মাইট্রাল স্টেনোসিস (Mitral Stenosis) কি:
মাইট্রাল স্টেনোসিস হলো হৃৎপিণ্ডের একটি শারীরিক সমস্যা, যেখানে মাইট্রাল ভাল্ভ সরু হয়ে যায়, ফলে হৃৎপিণ্ডে রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়। এর ফলে হৃৎপিণ্ডের বাঁ দিকের উপরি চেম্বার (left atrium) থেকে বাঁ দিকের নিম্ন চেম্বার (left ventricle) পর্যাপ্ত রক্ত প্রবাহিত হতে পারে না।
আবিষ্কার:
মাইট্রাল স্টেনোসিসের ব্যাপারে প্রথম গবেষণা এবং এর রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি ১৮৩৫ সালে ফরাসি ডাক্তার Jean-Baptiste Bouillaud করেন, যিনি প্রথম এই সমস্যার সাথে রিউম্যাটিক জ্বরের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন।
অন্য নাম:
মাইট্রাল ভাল্ভ নারোসিস (Mitral Valve Narrowing)
কারণ:
১. রিউম্যাটিক জ্বর: এটি মাইট্রাল স্টেনোসিসের প্রধান কারণ।
২. বয়সজনিত পরিবর্তন: বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে মাইট্রাল ভাল্ভ ক্যালসিফাইড হয়ে যেতে পারে।
৩. জেনেটিক কারণ: কিছু জেনেটিক সমস্যার কারণে মাইট্রাল ভাল্ভ জন্মগতভাবে সরু হতে পারে।
প্রকারভেদ:
১. মৃদু মাইট্রাল স্টেনোসিস: সামান্য সংকোচন।
২. মধ্যম মাইট্রাল স্টেনোসিস: মাঝারি ধরনের সংকোচন।
৩. গুরুতর মাইট্রাল স্টেনোসিস: স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।
লক্ষণাবলী:
১. শ্বাসকষ্ট
২. বুকের ব্যথা
৩. হৃদস্পন্দন দ্রুত হওয়া বা অনিয়মিত হওয়া
৪. ক্লান্তি
৫. কাশি, রক্তমিশ্রিত কাশি হতে পারে
৬. পায়ের ফোলা
৭. হার্টের শব্দে পরিবর্তন (মারমার শব্দ শোনা যায়)
ইনভেস্টিগেশন:
১. ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম (ECG)
২. ইকোকার্ডিওগ্রাম (Echocardiogram)
৩. বুকের এক্স-রে (Chest X-ray)
৪. কার্ডিয়াক ক্যাথেটারাইজেশন
জটিলতা:
১. হার্ট ফেইলিউর: মাইট্রাল স্টেনোসিসের কারণে হার্ট ঠিকমত কাজ করতে পারে না।
২. এট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন: হার্টের অনিয়মিত স্পন্দন।
৩. পালমোনারি হাইপারটেনশন: ফুসফুসে রক্তচাপ বেড়ে যায়।
৪. ব্লাড ক্লট: হার্টে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে, যা স্ট্রোকের কারণ হতে পারে।
ভাবিফল:
মাইট্রাল স্টেনোসিসের যদি যথাযথ চিকিৎসা না হয়, তবে এটি হৃদরোগের গুরুতর সমস্যা এবং মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
প্রতিরোধ:
১. রিউম্যাটিক জ্বর প্রতিরোধ করা
২. সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো রাখা
৩. নিয়মিত হার্টের চেকআপ করা
ঘরোয়া চিকিৎসা:
১. লবণ কম খাওয়া
২. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
৩. ধূমপান এবং অ্যালকোহল এড়িয়ে চলা
৪. নিয়মিত ব্যায়াম করা
ব্যবস্থাপনা:
ওষুধ: মাইট্রাল স্টেনোসিসে ব্যবহৃত ওষুধগুলি অন্তর্ভুক্ত:
১. ডায়ুরেটিকস (ফ্লুইড নিয়ন্ত্রণে)
২. বেটা-ব্লকার বা ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার (হার্ট রেট নিয়ন্ত্রণে)
৩. রক্ত পাতলা করার ওষুধ (ব্লাড ক্লট প্রতিরোধে)
সার্জারি: গুরুতর ক্ষেত্রে মাইট্রাল ভাল্ভ রিপ্লেসমেন্ট বা ভাল্ভটোমি করা যেতে পারে।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন:
১. শ্বাসকষ্ট হলে
২. হার্টের অনিয়মিত স্পন্দন অনুভব করলে
৩. বুকের ব্যথা বা অস্বস্তি হলে
কি খাওয়া যাবে:
১. সবুজ শাকসবজি
২. তাজা ফল
৩. প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার (যেমন, মাছ, মুরগি)
৪. কম চর্বিযুক্ত খাবার
কি খাওয়া যাবেনা:
১. অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার
২. বেশি চর্বিযুক্ত এবং ভাজা খাবার
৩. প্রক্রিয়াজাত খাবার
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা:
হোমিওপ্যাথিতে মাইট্রাল স্টেনোসিসের জন্য বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহৃত হয়। কিছু প্রধান ওষুধের মধ্যে রয়েছে:
১. Digitalis: যখন হার্টের স্পন্দন খুব ধীরে বা অনিয়মিত হয়।
২. Aconitum: দ্রুত হৃদস্পন্দন এবং বুক ধড়ফড় করলে।
৩. Cactus Grandiflorus: যখন বুকের মধ্যে সংকোচনের মতো অনুভূতি হয়।
৪. Spigelia: যখন হার্টের ব্যথা এবং ফুসফুসের সমস্যার সাথে মাইট্রাল ভাল্ভের সমস্যা থাকে।
হোমিওপ্যাথিক দার্শনিক ও ডাক্তারদের মতামত:
সামুয়েল হ্যানিম্যান (Homoeopathy-র প্রতিষ্ঠাতা) মনে করতেন যে হৃদরোগের প্রকৃত কারণ আবিষ্কার করতে হবে এবং তার জন্য মানসিক এবং শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে চিকিৎসা করতে হবে।
ড. জেমস টাইলার কেন্ট মনে করেন যে হৃদরোগের চিকিৎসায় রোগীর পুরো দেহের অবস্থা, তার মানসিক পরিস্থিতি, এবং তার পরিবেশকে বিবেচনা করা জরুরি।
++++
মাইট্রাল স্টেনোসিস রোগীর খাদ্য তালিকা :
মাইট্রাল স্টেনোসিস রোগীর খাদ্যাভ্যাসে বিশেষ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন, যাতে হৃদযন্ত্রের উপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। এখানে মাইট্রাল স্টেনোসিস রোগীর জন্য একটি বিস্তারিত খাদ্য তালিকা দেওয়া হলো:
১. ফল এবং শাকসবজি:
তাজা ফল: আপেল, কমলা, পেয়ারা, নাশপাতি, বেরি, আঙ্গুর, কলা।
শাকসবজি: পালং শাক, ব্রকলি, বাঁধাকপি, গাজর, টমেটো, শসা, বেগুন।
পাতা জাতীয় সবজি: পালং শাক, মুলা শাক, লাল শাক, ধনেপাতা।
ফল এবং শাকসবজি হৃদযন্ত্রের জন্য খুবই উপকারী, কারণ এতে উচ্চ মাত্রার ফাইবার, ভিটামিন এবং মিনারেল থাকে, যা রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
২. প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার:
মাছ: তেলসমৃদ্ধ মাছ যেমন সামুদ্রিক মাছ (স্যালমন, সারডিন), টুনা, যা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ এবং হৃদযন্ত্রের জন্য ভালো।
চিকেন (চর্বিহীন মাংস): চর্বিহীন মাংস, যেমন মুরগির বুকের মাংস।
ডাল ও বীজ: মুসুর ডাল, মুগ ডাল, ছোলা, মটর, সয়াবিন।
প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার শরীরের মাংসপেশী তৈরি করতে সহায়ক এবং এটি স্বাস্থ্যকর হৃদযন্ত্রের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
৩. শস্য এবং শর্করা:
পুরো শস্য: ওটমিল, ব্রাউন রাইস, গমের রুটি, বার্লি।
মহিষের আটা, ব্রাউন রাইস: রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এবং সঠিক হজমে সাহায্য করে।
৪. দুগ্ধজাত পণ্য:
কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য: লো-ফ্যাট দুধ, স্কিমড মিল্ক, লো-ফ্যাট দই এবং ছানা।
দুগ্ধজাত পণ্য থেকে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় যা হাড় মজবুত করে। তবে পূর্ণ চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত খাবার এড়িয়ে চলা ভালো, কারণ এতে হৃদযন্ত্রের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়তে পারে।
৫. চর্বি এবং তেল:
স্বাস্থ্যকর তেল: অলিভ অয়েল, সূর্যমুখী তেল, ক্যানোলা তেল, তিসি তেল (flaxseed oil)। এই তেলগুলোতে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, যা হার্টের জন্য ভালো।
নাটস: বাদাম, আখরোট, চিয়া বীজ, সানফ্লাওয়ার বীজ।
এগুলো স্বাস্থ্যকর ফ্যাটের ভালো উৎস এবং হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী।
৬. পানি এবং তরল:
প্রচুর পানি: প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করা জরুরি, তবে যদি শরীরে পানি জমার সমস্যা হয় (edema), তবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পানি গ্রহণ সীমিত করতে হবে।
হালকা হারবাল চা: ক্যাফেইন মুক্ত গ্রিন টি, ক্যামোমাইল চা।
৭. নিয়ন্ত্রিত লবণ গ্রহণ:
লবণ গ্রহণ কমাতে হবে, কারণ অতিরিক্ত লবণ উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে, যা হৃদযন্ত্রের উপর অতিরিক্ত চাপ ফেলে। দিনে ২ গ্রাম বা এর কম লবণ গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
৮. স্ন্যাকস:
স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস: কাঠবাদাম, আখরোট, বেকড স্ন্যাকস, ফ্রুট সালাদ।
ফাস্ট ফুড বা প্রসেসড স্ন্যাকসের পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস গ্রহণ করতে হবে।
---
এড়িয়ে চলতে হবে যেসব খাবার:
১. উচ্চ লবণযুক্ত খাবার:
প্রক্রিয়াজাত খাবার, যেমন: চিপস, ফাস্ট ফুড, প্যাকেটজাত খাবার।
পনির, আচার, ক্যাচাপ বা সস জাতীয় খাবার যেগুলোতে উচ্চ মাত্রার লবণ থাকে।
২. বেশি চর্বিযুক্ত খাবার:
রেড মিট: গরু ও খাসির মাংসের মতো রেড মিট, যা হৃদযন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
প্রসেসড মাংস: সসেজ, সালামি, বেকন।
৩. উচ্চ কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার:
মাখন, ঘি, পূর্ণ চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য।
৪. প্রক্রিয়াজাত এবং ফাস্ট ফুড:
বার্গার, পিৎজা, হটডগ ইত্যাদি খাবার হৃদযন্ত্রের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
৫. অ্যালকোহল এবং ক্যাফেইন:
অ্যালকোহল এবং অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ এড়িয়ে চলা উচিত, কারণ এগুলো হৃদযন্ত্রের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
অতিরিক্ত পরামর্শ:
প্রচুর সবুজ শাকসবজি: শাকসবজির মধ্যে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক।
কম চর্বিযুক্ত প্রোটিন: ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ যেমন স্যামন, টুনা, এবং চর্বিহীন মাংস ভালো।
লবণ নিয়ন্ত্রণ: প্রতিদিনের খাবারে লবণের পরিমাণ সীমিত করতে হবে।
এই খাদ্যতালিকা মেনে চললে মাইট্রাল স্টেনোসিস রোগীদের হৃদযন্ত্রের উপর চাপ কমবে এবং রোগের জটিলতা কমে আসবে।
-- ডাঃ কাজী সাইফ উদ্দীন আহমেদ
বি এস সি(বায়োকেমিস্ট্রি), ঢা.বি,
ডি এইচ এম এস (বোর্ড স্ট্যান্ড), ঢাকা
প্রভাষক,
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ।
আমাদের লেখার কোন অংশ রেফারেন্স ছাড়া কপি বা শেয়ার সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ।
>Share by:
Make a comments as guest/by name or from your facebook:
সুন্দর পরামর্শ দেওয়ার জন্য জাযাকাল্লাহু খাইরান।
উত্তরমুছুনMake a comment by facebook: