অকাল শিশু (Premature baby) বেঁচে থাকতে পারে, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় - ২য় পর্ব

অকাল শিশু (Premature baby) সাধারণত পূর্ণ মেয়াদের আগে, অর্থাৎ ৩৭ সপ্তাহের আগে জন্মগ্রহণ করে। তাদের শরীর এবং বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুরোপুরি বিকশিত হয় না, যা তাদের জীবনের প্রথম দিকে নানা জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। যেমন: শ্বাসকষ্ট, কম ওজন, সংক্রমণের ঝুঁকি, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা, এবং অন্যান্য শারীরিক বা মানসিক জটিলতা।


হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার ভূমিকা:

হোমিওপ্যাথি একটি ব্যক্তিগতকৃত চিকিৎসা পদ্ধতি যেখানে রোগীর শারীরিক, মানসিক এবং সংবেদনশীল অবস্থা বিবেচনা করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। অকাল শিশুর ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার লক্ষ্য হলো:

1. শিশুর প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা: অকাল শিশুরা সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ যেমন Silicea, Calcarea Phosphorica, বা Tuberculinum শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত করতে সহায়তা করে।


2. ওজন বৃদ্ধি ও শারীরিক বিকাশ: Natrum Muriaticum বা Calcarea Carbonica ব্যবহার করা যেতে পারে শিশুর ওজন বৃদ্ধিতে সহায়তার জন্য।


3. নরমাল শ্বাসপ্রশ্বাস নিশ্চিত করা: শ্বাসকষ্ট বা নিউমোনিয়ার মতো সমস্যা থাকলে Antimonium Tartaricum বা Ipecac ব্যবহার করা যেতে পারে।


4. হজম ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ: অকাল শিশুদের হজমজনিত সমস্যা থাকলে Chamomilla বা Nux Vomica কার্যকর। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে Arsenicum Album বা Belladonna প্রযোজ্য হতে পারে।



চিকিৎসায় বিশেষ দিকনির্দেশনা:

1. শিশুর চিকিৎসা একটি বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে হতে হবে। অকাল শিশুরা অত্যন্ত স্পর্শকাতর হওয়ায় তাদের শারীরিক অবস্থা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।


2. অতিসতর্কতা অবলম্বন করুন: হোমিওপ্যাথিক ওষুধ শিশুদের ক্ষুদ্র ডোজে দেওয়া হয়। ভুল ওষুধ বা ডোজ বিপজ্জনক হতে পারে।


3. পরিবেশগত যত্ন:

শিশুর জন্য পরিষ্কার এবং সংক্রমণ-মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করুন।

প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা বজায় রাখুন, কারণ অকাল শিশুদের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয়।



4. স্তন্যপান করান (যদি সম্ভব হয়): মাতৃস্তন অকাল শিশুর পুষ্টি ও প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে অপরিহার্য।



গুরুত্বপূর্ণ হোমিওপ্যাথিক ঔষধ:

1. Silicea: সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং দুর্বল শিশুদের জন্য।


2. Calcarea Phosphorica: হাড় ও দেহের গঠন শক্তিশালী করতে।


3. Lycopodium: হজম সমস্যা ও ওজন বৃদ্ধিতে সহায়ক।


4. Arsenicum Album: সংক্রমণ এবং দুর্বলতার ক্ষেত্রে কার্যকর।


5. Chamomilla: শিশুদের অস্থিরতা ও পেটে গ্যাসের জন্য।



সীমাবদ্ধতা:

1. গুরুতর অবস্থা: অকাল শিশুদের অনেক সময় উন্নত হাসপাতাল এবং ইনটেনসিভ কেয়ার প্রয়োজন হয়, যা শুধুমাত্র হোমিওপ্যাথি দিয়ে সম্ভব নয়।


2. বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ছাড়া চিকিৎসা নয়: শিশুর অবস্থা অনুযায়ী ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে, যা শুধুমাত্র অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথই নির্ধারণ করতে পারেন।


এলোপ্যাথিক চিকিৎসার ভূমিকা:


অকাল শিশুদের (Premature babies) চিকিৎসায় এলোপ্যাথিক পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অকাল শিশুদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিকমতো বিকশিত হয় না এবং তাদের জটিল শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এলোপ্যাথিক চিকিৎসায় লক্ষ্য থাকে এই শিশুদের জীবন বাঁচানো, শারীরিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করা, এবং দীর্ঘমেয়াদে যে কোনো সমস্যা প্রতিরোধ করা।


অকাল শিশুদের সাধারণ জটিলতা

অকাল শিশুরা পূর্ণ মেয়াদে জন্ম নেওয়া শিশুদের তুলনায় বিভিন্ন জটিলতার শিকার হয়। এগুলো হলো:

1. শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা:

Respiratory Distress Syndrome (RDS), কারণ তাদের ফুসফুস সম্পূর্ণ বিকশিত হয় না।


2. অপরিপক্ব হজম প্রক্রিয়া:

পুষ্টি শোষণ করতে অক্ষম।


3. থার্মোরেগুলেশন সমস্যা:

শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।



4. ইনফেকশন বা সংক্রমণ:

তাদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল থাকে।


5. নিউরোলজিকাল সমস্যা:

মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ বা বিকাশজনিত সমস্যা হতে পারে।


6. হার্টের সমস্যা:

পেটেন্ট ডাক্টাস আর্টেরিওসাস (PDA), যা সাধারণত গর্ভাবস্থায় বন্ধ হয়।




এলোপ্যাথিক চিকিৎসার ধাপ

১. ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (NICU)

অকাল শিশুদের বেশিরভাগই Neonatal Intensive Care Unit (NICU) তে চিকিৎসা করা হয়। এখানে তাদের পর্যবেক্ষণ ও সমর্থন দেওয়া হয়:

শ্বাস-প্রশ্বাস:

যদি ফুসফুস পুরোপুরি বিকশিত না হয়, তবে ventilator বা CPAP machine ব্যবহার করা হয়।

Surfactant therapy দেওয়া হয় ফুসফুসকে প্রসারিত করতে।


অক্সিজেন সাপোর্ট: 
অক্সিজেনের অভাব পূরণের জন্য সরাসরি অক্সিজেন দেওয়া হয়।


২. পুষ্টি সরবরাহ

পেটের মাধ্যমে খাওয়ানোর ক্ষমতা না থাকলে:

Intravenous (IV) এর মাধ্যমে তরল ও পুষ্টি দেওয়া হয়।


বুকের দুধের বিকল্প:

ফর্মুলা মিল্ক বা মাতৃদুগ্ধ ব্যবহার করা হয়, কারণ অকাল শিশুরা বুকের দুধ সরাসরি খেতে পারে না।


ধীরে ধীরে tube feeding বা oral feeding শুরু করা হয়।


৩. থার্মোরেগুলেশন

বিশেষ incubator ব্যবহার করা হয়, যা শিশুদের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।

স্কিন-টু-স্কিন কেয়ার বা kangaroo care মা-বাবার মাধ্যমে দেওয়া হয়।


৪. সংক্রমণ প্রতিরোধ

অকাল শিশুদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হওয়ায় সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি।

প্রোফাইল্যাকটিক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়।

সংক্রমণ প্রতিরোধে NICU-তে কঠোর স্যানিটেশন ব্যবস্থা রাখা হয়।


৫. রক্ত এবং গ্লুকোজ পর্যবেক্ষণ

রক্তের গ্লুকোজ, ক্যালসিয়াম এবং অন্যান্য ইলেক্ট্রোলাইট নিয়মিত পরীক্ষা করা হয়।

Blood transfusion প্রয়োজন হতে পারে, বিশেষত যদি অ্যানিমিয়া দেখা দেয়।


৬. হৃদযন্ত্র ও স্নায়বিক যত্ন

হার্টের সমস্যা থাকলে Indomethacin বা Surgical closure ব্যবহার করা হয়।

মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ (Intraventricular Hemorrhage) প্রতিরোধে নিয়মিত স্ক্যানিং করা হয়।

দীর্ঘমেয়াদি যত্ন

1. ফলোআপ চেকআপ:

অকাল শিশুদের নিয়মিত বৃদ্ধি, ওজন, এবং মানসিক বিকাশ পর্যবেক্ষণ করা হয়।



2. ফিজিওথেরাপি এবং ওকুপেশনাল থেরাপি:

মাংসপেশি ও স্নায়ুর কার্যকারিতা উন্নত করতে ব্যবহৃত হয়।


3. দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণ পরীক্ষা:

অকাল শিশুদের দৃষ্টিশক্তি (Retinopathy of Prematurity) এবং শ্রবণ সমস্যার ঝুঁকি বেশি।



4. ইমিউনাইজেশন:

সময়মতো ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা হয়।


প্রযুক্তির ভূমিকা

1. মনিটরিং ডিভাইস:

হৃৎপিণ্ডের গতি, অক্সিজেন স্যাচুরেশন, এবং শ্বাসপ্রশ্বাসের হার মনিটরিং করা হয়।



2. ইউল্ট্রাসাউন্ড এবং MRI:

অভ্যন্তরীণ অঙ্গের বিকাশ এবং যেকোনো জটিলতা চিহ্নিত করতে ব্যবহৃত হয়।


উপসংহার:

অকাল শিশুর জীবনের ঝুঁকি অনেক হলেও সঠিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা, পরিচর্যা এবং আধুনিক চিকিৎসা সমন্বয় করলে তারা সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। তবে, চিকিৎসার পাশাপাশি সচেতনতা এবং শিশুর প্রতি বিশেষ যত্ন অপরিহার্য।

এলোপ্যাথিক চিকিৎসায় আধুনিক প্রযুক্তি এবং উন্নত যত্নের মাধ্যমে অকাল শিশুদের বেঁচে থাকার হার অনেক বেড়ে গেছে। তবে, এটি দীর্ঘমেয়াদী একটি প্রক্রিয়া যেখানে পিতা-মাতার ধৈর্য, ভালোবাসা এবং সঠিক পরিচর্যা প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোতে অকাল শিশুদের যত্নের জন্য বিশেষায়িত ব্যবস্থা থাকলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই সুবিধা তুলনামূলকভাবে কম।

সেরা সমাধান

অকাল শিশুদের (Premature babies) চিকিৎসায় এলোপ্যাথি এবং হোমিওপ্যাথি দুটি পদ্ধতির মধ্যে লক্ষ্য ও কার্যপদ্ধতি ভিন্ন। উভয়েরই নিজস্ব কার্যকারিতা এবং সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

অকাল শিশুর চিকিৎসায় এলোপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথির সমন্বয় হতে পারে একটি কার্যকর পদ্ধতি। জরুরি অবস্থায় এলোপ্যাথি ব্যবহার করা উচিত, আর দীর্ঘমেয়াদী উন্নতির জন্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা একটি সহায়ক পদ্ধতি হতে পারে।



-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি, 
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা    
প্রভাষক, 
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ। 


আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ।

>Share by:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন


Make a comments as guest/by name or from your facebook:


Make a comment by facebook:
নবীনতর পূর্বতন