ী হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচন করতে হবে, যা সঠিকভাবে একুইট রোগের উপশম দিতে পারে। এই ক্ষেত্রে একুইট রোগের উপসর্গগুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়।
2. ম্যাটেরিয়া মেডিকার নির্দেশনা অনুসরণ:
একুইট অবস্থায় রোগীর উপসর্গের মিল পাওয়া যায় এমন ঔষধ নির্বাচন করা হয়। এই সময়ে ক্রনিক চিকিৎসার জন্য চলমান ঔষধ পরিবর্তন না করে ঔষধ বন্ধ রেখে বরং একুইট অবস্থার ঔষধ ব্যবহার করা হয়।
3. একুইট উপসর্গের উপশমের পরে ক্রনিক চিকিৎসা পুনরায় শুরু করা:
একবার একুইট অবস্থার উপশম হলে, পুনরায় ক্রনিক রোগের চিকিৎসা পুনরায় চালু করা হয়।
4. রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করা:
একুইট রোগের পুনরাবৃত্তি কমানোর জন্য রোগীর ইমিউন সিস্টেম উন্নত করা এবং শারীরিক অবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা জরুরি।
++++
আরো বিস্তারিত আলোচনা :
হোমিওপ্যাথিতে ক্রনিক এবং একুইট রোগের চিকিৎসার সময়ে রোগীর সামগ্রিক অবস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
যখন ক্রনিক (দীর্ঘমেয়াদী) রোগের চিকিৎসা চলাকালীন একুইট (তীব্র) সমস্যা দেখা দেয়, তখন কীভাবে পরিস্থিতি সামলাতে হবে, তা হোমিওপ্যাথিক নীতির ওপর নির্ভর করে।
১. একুইট রোগের গুরুত্ব এবং এর তাৎক্ষণিক চিকিৎসা :
একুইট রোগ হলো হঠাৎ দেখা দেওয়া এমন উপসর্গ, যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যেমন জ্বর, সর্দি, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডায়রিয়া, ইনফেকশন ইত্যাদি।
এই ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রে প্রাথমিক লক্ষ্য হলো রোগীর তাৎক্ষণিক স্বস্তি দেওয়া। একুইট উপসর্গের ভিত্তিতে ঔষধ নির্বাচন করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ:
----আকস্মিক জ্বর হলে আকোনাইট বা বেলাডোনা ব্যবহৃত হতে পারে।
----ঠান্ডা ও সর্দি-কাশি হলে আলিয়াম সিপা বা ইপিকাকুয়ানা ব্যবহার করা যায়।
-----পেটের সমস্যা হলে আর্সেনিকাম অ্যালবাম বা পালসাটিলা প্রয়োগ করা হয়।
২. ক্রনিক চিকিৎসার স্থগিত অবস্থা:
ক্রনিক রোগের চিকিৎসা চলাকালীন একুইট সমস্যা দেখা দিলে, ক্রনিক রোগের জন্য চলমান ঔষধ কখনো কখনো সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়।
কারণ, একুইট অবস্থায় দেহের প্রতিক্রিয়া পরিবর্তিত হয় এবং তখন একুইট উপসর্গ অনুযায়ী ঔষধ প্রয়োগ করতে হয়। এতে দেহের সামগ্রিক প্রতিরোধ ক্ষমতা পুনরুদ্ধার হয় এবং রোগী দ্রুত সুস্থতা অনুভব করে।
৩. একুইট রোগের চিকিৎসার পর ক্রনিক চিকিৎসা পুনরায় শুরু করা:
একবার একুইট রোগের উপশম হয়ে গেলে এবং রোগী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে, ক্রনিক চিকিৎসা আবার শুরু করা হয়। এই পর্যায়ে ক্রনিক রোগের জন্য মূল ঔষধ পুনরায় নির্ধারণ করতে হতে পারে, কারণ একুইট অবস্থার পর রোগীর শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে।
৪. রোগীর কন্সটিটিউশন (শারীরিক অবস্থা) মূল্যায়ন :
একুইট রোগের সময় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক রোগীর পুরো কন্সটিটিউশন (শারীরিক ও মানসিক অবস্থা) মূল্যায়ন করেন। যেমন, রোগীর স্বভাব, আগের চিকিৎসা, এবং রোগের পুনরাবৃত্তি সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করা হয়। একুইট অবস্থার ঔষধ প্রদানের পরে যদি দেখা যায় রোগীর ক্রনিক রোগের উপসর্গও কিছুটা হ্রাস পায়, তবে এটি নির্দেশ করে যে রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নতি করছে এবং হোমিওপ্যাথি সঠিকভাবে কাজ করছে।
৫. কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্রনিক এবং একুইট ঔষধের একসঙ্গে প্রয়োগ:
কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসক এমন একটি ঔষধ দিতে পারেন, যা একসঙ্গে ক্রনিক ও একুইট উপসর্গের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই ধরনের ঔষধকে ইন্টারকুরেন্ট রেমেডি বলা হয়। এটি রোগীর ক্রনিক এবং একুইট অবস্থার উন্নতি সাধনে কার্যকরী হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, নক্স ভোমিকা, স্যালফার, ক্যালকারিয়া কার্ব বা লাইকোপোডিয়াম একসঙ্গে ব্যবহার করা হতে পারে।
৬. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ :
একুইট অবস্থার পরে চিকিৎসক রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা তৈরি করেন। এতে হোমিওপ্যাথিক কন্সটিটিউশনাল চিকিৎসা প্রয়োগ করে রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ানো হয়। যাতে পরবর্তী সময়ে একই একুইট রোগ বা অন্যান্য সমস্যা পুনরায় দেখা না দেয়।
৭. একুইট রোগের পুনরাবৃত্তি এবং এর মানসিক প্রভাব :
হোমিওপ্যাথিতে শরীর এবং মনকে একই সাথে বিবেচনা করা হয়। অনেক সময় একুইট রোগ মানসিক চাপ বা আবেগজনিত কারণে দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসক রোগীর মানসিক অবস্থার উপরও গুরুত্ব দেন। যেমন, একুইট রোগের সময় যদি রোগী মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন বা হতাশ থাকে, তবে সেই অনুযায়ী ঔষধ যেমন ইগনেশিয়া, আর্জেন্টাম নাইট্রিকাম, বা অরাম মেটালিকাম প্রয়োগ করা হতে পারে।
৮. ফলো-আপ এবং পর্যবেক্ষণ :
একুইট রোগের চিকিৎসার পরে নিয়মিত ফলো-আপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি নিশ্চিত করতে হয় যে রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়েছে কিনা এবং ক্রনিক রোগের চিকিৎসা সঠিকভাবে অগ্রসর হচ্ছে কিনা।
সার্বিকভাবে, হোমিওপ্যাথি ক্রনিক ও একুইট রোগের ক্ষেত্রে ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক এবং আবেগজনিত অবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা করে।
+++++
অর্গানন অফ মেডিসিন এফোরিজম অনুযায়ী :
হোমিওপ্যাথির মূল গ্রন্থ "অর্গানন অফ মেডিসিন"-এ ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান ক্রনিক এবং একুইট রোগের চিকিৎসার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন।
বিশেষত § 73 থেকে § 82 পর্যন্ত এফোরিজমে তিনি
-------- ক্রনিক এবং একুইট রোগের পার্থক্য,
--------চিকিৎসার ধরণ, এবং
--------কীভাবে এই দুই ধরনের রোগকে সমন্বিতভাবে সামলাতে হবে তা ব্যাখ্যা করেছেন।
একুইট রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে হ্যানিম্যানের দৃষ্টিভঙ্গি:
§ 73-74:
হ্যানিম্যান একুইট রোগকে এমন রোগ হিসেবে বর্ণনা করেছেন,
-------যা হঠাৎ শুরু হয় এবং দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
-------একুইট রোগের চিকিৎসায় তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রয়োজন।
এই ধরনের রোগে
------- দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে,
যেন রোগীর জীবন রক্ষা করা যায় এবং দ্রুত আরোগ্য লাভ করা সম্ভব হয়।
§ 75:
একুইট রোগ প্রায়শই বাহ্যিক কারণ যেমন,
------- আবহাওয়ার পরিবর্তন,
--------শারীরিক আঘাত,
--------খাদ্য বিষক্রিয়া বা
---------সংক্রমণের কারণে হয়।
এই রোগগুলির ক্ষেত্রে হ্যানিম্যান বলেছেন, রোগীর উপসর্গের মিল অনুযায়ী ঔষধ নির্বাচন করতে হবে এবং দ্রুত প্রয়োগ করতে হবে।
ক্রনিক রোগের চিকিৎসা এবং একুইট রোগের ক্ষেত্রে করণীয়:
§ 78:
হ্যানিম্যান ক্রনিক রোগকে দীর্ঘস্থায়ী এবং গভীরমূলী রোগ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা সাধারণত মিয়াজম বা গভীর শারীরিক এবং মানসিক সমস্যার কারণে ঘটে।
ক্রনিক রোগের চিকিৎসা একটি ধীর এবং স্থায়ী প্রক্রিয়া, যেখানে রোগীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়।
§ 82:
এই এফোরিজমে হ্যানিম্যান বলেছেন, যদি ক্রনিক রোগের চিকিৎসার সময় একুইট রোগ দেখা দেয়, তবে একুইট রোগের চিকিৎসা অবশ্যই প্রথমে করতে হবে।
এ বার একুইট উপসর্গ নিরাময় হলে, ক্রনিক রোগের চিকিৎসা পুনরায় শুরু করা যেতে পারে।
এখানে তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে একুইট এবং ক্রনিক রোগের চিকিৎসা একসঙ্গে করা সম্ভব নয়।
একুইট রোগের জন্য প্রথমে সঠিক ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে, যা রোগীর তাৎক্ষণিক আরোগ্য সাধন করবে, এবং এর পর ক্রনিক রোগের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নীতিমালা অনুযায়ী করণীয়:
1. প্রথমে একুইট উপসর্গ নিরাময় করা (§ 82):
যখন ক্রনিক রোগের চিকিৎসা চলছে এবং হঠাৎ একুইট উপসর্গ দেখা দেয়, তখন প্রথমে একুইট উপসর্গের উপর ভিত্তি করে দ্রুততম সময়ে সঠিক হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে। একবার একুইট উপসর্গ কমে গেলে, পূর্বের ক্রনিক চিকিৎসা পুনরায় শুরু করা যাবে।
2. স্বতন্ত্র ঔষধ নির্বাচন (§ 153):
হ্যানিম্যান সবসময় উপসর্গ অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট ঔষধ নির্বাচন করার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। একুইট রোগের ক্ষেত্রে রোগীর সামগ্রিক উপসর্গ, অনুভূতি এবং বাহ্যিক কারণগুলো বিবেচনা করে ঔষধ নির্ধারণ করতে হবে।
3. মিয়াজম (Miasms) এবং রোগের পুনরাবৃত্তি (§ 78):
একুইট রোগের চিকিৎসা করার সময় চিকিৎসককে রোগীর পূর্বের মিয়াজমেটিক অবস্থাও বিবেচনায় রাখতে হবে। ক্রনিক রোগের মূল কারণ সাধারণত মিয়াজম বলে মনে করা হয়, তাই একুইট উপসর্গের চিকিৎসা করার পর রোগের পুনরাবৃত্তি রোধে মিয়াজমেটিক চিকিৎসা করা জরুরি।
4. অপ্রয়োজনীয় ঔষধ পরিবর্তন থেকে বিরত থাকা (§ 246):
হ্যানিম্যান এক্ষেত্রে সতর্ক করেছেন যে, রোগীর একুইট অবস্থায় প্রয়োজন ছাড়া ক্রনিক ঔষধ পরিবর্তন করা উচিত নয়। একুইট রোগের চিকিৎসা শেষ হলে, ক্রনিক চিকিৎসা পুনরায় আগের ঔষধ দিয়েই চালানো যেতে পারে, যদি না রোগীর অবস্থার পরিবর্তন ঘটে।
সারসংক্ষেপ:
হোমিওপ্যাথির "অর্গানন অফ মেডিসিন" অনুসারে, ক্রনিক রোগের চিকিৎসা চলাকালীন একুইট রোগ দেখা দিলে প্রথমে একুইট উপসর্গের দ্রুত আরোগ্য সাধন করতে হবে। এর পরে ক্রনিক চিকিৎসা পুনরায় শুরু করা উচিত। এখানে রোগীর পুরো শারীরিক, মানসিক এবং আবেগগত অবস্থা বিবেচনা করে সঠিক ঔষধ নির্বাচন করা অপরিহার্য।
+++++++
হোমিওপ্যাথিক দার্শনিক এবং সিনিয়র ডাক্তার কি বলেন এ ব্যাপারে:
হোমিওপ্যাথিক দার্শনিক এবং সিনিয়র ডাক্তারগণ, বিশেষ করে যারা হ্যানিম্যানের নীতিগুলো অনুসরণ করেন, তারা একুইট এবং ক্রনিক রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। তাঁরা মূলত হ্যানিম্যানের "অর্গানন অফ মেডিসিন"-এর শিক্ষা এবং তাদের নিজস্ব দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একাধিক দিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
নীচে কিছু উল্লেখযোগ্য দিক আলোচনা করা হলো:
১. ডা. জেমস টাইলার কেন্টের দৃষ্টিভঙ্গি:
ডা. কেন্ট, যিনি হ্যানিম্যানের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির একজন প্রধান ব্যাখ্যাকার ছিলেন, ক্রনিক এবং একুইট রোগের পার্থক্য এবং চিকিৎসা সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন।
একুইট রোগের প্রাথমিকতা:
ডা. কেন্ট বিশ্বাস করতেন, যখন কোনো রোগী ক্রনিক চিকিৎসার অধীনে থাকে এবং হঠাৎ করে একুইট উপসর্গ দেখা দেয়, তখন সেই একুইট রোগকে প্রথমে চিকিৎসা করা উচিত। একুইট রোগের চিকিৎসা না করলে রোগীর শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটতে পারে।
ঔষধ নির্বাচনের গুরুত্ব:
তিনি হ্যানিম্যানের মতোই উপসর্গ-নির্ভর ঔষধ নির্বাচনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলতেন, রোগীকে প্রথমে তার একুইট উপসর্গ অনুযায়ী সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী ঔষধ নির্বাচন করতে হবে। একুইট অবস্থার পরে রোগী সুস্থ হলে পুনরায় ক্রনিক রোগের চিকিৎসা করা যেতে পারে।
ভিত্তিমূলক চিকিৎসা (Constitutional Treatment):
কেন্টের মতে, একুইট রোগগুলি যদি প্রায়শই ঘটে থাকে, তবে সেটি রোগীর গভীরতর ক্রনিক বা মিয়াজমেটিক সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। সেক্ষেত্রে একুইট রোগের চিকিৎসার পরে রোগীর ক্রনিক অবস্থার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কন্সটিটিউশনাল চিকিৎসা করা প্রয়োজন।
২. ডা. রবার্ট হাওয়ার্থের মতামত:
ডা. হাওয়ার্থ ছিলেন একজন প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথ, যিনি হ্যানিম্যানের নীতির ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা করতেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো যে একুইট এবং ক্রনিক রোগ একে অপরের সাথে সম্পর্কিত, তবে আলাদা উপায়ে চিকিৎসা করা উচিত।
অস্থায়ী বিরতি:
ডা. হাওয়ার্থের মতে, যখন ক্রনিক রোগের চিকিৎসা চলছে এবং তীব্র একুইট অবস্থার উদ্ভব ঘটে, তখন ক্রনিক ঔষধ সাময়িকভাবে স্থগিত করা উচিত এবং একুইট উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা উচিত। এতে রোগীর তাৎক্ষণিক উপশম হয় এবং দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হয়।
পূর্বে প্রয়োগিত ঔষধ পুনরায় ব্যবহার:
তিনি বলতেন, একুইট উপসর্গ কমে গেলে, ক্রনিক চিকিৎসা আবার শুরু করা যায় এবং পূর্বে যে ঔষধ ব্যবহার করা হচ্ছিল তা পুনরায় প্রয়োগ করা যেতে পারে, যদি না রোগীর শারীরিক অবস্থার কোনও বড় পরিবর্তন ঘটে।
৩. ডা. এ. ডব্লিউ. বোরিকের মতামত:
ডা. বোরিক ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ম্যাটেরিয়া মেডিকা এবং চিকিৎসা কৌশলের ওপর একজন বিশিষ্ট ব্যাখ্যাতা। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো অত্যন্ত বাস্তবসম্মত এবং রোগীর ব্যক্তিগত উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা করার গুরুত্বকে তিনি সবসময় জোর দিতেন।
একুইট রোগের দ্রুত চিকিৎসা: ডা. বোরিকের মতে, একুইট রোগ এমন এক পরিস্থিতি যেখানে চিকিৎসা না করলে রোগীর অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। তাই একুইট উপসর্গ দেখা দিলে প্রথমে তা দ্রুত চিকিৎসা করতে হবে।
দ্বৈত চিকিৎসার বিরোধিতা:
তিনি বলতেন, একসাথে দুই ধরনের চিকিৎসা করলে রোগীর শরীর বিভ্রান্ত হতে পারে। তাই তিনি পরামর্শ দিতেন, একুইট এবং ক্রনিক রোগের চিকিৎসা আলাদা রাখা উচিত এবং একে অপরের প্রভাব না ফেলতে দেওয়া উচিত।
৪. ডা. ক্লার্কের মতামত :
ডা. জন হেনরি ক্লার্ক একজন হোমিওপ্যাথিক দার্শনিক ছিলেন এবং তিনি হ্যানিম্যানের নীতিগুলোকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।
সংবেদনশীলতা এবং প্রতিক্রিয়া:
ডা. ক্লার্ক বিশ্বাস করতেন, রোগীর সংবেদনশীলতা অনুযায়ী চিকিৎসা করা গুরুত্বপূর্ণ। ক্রনিক রোগের চিকিৎসা করার সময় যদি রোগী একুইট অবস্থার সম্মুখীন হয়, তবে তাকে প্রথমে তার তাৎক্ষণিক অবস্থার জন্য উপযুক্ত চিকিৎসা দিতে হবে এবং একবার রোগী স্থিতিশীল হলে পূর্বের চিকিৎসা পুনরায় চালিয়ে যাওয়া উচিত।
ঔষধ ব্যবস্থাপনায় সাবধানতা:
তিনি বলতেন, একসাথে একাধিক ঔষধ প্রয়োগ করা হলে তা রোগীর দেহে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে, তাই সবসময় উপসর্গ অনুযায়ী একটি ঔষধ নির্বাচন করা উচিত এবং তার কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি:
প্রবীণ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক এবং দার্শনিকরা সবাই মোটামুটি একমত যে:
1. একুইট রোগের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা প্রয়োজন, যাতে রোগী দ্রুত আরোগ্য লাভ করে।
2. ক্রনিক এবং একুইট রোগের চিকিৎসা আলাদা করা উচিত।
3. রোগীর সমগ্র শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সঠিক ঔষধ নির্বাচন করা গুরুত্বপূর্ণ।
4. একবার একুইট রোগের চিকিৎসা শেষ হলে, ক্রনিক চিকিৎসা পুনরায় শুরু করা উচিত।
এই দৃষ্টিভঙ্গিগুলো হ্যানিম্যানের মূল শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে রোগীর সার্বিক সুস্থতার দিকে লক্ষ্য রেখে একুইট এবং ক্রনিক চিকিৎসা করা হয়।
++++
হোমিওপ্যাথিতে ক্রনিক এবং একুইট রোগের চিকিৎসার গভীরতর বিশ্লেষণ :
ভূমিকা:
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতির মূল দর্শন হলো, রোগীর শরীর, মন এবং আত্মার মধ্যে সামগ্রিক সমন্বয় করে রোগ নিরাময় করা।
রোগীর বর্তমান শারীরিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া প্রদানের পাশাপাশি রোগের গভীর মূল কারণ নিরাময় করাই এই চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য।
এ কারণে হোমিওপ্যাথি একুইট ও ক্রনিক রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে পৃথক দর্শন এবং পদ্ধতি ব্যবহার করে।
স্যামুয়েল হ্যানিম্যান তাঁর "অর্গানন অফ মেডিসিন"-এ এই ধারণাগুলোর ভিত্তি স্থাপন করেছেন, যা পরবর্তী হোমিওপ্যাথিক দার্শনিক ও ডাক্তাররা আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন।
১. ক্রনিক ও একুইট রোগ: মিয়াজম এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া
ক্রনিক রোগের সংজ্ঞা ও মিয়াজমের ভূমিকা :
হোমিওপ্যাথির সবচেয়ে গভীর এবং মৌলিক ধারণাগুলোর মধ্যে একটি হলো মিয়াজম (Miasm)। হ্যানিম্যানের মতে, বেশিরভাগ ক্রনিক রোগ মিয়াজমের কারণে ঘটে। মিয়াজম তিনটি প্রধান ধরণের হতে পারে:
সোরা (Psora): এটি হলো মিয়াজমের মূল ভিত্তি এবং মানুষের দীর্ঘস্থায়ী রোগের মূল কারণ। এটি বিশেষত ত্বক এবং হজম প্রক্রিয়ার সমস্যার সঙ্গে জড়িত।
স্যাইকোসিস (Sycosis): এটি সাধারণত শরীরে অতিরিক্ত বৃদ্ধির (অ্যাবনরমাল গ্রোথ) সাথে সম্পর্কিত এবং যৌন সংক্রমণ ও অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সমস্যার কারণ।
সিফিলিস (Syphilis): এটি শরীরের ধ্বংসাত্মক রোগের সাথে সম্পর্কিত, যেমন অঙ্গপ্রতঙ্গের ক্ষতি।
ক্রনিক রোগ মিয়াজমের কারণে গভীরে প্রোথিত থাকে এবং এর চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী, যেখানে পুরো শরীরকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়োজন হয়। ক্রনিক রোগগুলোর লক্ষণ অনেক সময় সুপ্ত থাকে এবং ধীরে ধীরে শরীরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
একুইট রোগ এবং তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া :
একুইট রোগ সাধারণত হঠাৎ শুরু হয় এবং শরীরের একটি স্বল্পমেয়াদী, তীব্র প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দেয়। একুইট রোগের ক্ষেত্রে শরীর নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে এবং একটি তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, যেমন উচ্চ জ্বর, ব্যথা, অথবা প্রদাহ। এর ফলে দ্রুত উপসর্গ দেখা যায় এবং দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন।
হোমিওপ্যাথিক দর্শনে, একুইট রোগকে প্রাথমিকভাবে সামলাতে হয়, কারণ এটি জীবনহানির ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। একবার একুইট উপসর্গ নিরাময় হলে, তখন ক্রনিক মিয়াজমেটিক সমস্যার ওপর ফোকাস করা হয়।
২. একুইট ও ক্রনিক রোগের চিকিৎসার নীতি: গভীর দার্শনিক ব্যাখ্যা :
১. একুইট রোগের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা (§ 82 অনুযায়ী)
হ্যানিম্যানের মতে, ক্রনিক রোগের চিকিৎসার সময় একুইট রোগ দেখা দিলে, প্রথমে একুইট রোগের চিকিৎসা করতে হবে। এটি তাত্ক্ষণিকভাবে রোগীর শরীরের তীব্র প্রতিক্রিয়া সামলাতে সহায়তা করবে। একবার একুইট উপসর্গ কমে গেলে, তখন ক্রনিক রোগের চিকিৎসা পুনরায় শুরু করা যেতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি রোগীর জীবনীশক্তি (Vital Force) এবং প্রতিরোধ ক্ষমতার সঠিকভাবে পুনরুদ্ধারে সহায়ক হয়।
সঠিক ঔষধ নির্বাচন:
একুইট রোগের ক্ষেত্রে দ্রুত প্রতিক্রিয়া প্রদানের জন্য রোগীর শারীরিক এবং মানসিক উপসর্গ বিশ্লেষণ করে সুনির্দিষ্ট ঔষধ নির্বাচন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ফ্লু বা জ্বরের জন্য বেলাডোনা বা আকোনাইট প্রয়োগ করা যেতে পারে, কারণ এগুলো তীব্র অবস্থায় কার্যকর।
ঔষধের প্রভাব এবং পর্যবেক্ষণ:
একবার একুইট ঔষধ প্রয়োগ করা হলে, রোগীর অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে এবং প্রয়োজনে ঔষধ পরিবর্তন করতে হবে। হ্যানিম্যান সতর্ক করেছেন যে অপ্রয়োজনীয় ঔষধ পরিবর্তন করা উচিত নয়।
২. ক্রনিক রোগের মিয়াজমেটিক চিকিৎসা :
একুইট রোগের চিকিৎসা শেষে, ক্রনিক রোগের মিয়াজমেটিক চিকিৎসা শুরু করতে হবে। হ্যানিম্যানের মতে, ক্রনিক রোগ নিরাময়ের জন্য গভীরভাবে মিয়াজমেটিক চিকিৎসা করা প্রয়োজন। মিয়াজম নির্ধারণের পরে সেই অনুযায়ী ঔষধ নির্বাচন করতে হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে রোগীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটাবে।
মিয়াজমেটিক চিকিৎসায় সময়ের গুরুত্ব: মিয়াজমেটিক চিকিৎসা সাধারণত ধীরে কাজ করে এবং রোগীকে ধৈর্য ধরে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, ক্রনিক সোরার চিকিৎসার জন্য সালফার একটি কার্যকর ঔষধ, যা ধীরে ধীরে শরীরের মিয়াজমেটিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধারে সহায়ক।
৩. ডা. জেমস টাইলার কেন্টের দর্শন: ক্রনিক এবং একুইট রোগের সমন্বয়
ডা. কেন্ট হ্যানিম্যানের দার্শনিক ভিত্তি অনুসরণ করে বলেছেন, ক্রনিক রোগের মিয়াজমেটিক চিকিৎসার মাধ্যমে রোগের মূল নিরাময় করতে হবে। একুইট রোগের চিকিৎসা করার পর যদি বারবার একই ধরনের একুইট উপসর্গ দেখা দেয়, তবে সেটি রোগীর গভীর ক্রনিক সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। এই ক্ষেত্রে কন্সটিটিউশনাল বা ভিত্তিমূলক চিকিৎসা অপরিহার্য।
কন্সটিটিউশনাল চিকিৎসা: ডা. কেন্টের মতে, কন্সটিটিউশনাল চিকিৎসা রোগীর সমগ্র দেহ এবং মনকে শক্তিশালী করে এবং তাকে একসঙ্গে একাধিক রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এটি শুধুমাত্র একুইট উপসর্গ নিরাময় নয়, বরং রোগীর সামগ্রিক শক্তি পুনরুদ্ধারে সহায়ক।
৪. ইন্টারকুরেন্ট রেমেডি এবং দীর্ঘমেয়াদী ক্রনিক চিকিৎসা:
কিছু ক্ষেত্রে, ক্রনিক রোগের মধ্যে একুইট উপসর্গ দেখা দিলে ইন্টারকুরেন্ট রেমেডি ব্যবহৃত হয়। ইন্টারকুরেন্ট ঔষধ হলো এমন ঔষধ যা ক্রনিক রোগের দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার মধ্যে সাময়িকভাবে প্রয়োগ করা হয়। এটি রোগীর শরীরকে স্বল্পমেয়াদে একুইট উপসর্গ থেকে মুক্তি দেয় এবং দীর্ঘমেয়াদী ক্রনিক চিকিৎসা চালিয়ে যেতে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ, দীর্ঘমেয়াদী সোরা রোগীর ক্ষেত্রে একুইট ফ্লু দেখা দিলে নক্স ভোমিকা বা আকোনাইট ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩. হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় সমন্বয়: একটি গভীর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি
রোগীর মানসিক অবস্থা এবং প্রতিক্রিয়া: হ্যানিম্যান এবং অন্যান্য হোমিওপ্যাথরা বলেছিলেন, শুধুমাত্র শারীরিক উপসর্গ নয়, রোগীর মানসিক অবস্থা এবং প্রতিক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে ঔষধ নির্বাচন করতে হবে। রোগীর ব্যক্তিগত স্বভাব, আবেগ, এবং শারীরিক প্রতিক্রিয়া সবই ঔষধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
একই রোগীর একাধিক স্তরে চিকিৎসা:
হোমিওপ্যাথি রোগীর শরীর, মন, এবং আত্মার মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। এই কারণে, ক্রনিক এবং একুইট রোগ একে অপরের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। রোগী যখন ক্রনিক চিকিৎসা নিচ্ছে এবং একুইট অবস্থায় আক্রান্ত হয়, তখন দেহের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হয়, তাই তৎক্ষণাৎ একুইট উপসর্গকে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে।
সারসংক্ষেপ:
হোমিওপ্যাথিতে ক্রনিক এবং একুইট রোগের চিকিৎসা একটি জটিল প্রক্রিয়া, যেখানে রোগীর বর্তমান অবস্থান অনুযায়ী চিকিৎসার দিকনির্দেশনা পরিবর্তন করা হয়। হ্যানিম্যানের দর্শন এবং পরবর্তী হোমিওপ্যাথিক দার্শনিকরা একমত যে, একুইট অবস্থায় প্রথমে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা প্রয়োজন।
-- কাজী সাইফ উদদীন আহমেদ,
Lecturer, Federal Homoeopathic Medical College, Dhaka.
আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ।
>Share by:
Make a comments as guest/by name or from your facebook:
Make a comment by facebook: