"Snapshot " of OR " Genius of the Remedy"
"ইগ্নেসিয়া আমারা" ( Ignatia amara)
"Genius of the Remedy" দ্বারা বোঝানো হয় সেই নির্দিষ্ট ঔষধটির মৌলিক বৈশিষ্ট্য, প্রধান উপসর্গ এবং প্রধান মানসিক ও শারীরিক অবস্থা, যা সেই ঔষধকে অন্যান্য ঔষধ থেকে আলাদা করে। এটি ঔষধের মূল ভাবধারা বা সারাংশ।
ইগ্নেসিয়া আমারা - Genius of the Remedy:
ইগ্নেসিয়া আমারা মূলত এমন মানসিক অবস্থার জন্য ব্যবহৃত হয় যেখানে রোগী দুঃখ, হতাশা ও মানসিক আঘাতে আচ্ছন্ন থাকে।
এটি এমন ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য, যারা মানসিক কষ্টকে চেপে রাখে এবং প্রকাশ করে না।
বৈপরীত্যপূর্ণ লক্ষণ, যেমন: এক মুহূর্তে হাসি, পরক্ষণেই কান্না।
শারীরিক লক্ষণগুলি মানসিক আঘাতের প্রতিক্রিয়া হিসাবে প্রকাশ পায়,
যেমন:গলায় বল আটকে থাকার অনুভূতি,খিঁচুনি,হেঁচকি,মাথাব্যথা ইত্যাদি।
ইগ্নেসিয়া আমারার মূল ধারণা:
ইগ্নেসিয়া আমারা এমন একটি ঔষধ যা গভীর মানসিক আঘাত, দুঃখ, হতাশা এবং দমিয়ে রাখা আবেগের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
এটি বিশেষত, মহিলাদের জন্য উপযোগী,যারা ব্যর্থ প্রেম,প্রিয়জন হারানোর শোক বা মানসিক আঘাতে আক্রান্ত হয়।ইগ্নেসিয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো "বৈপরীত্যপূর্ণ লক্ষণ"। মানসিক ও শারীরিক লক্ষণ উভয় ক্ষেত্রেই এটি লক্ষ্য করা যায়।
১. মানসিক লক্ষণ:
দুঃখ ও শোক: প্রিয়জন হারানোর শোকে মর্মাহত। অনেক সময় তা চেপে রাখে।
অপ্রকাশিত কষ্ট: ব্যর্থ প্রেম বা অপমানজনিত কষ্টের পর রোগী চুপচাপ থাকে।
বৈপরীত্যপূর্ণ আচরণ: হাসি-কান্না একসঙ্গে আসে।
সান্ত্বনা অপছন্দ: সান্ত্বনা দিলে আরও খারাপ লাগে।
চিন্তা-ভাবনা: রোগী একা বসে থাকে, অতীতের কষ্ট ও অপমান নিয়ে চিন্তা করে।
২. শারীরিক লক্ষণ:
গলায় বল আটকে থাকার অনুভূতি: (গ্লোবাস হিস্টেরিকাস)।
খিঁচুনি ও স্প্যাজম: মানসিক আঘাতের প্রতিক্রিয়া হিসাবে খিঁচুনি দেখা দেয়।
মাথাব্যথা: মনে হয় যেন মাথায় পেরেক ঠুকেছে।
হেঁচকি ও বমি বমি ভাব: মানসিক উত্তেজনার পর হঠাৎ হেঁচকি ওঠা।
হাসতে হাসতে কাঁদা এবং কাঁদতে কাঁদতে হাসা।
খেতে ইচ্ছা করে, কিন্তু খাওয়ার পরেই বিতৃষ্ণা।
কথা বলার ইচ্ছা নেই, কিন্তু মনের মধ্যে প্রচণ্ড চিন্তা।
৪. কারণ ও উদ্দীপক:
মানসিক আঘাত, দুঃখ, ব্যর্থ প্রেম, অপরাধবোধ।
অপমান ও অবজ্ঞার অনুভূতি।
দমিয়ে রাখা আবেগ ও ক্রোধ।
৫. উপসর্গের প্রকৃতি:
উপসর্গগুলি দ্রুত পরিবর্তিত হয়।
মানসিক আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় শারীরিক উপসর্গ প্রকাশ পায়।
লক্ষণগুলি বৈপরীত্যপূর্ণ এবং পরস্পরবিরোধী।
৬. প্রয়োগের ক্ষেত্র:
হিস্টিরিয়া, মানসিক আঘাত, ব্যর্থ প্রেম ও দুঃখ।
মানসিক চাপ ও উদ্বেগজনিত খিঁচুনি।
আবেগগত কারণে ঘুমের ব্যাঘাত।
৭. মূল অনুভূতি (Core Sensation): ইগ্নেসিয়া আমারার মূল অনুভূতি হলো দমিয়ে রাখা দুঃখ, শোক এবং মানসিক আঘাত। এই অনুভূতি এমনভাবে চেপে রাখা হয় যে, তা থেকে রোগী বৈপরীত্যপূর্ণ লক্ষণ প্রকাশ করতে শুরু করে। ইগ্নেসিয়ার রোগীরা প্রিয়জন হারানোর শোক, ব্যর্থ প্রেম বা অপমানজনিত মানসিক আঘাতকে প্রকাশ না করে তা অভ্যন্তরে চেপে রাখে।
মূল অনুভূতির গভীর বিশ্লেষণ:
আত্মনিয়ন্ত্রণ: রোগী তার আবেগকে চেপে রাখে, প্রকাশ করতে চায় না।
দ্বন্দ্ব: মনের ভেতর অশান্তি থাকলেও বাইরের কাছে তা হাসি বা নির্লিপ্ততায় প্রকাশ করে।
দ্বৈততা: হাসি-কান্না একসঙ্গে দেখা যায়। এক মুহূর্তে হাসছে, পরক্ষণে কাঁদছে।
অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণার প্রকাশ: মানসিক যন্ত্রণা থেকে শারীরিক উপসর্গ সৃষ্টি হয়।
অপমানের অনুভূতি: ইগ্নেসিয়া রোগীরা সহজেই অপমানিত বোধ করে, কিন্তু তা প্রকাশ না করে অভ্যন্তরে চেপে রাখে।
উদাহরণ:
কেউ প্রিয়জন হারিয়েছে কিন্তু নিজেকে শক্ত দেখানোর চেষ্টা করছে।
কেউ ব্যর্থ প্রেমের কষ্ট পেয়েছে কিন্তু বাইরে নির্লিপ্ত বা হাসিখুশি থাকার ভান করছে।
কেউ অপমানিত হয়েছে কিন্তু তা সরাসরি প্রকাশ না করে চুপচাপ বসে থাকে।
ইগ্নেসিয়া আমারার মূল অনুভূতি তাই হলো — "দুঃখকে চেপে রাখা, কিন্তু অভ্যন্তরীণভাবে যন্ত্রণা অনুভব করা।"
প্রতীকী ব্যাখ্যা (Symbolic View):
ইগ্নেসিয়া আমারার প্রতীকী ব্যাখ্যা হলো — "একটি আবদ্ধ হৃদয়।" এটি এমন এক ব্যক্তি বা মনোবৃত্তির প্রতীক, যিনি তার আবেগকে চেপে রেখেছেন, প্রকাশ করতে পারছেন না এবং নিজের দুঃখকে লুকিয়ে রাখছেন।
ইগ্নেসিয়া আমারা'র মূল দর্শন হলো —
"আঘাতজনিত বিষণ্ণতা"।
এটি এমন রোগীদের জন্য ব্যবহৃত হয় যারা আকস্মিক শোক বা মানসিক আঘাত পেয়েছে এবং সেই শোককে চেপে রেখে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে।
মায়াজমেটিক অংশ (Miasmatic Aspect):
ইগ্নেসিয়া আমারা (Ignatia Amara) হোমিওপ্যাথিক ওষুধটি মূলত মানসিক এবং স্নায়বিক সমস্যা মোকাবিলার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি সাধারণত মানসিক দুঃখ, হতাশা, আবেগের দোলাচল এবং মানসিক আঘাতজনিত সমস্যাগুলোর জন্য কার্যকর।
মায়াজমেটিক অংশ (Miasmatic Aspect):
ইগ্নেসিয়া আমারা প্রধানত দুটি মায়াজমেটিক প্রভাব বহন করে:
1. সোরিক (Psoric):
এটি মানসিক এবং আবেগজনিত অবস্থার উপর বেশি প্রভাব ফেলে।
অবদমিত দুঃখ, বিষণ্নতা, মানসিক আঘাত ও অনুভূতির দোলাচল দেখা যায়।
রোগীটি সহজেই দুঃখ অনুভব করে, কিন্তু নিজের আবেগকে চাপা দেয়।
সোরিক লক্ষণগুলোতে রোগী চুপচাপ বসে থাকে, হঠাৎ করে কান্না আসে বা হাসতে শুরু করে।
2. সাইকোটিক (Sycoitic):
এটি অবদমিত আবেগ ও মানসিক কষ্টকে চিহ্নিত করে।
সাইকোটিক স্তরে রোগী চুপচাপ থেকে বিষণ্নতার মধ্যে ডুবে থাকে।
রোগী অতীত স্মৃতিতে আটকে থাকে এবং সেই স্মৃতির ভারে বর্তমান সময়কে উপভোগ করতে পারে না।
উদাহরণ:
একজন রোগী তার প্রিয়জনের মৃত্যুতে গভীরভাবে ব্যথিত হয়েছে। তিনি বাইরে থেকে স্বাভাবিক দেখালেও ভেতরে অসীম কষ্টে ভুগছেন। তিনি মাঝে মাঝে চুপচাপ বসে আছেন, হঠাৎ করে হাসছেন বা কান্না করছেন। এই দ্বৈত আচরণটি ইগ্নেসিয়া আমারার সোরিক প্রভাব নির্দেশ করে।
অন্যদিকে, যদি রোগী এই মানসিক কষ্টকে দীর্ঘদিন ধরে বহন করে চলে এবং তার আচরণে স্থায়ী বিষণ্নতা এবং অবসাদ দেখা যায়, তবে এটি সাইকোটিক প্রভাব নির্দেশ করে।
ইগ্নেসিয়া আমারা: সোরো-সাইকোসিসের সম্পর্ক :
ইগ্নেসিয়া আমারা মূলত একটি সোরিক এবং সাইকোটিক মায়াজমিক ওষুধ। এটি মানসিক আঘাত ও আবেগজনিত সমস্যার জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে দীর্ঘস্থায়ী অবস্থায় এটি সোরো-সাইকোসিস রূপে প্রকাশ পায়।
সোরিক পর্যায়:
প্রাথমিক অবস্থা: ইগ্নেসিয়া আমারা সোরিক স্তরে প্রথমে প্রভাব ফেলে।
লক্ষণ:
মানসিক আঘাত বা শোক পাওয়ার পরেও রোগী নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করে।
একা বসে থাকলে হঠাৎ করে কান্না চলে আসে।
রোগী বাইরে থেকে স্বাভাবিক, কিন্তু ভেতরে প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে।
দুঃখকে দমন করার প্রবণতা।
সোরিক স্তরে রোগী সাধারণত অতীত স্মৃতি নিয়ে বেশি বিচলিত থাকে।
উদাহরণ:
কেউ যদি তার প্রিয়জন হারায়, তখন সে প্রথমে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করবে। কিন্তু একা হলে কান্না আসবে। হঠাৎ করে হাসবে আবার হঠাৎ করে মন খারাপ করবে।
সাইকোটিক পর্যায়:
দ্বিতীয় পর্যায়: দীর্ঘমেয়াদী সোরিক অবস্থার চাপ বাড়তে বাড়তে এটি সাইকোটিক পর্যায়ে পৌঁছায়।
লক্ষণ:
অবদমিত শোক বা দুঃখ দীর্ঘদিন ধরে জমতে থাকে।
অতীতের স্মৃতি থেকে মুক্তি পেতে না পারা।
দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্নতা।
মাথায় একটিই চিন্তা বারবার ঘুরতে থাকে।
রোগী নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে।
মনে হয় সবাই তাকে উপহাস করছে বা অপমান করছে।
উদাহরণ:
যদি একজন ব্যক্তি তার প্রিয়জন হারানোর শোক দীর্ঘদিন ধরে ভেতরে চেপে রাখে, তবে তার মধ্যে সাইকোটিক লক্ষণ দেখা যাবে। সে নিজেকে দোষারোপ করবে, নিজেকে তুচ্ছ ভাববে এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে।
সোরো-সাইকোসিস:
এটি তখনই ঘটে যখন সোরিক ও সাইকোটিক লক্ষণ একসাথে বিদ্যমান থাকে।
লক্ষণ:
রোগী শোক দমন করে রেখেছে, কিন্তু একইসাথে সে নিজেকে তুচ্ছ ও দোষী ভাবতে শুরু করেছে।
সে একইসাথে কান্না ও হাসির মধ্যে ভুগছে।
দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্নতা এবং অতীতের স্মৃতি বারবার মনের মধ্যে ফিরে আসছে।
মানসিক অবসাদ থেকে শারীরিক উপসর্গও দেখা দিতে পারে, যেমন মাথাব্যথা, বুক ধড়ফড়, পেটের পীড়া ইত্যাদি।
চিকিৎসায় দৃষ্টিভঙ্গি:
প্রাথমিক সোরিক পর্যায়ে নিম্নশক্তির (৩০, ২০০) ইগ্নেসিয়া আমারা ব্যবহার করা হয়।
দীর্ঘস্থায়ী সাইকোটিক পর্যায়ে উচ্চশক্তির (০/২, ০/৩......০/৫ ) ইগ্নেসিয়া আমারা প্রয়োগ করতে হয়।
সোরো-সাইকোসিসে শক্তি নির্বাচন রোগীর মানসিক ও শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে।
উপসংহার:
ইগ্নেসিয়া আমারা এমন একটি ঔষধ যা গভীর মানসিক আঘাত ও শোকগ্রস্ত রোগীদের জন্য কার্যকর। এটি মূলত সেইসব রোগীর জন্য প্রযোজ্য যারা নিজেদের দুঃখ চেপে রাখে, বাইরের কাছে প্রকাশ করে না এবং বৈপরীত্যপূর্ণ লক্ষণ প্রদর্শন করে।
-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি,
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা
প্রভাষক,
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ।
আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ।
>Share by:
Make a comments as guest/by name or from your facebook:
Make a comment by facebook: