বাচ্চা ডেলিভারির আগে এবং পরে করনীয় বিষয় সমূহ এবং চিকিৎসা

বাচ্চা ডেলিভারির আগে এবং পরে করনীয় বিষয় সমূহ আল কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী :

ইসলামে সন্তান জন্মদান এবং তার সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পিতা-মাতা হওয়া কেবল একটি শারীরিক দায়িত্বই নয়, বরং একটি আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় দায়িত্বও। আল্লাহ কোরআন এবং নবী মুহাম্মদ (সা.) এর সুন্নাহর মাধ্যমে আমাদেরকে সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রক্রিয়া এবং তার পরবর্তী করণীয় কাজগুলো সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাচ্চা ডেলিভারির আগে এবং পরে কিছু করণীয় বিষয় রয়েছে যা আল-কোরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে নির্ধারিত। এখানে উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় দেওয়া হলো:

।।ডেলিভারির আগে করণীয় বিষয়সমূহ:।।

1. নিয়ত ও দোয়া:
সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য সঠিক নিয়ত ও আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা করতে হবে। কোরআনে বর্ণিত দোয়াগুলি পড়া যেতে পারে, যেমন সূরা আল-ইমরানের আয়াত ৩৮:
"হে আমার পালনকর্তা, আমাকে আপনি পবিত্র সন্তান দান করুন।" (আল-ইমরান ৩:৩৮)
এটি নবী জাকারিয়া (আ.) এর দোয়া, যা তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন পুণ্যবান সন্তানের জন্য।

এছাড়াও নবী মুহাম্মদ (সা.) সন্তান প্রসবের সময় এবং গর্ভাবস্থায় আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনার পরামর্শ দিয়েছেন।

2. স্বাস্থ্যবিধি ও খাদ্যাভ্যাস:
গর্ভাবস্থার সময় পরিমিত খাবার গ্রহণ, সুস্থ থাকা, এবং শরীর ও মনের যত্ন নেওয়ার প্রতি ইসলামের জোর দেওয়া হয়েছে। ইসলাম আমাদেরকে স্বাস্থ্য রক্ষা করতে উৎসাহিত করে। গর্ভাবস্থায় মায়ের স্বাস্থ্য রক্ষা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি শিশুর সুস্থতা এবং বিকাশে সহায়তা করে।

কোরআনে স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে: "হালাল ও পবিত্র খাদ্য গ্রহণ কর।" (সূরা বাকারা ২:১৬৮)
পবিত্রতা বজায় রাখা এবং মানসিকভাবে সন্তানের আগমনের জন্য প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন।

৩. আল্লাহর উপর ভরসা ও ইবাদত বৃদ্ধি:
সন্তান জন্মের আগে মায়ের উচিত আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখা এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ইবাদত ও দোয়া বাড়ানো।
আল্লাহ বলেন, "তোমরা ধৈর্য ধারণ কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।" (সূরা আল-ইমরান ৩:২০০)

৪. দু'আ ও কোরআন তেলাওয়াত:
গর্ভাবস্থায় আল্লাহর স্মরণ এবং কোরআন তেলাওয়াত মায়ের জন্য মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রশান্তি এনে দেয়, যা সন্তানের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। নবী মুহাম্মদ (সা.) সুন্নাহ অনুযায়ী, আল্লাহর যিকির এবং দু'আ সবসময় করা উচিত।

৫. সাদকাহ প্রদান:
নবী মুহাম্মদ (সা.) দান-সদকাহ করার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন, যা বিপদ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর করুণা প্রার্থনা করে।

ডেলিভারির পরে করণীয় বিষয়সমূহ:
1. আজান ও ইকামত দেওয়া:
নবজাতককে ইসলামের সাথে প্রথম পরিচয় করানোর একটি সুন্নাহ হলো আজান ও ইকামত দেওয়া। 
নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেন, "যখন কোনো শিশু জন্ম নেয়, তখন তার ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামত দেওয়া হোক।" (আবু দাউদ)

এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিশুর জীবনে প্রথমবার আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়।

2. আকীকা:
সন্তানের জন্মের সপ্তম দিনে আকীকা দেওয়া সুন্নাহ। ছেলে সন্তানের জন্য দুইটি পশু এবং মেয়ে সন্তানের জন্য একটি পশু কোরবানি দেওয়া হয়।

 এটি একটি সুন্নাহ, যা নবী মুহাম্মদ (সা.) পালন করেছেন এবং তার অনুসারীদের জন্য তা সুপারিশ করেছেন।  হাদিসে বলা হয়েছে, "প্রত্যেক শিশুর জন্য আকীকা রয়েছে।" (সহিহ বোখারি) সাথে সন্তানের নাম রাখা হয় এবং তার মাথার চুল মুড়িয়ে সেই পরিমাণ রূপা বা এর সমমূল্য সাদকা দেওয়া হয়।

৩. নাম রাখা:
নবী মুহাম্মদ (সা.) শিশুর সুন্দর নাম রাখার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। 
তিনি বলেছেন, "তোমাদের সন্তানদের ভালো নাম দাও, কারণ কেয়ামতের দিন তাদেরকে তাদের নাম দিয়ে ডাকা হবে।" (আবু দাউদ)

পিতা-মাতার উচিত সন্তানের এমন নাম রাখা, যা তার ব্যক্তিত্বের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং যার অর্থ ভালো।

3. তাহনিক করা: 
তাহনিক একটি সুন্নাহ, যা নবী মুহাম্মদ (সা.) পালন করতেন। 
এটি হলো সদ্যজাত শিশুর মুখে খেজুর বা মিষ্টি কোনো কিছু ঘষা, যা শিশুর জন্য শুভকামনা এবং সুস্থতার জন্য করা হয়। 
এটি নবী (সা.) এর একটি প্রিয় আমল ছিল।

৪. মাথার চুল কামানো:
সন্তানের জন্মের সপ্তম দিনে তার মাথার চুল কামানো একটি সুন্নাহ। 
এরপর সেই চুলের ওজন পরিমাণে রূপা বা এর সমমূল্য সাদকা দেওয়া হয়। 
এই প্রক্রিয়াটি নবী (সা.) এর সময় থেকে পালিত হয়ে আসছে।

5. সন্তানের প্রতি দোয়া করা:
নবজাতক সন্তানের জন্য প্রতিনিয়ত দোয়া করা উচিত, যেন আল্লাহ তাকে নেককার ও সৎ বানান এবং তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করেন। 
পিতা-মাতার উচিত আল্লাহর নিকট সন্তানের ঈমান ও চরিত্রের সুরক্ষার জন্য প্রার্থনা করা।

উপসংহার:
আল-কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী সন্তান জন্মের আগে এবং পরে পালনীয় করণীয় বিষয়সমূহের মধ্যে আধ্যাত্মিক, শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতির গুরুত্ব রয়েছে। 
ইসলামে সন্তান জন্মদানকে একটি মহান দায়িত্ব হিসেবে দেখা হয়, যেখানে পিতা-মাতা সন্তানের ইসলামিক শিক্ষা ও শিষ্টাচার প্রদানের জন্য দায়বদ্ধ। 
আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (সা.) নির্দেশনা মোতাবেক এই দায়িত্ব পালন করলে পরিবারে শান্তি ও সমৃদ্ধি আসে এবং সন্তান সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে।

বাচ্চা ডেলিভারির আগে, ডেলিভারির সময় এবং পরে করণীয় বিষয়সমূহ এবং চিকিৎসা:
গর্ভাবস্থা, প্রসব, এবং প্রসব-পরবর্তী সময়ে মায়ের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়গুলোতে করণীয় বিষয়গুলো বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে সমন্বিতভাবে আলোচনা করা যেতে পারে।  এখানে এলোপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক, এবং হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আলাদা আলাদা আলোচনা করা হলো।
Delivery
Delivery

বাচ্চা ডেলিভারির আগে করণীয় (গর্ভাবস্থার সময়):

1. এলোপ্যাথি চিকিৎসা:
প্রাক-প্রসব পরীক্ষা (Antenatal Care): প্রতি মাসে নিয়মিত চেকআপের মাধ্যমে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য নিরীক্ষণ।
ভিটামিন ও আয়রন সাপ্লিমেন্ট: 
গর্ভবতী মায়েদের জন্য নিয়মিত ভিটামিন (ফলিক এসিড), আয়রন ও ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়।
ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ পরীক্ষা: 
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস বা প্রি-এক্লাম্পসিয়া থাকতে পারে, তাই রক্তের গ্লুকোজ এবং রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত।

প্রোটিন ও পুষ্টিকর খাবার: স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া নিশ্চিত করা।

2. আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা: 
আহার ও রসায়ন: গর্ভবতী মহিলাদের জন্য পুষ্টিকর খাবার যেমন দুধ, ঘি, এবং তাজা ফল খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

দেহে উষ্ণতা রক্ষা: আয়ুর্বেদ অনুসারে, শরীরের উষ্ণতা বজায় রাখতে এবং স্নেহময় তেল ব্যবহার করতে পরামর্শ দেওয়া হয়।

যোগ ব্যায়াম ও ধ্যান: মানসিক স্থিরতা বজায় রাখতে নিয়মিত যোগ এবং ধ্যান করা গর্ভবতী মায়েদের জন্য উপকারী।

3. হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা:
গর্ভাবস্থায় সমস্যা সমাধানে: নাক দিয়ে রক্ত পড়া, পায়ে ব্যথা, বমি বমি ভাব, রক্তশূন্যতা ইত্যাদি সমস্যার জন্য হোমিওপ্যাথি ওষুধের ব্যবহার করা যেতে পারে, যেমন ন্যাট্রাম মিউরিয়েটিকাম, সেপিয়া, পালসাটিলা ইত্যাদি।

মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমানো: আর্সেনিকাম অ্যালবাম বা ইগ্নাশিয়া দেওয়া হয় মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমানোর জন্য।

ডেলিভারির সময় করণীয়:
1. এলোপ্যাথি চিকিৎসা:
হাসপাতালের প্রস্তুতি: ডেলিভারি সময় জটিলতা এড়াতে হাসপাতালে বা ভালো ক্লিনিকে প্রসব করানো উচিত। ডাক্তারের নির্দেশে সিজারিয়ান সেকশন বা নরমাল ডেলিভারি করা হয়।

এনেস্থেশিয়া বা ব্যথানাশক:  সিজারিয়ান বা নরমাল ডেলিভারিতে ব্যথা কমাতে এনেস্থেশিয়া বা এপিডিউরাল ব্যবহার করা যেতে পারে।

2. আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা: 
প্রাকৃতিক তেল: 
আয়ুর্বেদে বিশেষ কিছু প্রাকৃতিক তেল যেমন বালা তেল দিয়ে মায়ের পেট ও কোমর মালিশ করলে প্রসব সহজ হয়।

ব্যথা প্রশমনে ঔষধ: 
শলাকী, অশ্বগন্ধা ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি আয়ুর্বেদিক ওষুধের ব্যবহার করা যেতে পারে।


3. হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা:
প্রসব ব্যথা প্রশমনে: 
প্রসবের সময় ব্যথা কমাতে এবং শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ভালো রাখতে কেলিকার্ব, বেলাডোনা, এবং আর্নিকা ইত্যাদি লক্ষণ সাদৃশ হোমিওপ্যাথি ওষুধ প্রয়োগ করা যেতে পারে।


বাচ্চা ডেলিভারির পরে করণীয়:
1. এলোপ্যাথি চিকিৎসা:
পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও পুষ্টি: ডেলিভারির পরে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া এবং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা উচিত।

সন্তানের যত্ন: নবজাতকের টিকা এবং স্বাস্থ্যপরীক্ষা নিয়মিত করানো উচিত।

ব্রেস্টফিডিং: মায়ের দুধ শিশুর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই স্তন্যপান নিশ্চিত করা উচিত।


2. আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা: 
বজ্রকল্প তেল মালিশ: 
মায়ের শরীরে তেল মালিশ করে পেশী ও স্নায়ুর পুনরুদ্ধার করা হয়।

উষ্ণ পানীয়: 
গর্ভাশয়ের পুনরুদ্ধারে আয়ুর্বেদে বিশেষ ধরনের উষ্ণ পানীয় খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, যেমন মেথির পানি।

3. হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা:
পরিপূর্ণ পুনরুদ্ধার: 
প্রসবের পরে শারীরিক ও মানসিক পুনরুদ্ধারের জন্য হাইপারিকামআর্নিকা, সিমিফিউগা এবং অন্যান্য ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে।

স্তন্যপান করানোর সমস্যা:
স্তন্যপান করাতে সমস্যা হলে পালসেটিলা বা ল্যাক ক্যান ওষুধ ব্যবহার করা হয়।

গভীর তুলনামূলক আলোচনা:
1. এলোপ্যাথি:
রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা দ্রুত এবং কার্যকর। তবে, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকবেএবং দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসায় ওষুধের উপর নির্ভরশীলতা তৈরি হতে পারে।

2. আয়ুর্বেদিক:
আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি এবং দেহের স্বাভাবিক ভারসাম্য বজায় রেখে কাজ করে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম, তবে কিছু ক্ষেত্রে ফল পেতে সময় লাগে।

3. হোমিওপ্যাথি:
হোমিওপ্যাথি প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে এবং এটি রোগীর ব্যক্তিগত শারীরিক, মানসিক  ইমোশোনাল লক্ষণ অনুসারে বিশেষভাবে কাজ করে। এটি নিরাপদ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম, তবে 

উপসংহার: প্রসবের আগে, সময় এবং পরে প্রতিটি চিকিৎসা পদ্ধতির নিজস্ব সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এলোপ্যাথি দ্রুত কাজ করলেও, আয়ুর্বেদিক এবং হোমিওপ্যাথির দিকে ঝোঁক থাকলে তা প্রাকৃতিক উপায়ে স্বাস্থ্য রক্ষা করে।

 সঠিক পদ্ধতির নির্বাচন মায়ের শারীরিক অবস্থা, মানসিক প্রয়োজন এবং অন্যান্য চিকিৎসার উপর নির্ভর করে।


কাজী সাইফ উদদীন আহমেদ। 


>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন