ঘুম আর দুশ্চিন্তা
এক কোটিপতি ভদ্রলোক, দামি গাড়ির আরামদায়ক আসনে বসে শহরের ব্যস্ত রাস্তা ধরে যাচ্ছিলেন। এপ্রিলে আগুন ঝরানো রোদ, গাড়ির হর্ণ, ধুলা-বালি—সব মিলিয়ে রাস্তাটা যেন একটা ফুটন্ত কড়াই। হঠাৎ চোখে পড়লো—ফুটপাতের এক কোণে, ইটের ওপর মাথা রেখে এক লোক গভীর ঘুমে বিভোর। আশ্চর্য! এই গরমে, এই কোলাহলে কীভাবে এমন নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে কেউ?
ভদ্রলোক কৌতূহলী হয়ে গাড়ি থামালেন। নামলেন। লোকটার কাছে গিয়ে বললেন—
—এই যে, শুনছেন?
ঘুম ভেঙে লোকটি চমকে উঠে বললো—
— অ্যাঁ? কি হলো স্যার?
— কিছু না। জিজ্ঞেস করছি, আপনি এখানে ঘুমোচ্ছেন কেন? ঘর নেই আপনার?
লোকটি হালকা হাসি দিয়ে উত্তর দিল—
— ঘর আছে স্যার, গ্রামে। পেন বিক্রি করি তো, তাই শহরে আসতে হয়। খুব ভোরে আসি, বিকেলে ফিরে যাই। ঘুম পেয়েছিলো, তাই একটু চোখ লেগে গেছে।
ভদ্রলোক আরও আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন—
— তা আজ কত টাকার বিক্রি হলো?
— দেড়শো টাকার মতো। সংসার চালাতে পারি কোনোমতে। বিকেলে কানাইদার গ্যারাজে সাইকেল সারাই করি, সেখান থেকেও কিছু পাই। তবে মেয়েটার শরীর ভালো যাচ্ছে না, কয়েকদিন ধরে জ্বরে ভুগছে।
ভদ্রলোক পকেট থেকে পাঁচশো টাকা বের করে বললেন—
— এটা নিন। মেয়ের জন্য ফল কিনে নিয়েন।
লোকটা কিছুটা অবাক হয়ে বলল—
— না স্যার, এমনি এমনি নেবো না। আমার কাছে কিছু টাকা আছে। আপনি বরং আমার থেকে একটা পেন কিনে নিন। মাত্র বিশ টাকা। দেখবেন কালিতে দারুণ গন্ধ।
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন—
— তুমি সৎ মানুষ, এটাই তোমার আসল পুঁজি। আমি তোমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চাই, তবে এমনি নয়। আমার কাপড়ের হোলসেল দোকান আছে, সেখান থেকে কাপড় কিনে বিক্রি করো। যদি দেখি তুমি মন দিয়ে কাজ করছো, তিন মাস পর আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবো—তাতে তুমি নিজের একটা দোকান নিতে পারো।
লোকটি অবাক হয়ে বললো—
— কিন্তু স্যার, আপনি তো আমাকে চিনেন না। তবুও বিশ্বাস করছেন?
ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন—
— আমি এই শহরের বড় ব্যবসায়ীদের একজন। এই সামান্য টাকায় যদি কারও জীবনের মোড় ঘুরে যায়, তবু সেটা বড় প্রাপ্তি আমার জন্য।
সময় গড়ালো। কয়েক বছর কেটে গেছে।
সেই পেনওয়ালার এখন শহরে তিনটি কাপড়ের দোকান, কয়েকটা গাড়ি, কয়েকটি ফ্ল্যাট। চেহারা বদলে গেছে, জীবনও।
একদিন উপকারী ভদ্রলোক গিয়েছেন ডাক্তারের চেম্বারে। দেখেন, অপেক্ষার তালিকায় বসে আছে সেই পরিচিত মুখ—সেই পেনওয়ালা। ডাকলেন—
—এই যে ভাই, তুমি এখানে?
পেনওয়ালা উঠে দাঁড়িয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো।
— স্যার, মাসিক চেক আপে এসেছি। সুগার, প্রেসার—সবই জেঁকে বসেছে। আর ঘুম? ঘুম একদম আসে না।
ভদ্রলোক মুচকি হেসে বললেন—
— সেদিন তো দেড়শো টাকা আয়েও দিব্যি ঘুমোচ্ছিলে ফুটপাতে। আর আজ এসি ঘরেও ঘুম আসে না?
পেনওয়ালা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো—
— তখন হারানোর ভয় ছিলো দেড়শো টাকা। এখন ভয় কোটি টাকার। তখন নিজের বলতে ছিলো শুধু বউ আর মেয়ে। এখন আত্মীয়-বন্ধুর ভিড়। সবাইকে সামলাতে হয়, টেক্কা দিয়ে চলতে হয়। আগে ডালভাত চলতো, এখন বাসমতি না হলে চলে না। বউ তখন সুতির শাড়িতে খুশি হতো, এখন হীরের গয়নাতেও মুখ ভার। মেয়েটা সুস্থ, কিন্তু চাহিদা বেড়েছে—না পেলে মানসিক চাপ। এসব চিন্তায় রাতে ঘুম আসবে কিভাবে?
ভদ্রলোক স্নিগ্ধ চোখে বললেন—
— এই সমস্যা আমারও হয়েছিল। একদিন আমার গুরুদেব বললেন, "তুই যদি নিজের শান্তি চাইস, তবে এমন কাউকে খুঁজে বের কর, যে গরিব, সৎ, নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে পারে। তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য কর, দেখবি তোর নিজের দুশ্চিন্তা কমে যাবে, ঘুম ফিরবে।"
পেনওয়ালা অবাক হয়ে বললো—
— সেই কারণেই আপনি সেদিন আমাকে...
ভদ্রলোক মুচকি হেসে শুধু মাথা নাড়লেন।
পেনওয়ালা গাড়িতে উঠে পড়লো। তার চোখ এবার ফুটপাতের দিকেই খুঁজে ফিরছে—হয়তো আরেকটা ঘুমন্ত, সৎ মানুষকে খুঁজছে… যার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারলে হয়তো তারও আবার ঘুম ফিরে আসবে।
জীবনে সব সময় টাকা নয়,
শান্তিটাই বড় সম্পদ।
এই গল্পটি আমাদের জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষার কথা মনে করিয়ে দেয়। নিচে কয়েকটি মূল শিক্ষা তুলে ধরা হলো:
১. সত্যিকারের শান্তি টাকা দিয়ে কেনা যায় না
শুরুতে যে মানুষটা দেড়শো টাকা আয়েও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারতো, শেষে কোটি টাকার মালিক হয়েও ঘুম হারিয়ে ফেলে। এতে বোঝা যায়—
* টাকা বাড়লেও, যদি মনের শান্তি না থাকে, জীবনের মানে হারিয়ে যায়।
২. সৎ আর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষই প্রকৃত ধনী
পেনওয়ালা লোকটি সোজা বলে, "আপনি এমনি এমনি টাকা দেবেন কেন? পেন কিনুন, সেটাই যথাযথ।"
* এ থেকেই শেখা যায়, দারিদ্র্য থাকা সত্ত্বেও আত্মসম্মান বজায় রাখা যায়।
৩. সঠিক সময়ে দেওয়া সহানুভূতিশীল সাহায্য একটি জীবন বদলে দিতে পারে
ব্যবসায়ী ভদ্রলোক দয়া করে শুধু টাকা দেননি—দিয়েছিলেন একটি সুযোগ, বিশ্বাস।
* অর্থ নয়, সুযোগ এবং বিশ্বাসই মানুষকে বড় করে তোলে।
৪. যত সম্পদ বাড়ে, তত দায়-দুশ্চিন্তাও বাড়ে
অল্পতে সন্তুষ্ট থাকা সহজ, কিন্তু যেই চাহিদা বাড়ে, শান্তি কমে।
* জীবনে প্রাচুর্য চাই, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ থাকা চাই তৃপ্তির ওপর।
৫. প্রকৃত সুখ আসে অন্যকে সাহায্য করে, উপকার করে
যেখানে ব্যবসায়ী নিজেও ঘুমহীন ছিলেন, সেখানে এক গরিবকে সাহায্য করে তিনি নিজের শান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন।
* নিঃস্বার্থভাবে কাউকে সাহায্য করা আত্মিক শান্তির শ্রেষ্ঠ উপায়।
শেষ কথা:
“জীবনে কতটা অর্জন করলাম সেটা বড় কথা নয়, বরং কার জীবনকে স্পর্শ করলাম সেটাই আসল।”
-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি,
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা
প্রভাষক,
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ।
আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ।
>Share by:
Make a comments as guest/by name or from your facebook:
Make a comment by facebook: