৬০ বছরেও আপনি থাকবেন, ৩০ বছরের মতো তরতাজা যদি নিয়মিত খান কলমি শাক

৬০ বছরেও থাকবেন, ৩০ বছরের মতো তরতাজা খান আপনি নিয়মিত এই শাক।  তার নাম হলো কলমি শাক। 

কলমি  শাক বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় শাক, যা স্থানীয়ভাবে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Sendho বা Centella asiatica বলে উল্লেখ করা হয়। এটি সাধারণত গ্রামের এলাকায় বেশি দেখা যায় এবং এর বিভিন্ন পুষ্টিগুণ ও ঔষধি গুণাগুণের জন্য এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এ শাকটি দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং নেপালে বেশি খাওয়া হয়।

কলমি শাক বা কমল শাক একটি পুষ্টিকর শাক। এতে বিভিন্ন ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ রয়েছে। রাসায়নিকভাবে এতে মূলত নিম্নলিখিত রাসায়নিক উপাদানগুলো পাওয়া যায়:

1. অ্যালকালয়েড: কিছু অ্যালকালয়েড কলমি শাকে পাওয়া যায়, যা শরীরের বিভিন্ন উপকার করে।
2. স্যাপোনিন: এটি একটি প্রাকৃতিক রাসায়নিক যা শরীরের বিপাক প্রক্রিয়া উন্নত করতে সাহায্য করে।
3. ফ্ল্যাভোনয়েড: এটি একটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা শরীরকে বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করে।
4. বিটা-ক্যারোটিন: ভিটামিন A-এর প্রাথমিক উৎস হিসেবে এটি কাজ করে, যা চোখের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
5. ভিটামিন C: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
6. ক্যালসিয়াম ও আয়রন: হাড় ও রক্তস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
7. পটাসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম: এগুলো শরীরের তরল ভারসাম্য রক্ষা করে এবং স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা উন্নত করে।
8. অক্সালেট: তবে কলমি শাকে কিছু পরিমাণে অক্সালেটও থাকতে পারে, যা অতিরিক্ত গ্রহণে কিছু মানুষের কিডনিতে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

এই রাসায়নিক উপাদানগুলো সমন্বয়ে কলমি শাক একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসাবে বিবেচিত।

পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা:

কলমি  শাকের পুষ্টিগুণ অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং এটি স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। চলুন একে একে গভীরভাবে আলোচনা করা যাক:

১. ভিটামিন সি এর উৎস:
কলমি  শাক প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি ধারণ করে। ভিটামিন সি শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। এটি স্কিনের স্বাস্থ্য ভাল রাখে, ত্বকের দাগ কমায় এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করে।

২. ভিটামিন এ এর উপস্থিতি:
কলমি শাকে ভিটামিন এ থাকে যা চোখের দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে সহায়ক। এটি নাইট ব্লাইন্ডনেস প্রতিরোধ করে এবং দৃষ্টিশক্তির সমস্যাগুলি কমায়।

৩. আয়রন:
এই শাকে প্রচুর আয়রন রয়েছে, যা হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সাহায্য করে। আয়রনের ঘাটতির ফলে রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে, কিন্তু কলমি শাক রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

৪. অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট:
কলমি শাকে উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদানগুলি শরীরের কোষকে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে। ফ্রি র‍্যাডিক্যাল শরীরের কোষের ক্ষতি করে এবং এটি বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন ক্যান্সার, হৃদরোগের কারণ হতে পারে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি এই ক্ষতি প্রতিরোধ করতে সহায়ক।

৫. ক্যালসিয়াম:
ক্যালসিয়াম একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ যা শরীরের হাড় ও দাঁতের গঠন এবং স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়ক। কলমি শাকে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম থাকে, যা হাড়ের ক্ষয় রোধ করতে পারে এবং হাড় মজবুত রাখতে সাহায্য করে।

৬. ফাইবার:
কলমিশাকে প্রচুর পরিমাণে ডায়েটারি ফাইবার থাকে, যা হজমের সমস্যা কমাতে সহায়ক। এটি অন্ত্রে পুষ্টির শোষণ বাড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।

৭. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি:
কলমি শাকের নিয়মিত সেবন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এর মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফাইটোকেমিক্যালগুলি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এটি বিশেষত ঠান্ডা, কাশি এবং সর্দির মতো সাধারণ রোগ প্রতিরোধে কার্যকর।

৮. হৃদরোগ প্রতিরোধ:
এই শাকের মধ্যে উপস্থিত ফাইটোকেমিক্যালস ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদানসমূহ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এটি রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সহায়তা করে, যা হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক।

৯. ত্বকের জন্য উপকারিতা:
কলমি শাকের রস ত্বকের উপর প্রয়োগ করলে এটি ত্বকের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও, ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা যেমন ব্রণ, র‍্যাশ এবং দাগ কমাতেও এটি কার্যকর। এটি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে এবং বলিরেখা কমাতে সহায়ক।

ঔষধি গুণাগুণ:
কলমি শাক দীর্ঘদিন ধরে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর কিছু বিশেষ ঔষধি গুণাগুণ নিচে আলোচনা করা হল:

1. মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নতকরণ: কলমি শাক মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করতে সহায়ক। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় কলমি শাক ব্যবহৃত হয় মানসিক চাপ ও ক্লান্তি কমানোর জন্য এবং মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে। এটি স্নায়ুতন্ত্রকে প্রশমিত করে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করে।

2. ক্ষত নিরাময়: কলমি শাকের রস প্রাচীনকাল থেকে ক্ষত নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি ত্বকের উপর প্রয়োগ করলে ক্ষত দ্রুত সারে এবং প্রদাহ কমাতে সহায়ক।

3. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: কিছু গবেষণা বলছে যে, কলমি শাক রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী হতে পারে, কারণ এটি ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়াতে পারে।

4. বাত এবং গাঁটের ব্যথায়: আয়ুর্বেদে বাত এবং গাঁটের ব্যথা কমাতে কলমি শাকের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। এর প্রদাহনাশক গুণাগুণ ব্যথা কমাতে সহায়ক।

"গ্রীন জুস": কলমি শাক (জুস কম্বিনেশন শাক) সাধারণত বিভিন্ন ধরনের সবজি ও শাক একত্রে মিশিয়ে তৈরি করা হয়। নিচে একটি সাধারণ রেসিপি দেওয়া হলো:
উপকরণ:
1. পালং শাক - ১ কাপ
2. পুই শাক - ১/২ কাপ
3. লাল শাক - ১/২ কাপ
4. ধনিয়া পাতা - ২ টেবিল চামচ
5. লেবুর রস - ১ টেবিল চামচ
6. আদা - ১ টুকরো (ছোট করে কাটা)
7. লবণ - স্বাদ অনুযায়ী
8. ঠান্ডা পানি - ১ কাপ
9. বরফ টুকরো - ইচ্ছা অনুযায়ী

প্রস্তুত প্রণালী:
1. সব শাক ভালোভাবে ধুয়ে ছোট টুকরো করে নিন।
2. একটি ব্লেন্ডারে পালং শাক, পুই শাক, লাল শাক, ধনিয়া পাতা, আদা, লেবুর রস, লবণ ও ঠান্ডা পানি দিয়ে ব্লেন্ড করুন।
3. মিশ্রণটি ছেঁকে নিন যেন কোনো মোটা অংশ না থাকে।
4. জুসটি একটি গ্লাসে ঢেলে তার সাথে বরফ টুকরো দিন।
5. ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশন করুন।

এটি স্বাস্থ্যকর এবং শরীরকে রিফ্রেশ করার জন্য উপকারী।

তৈল ছাড়া কলমি শাক রান্না করার একটি সহজ রেসিপি নিচে দেওয়া হলো:

উপকরণ:
কলমি শাক: ২ কাপ (পরিস্কার করে কেটে নেওয়া)
শুকনা মরিচ: ২টি (গুঁড়ো করা)
কাঁচা মরিচ: ২-৩টি (চিরে নেওয়া)
রসুন: ২-৩ কোয়া (কুচি করা)
পেঁয়াজ: ১টি (স্লাইস করা)
লবণ: স্বাদমতো
পানি: পরিমাণমতো

প্রস্তুত প্রণালী:
1. প্রথমে শাকগুলো ভালোভাবে ধুয়ে নিন এবং পানি ঝরিয়ে নিন।
2. একটি নন-স্টিক প্যান নিন, তারপর মাঝারি আঁচে রেখে শাকগুলো দিয়ে দিন।
3. শাক থেকে প্রাকৃতিকভাবে যে পানি বের হবে, তা দিয়ে শাকগুলো সিদ্ধ হতে শুরু করবে।
4. শাক একটু সিদ্ধ হলে পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচা মরিচ, শুকনা মরিচ, এবং লবণ দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে দিন।
5. যদি শাকটি খুব শুষ্ক মনে হয় তবে সামান্য পানি যোগ করতে পারেন, তবে অল্প পরিমাণে।
6. মাঝারি আঁচে ৫-৭ মিনিট রান্না করুন যতক্ষণ না শাক সম্পূর্ণ সিদ্ধ হয়ে যায়।
7. তেলের বদলে, যদি ঘ্রাণ আরও ভালো চান, তবে হালকা ভাপে শুকনো ভাজা মরিচ বা রসুনের গুঁড়ো উপরে ছড়িয়ে দিতে পারেন।

এইভাবে তেল ছাড়া সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর কলমি শাক রান্না করা সম্ভব।

উপসংহার:
কলমি শাক শুধু পুষ্টি উপাদানের জন্য নয়, বরং এর ঔষধি গুণাগুণের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি নিয়মিত খাদ্য তালিকায় রাখলে শরীরের বিভিন্ন পুষ্টির চাহিদা পূরণ হতে পারে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে পারে।

কাজী সাইফ উদদীন আহমেদ। 

>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন